তাঁদের স্বামীরা বেঁচে আছেন নাকি মরে গেছেন, তা তাঁরা জানেন না। তাঁরা বিধবা নাকি সধবা, নিশ্চিত করে তা–ও কেউ বলছেন না। অভিধানে তাঁদের জন্য জুতসই কোনো ‘শব্দ’ নেই। কারও স্বামী তিন বছর, কারও স্বামী আট বছর আগে গুম হয়েছেন। তাঁরা একদিন না একদিন ফিরে আসবেন, স্বজনেরা আগে এমন সান্ত্বনা দিলেও এখন আর কোনো আশার কথা শোনান না।
২০১১ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে গুম হওয়া পাঁচ ব্যক্তির স্ত্রীর সঙ্গে সম্প্রতি কথা বলেছে প্রথম আলো। স্বামী গুম হয়ে যাওয়ার পর তাঁদের কেউ কেউ স্বামী–শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে বাবা–মায়ের কাছে ফিরে গেছেন। কখনো পরমুখাপেক্ষী ছিলেন না, এখন বেঁচে থাকার জন্য অন্যের সহায়তা নিতে হয়। কারও কারও ক্ষেত্রে নতুন জীবন শুরু করতে পরিবারের চাপ আছে। কিন্তু স্বামী যদি কখনো ফিরে আসেন, যদি সন্তানেরা কষ্ট পায়—এ রকম হাজারো যদির চক্করে থমকে গেছে তাঁদের জীবন।
এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত ৫৩২ জন গুম হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১৫৮ জনের সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি। বাকিদের বড় অংশকে পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার দেখায়, কারও কারও লাশ উদ্ধার হয়।
২০১০ সালের ২১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে গুমের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। এর পরের বছর থেকে ৩০ আগস্ট আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে জাতীয় প্রেসক্লাবে আজ শুক্রবার সকাল ১০টায় আলোচনা সভার আয়োজন করেছে ‘মায়ের ডাক’ নামের একটি সংগঠন।
ফারজানা আক্তার ১৫ বছর বয়সে ভালোবেসে পারভেজ হোসেনকে বিয়ে করেছিলেন। পারভেজ হোসেন বংশাল থানা ছাত্রদলের সভাপতি ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচয়ে তাঁকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে একদল লোক তুলে নিয়ে যায়। আর ফেরেননি। ফারজানার দ্বিতীয় সন্তান তখন পেটে। পারভেজের ইসলামপুরে কাপড়ের ব্যবসা আর ইংলিশ রোডে ছোট একটা দোকান ছিল। হাতছাড়া হয়ে গেছে সব। শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে মায়ের কাছে এসে ওঠেন একসময়। মা বাড়িভাড়া দিয়ে যে টাকাটা পান, তাই দিয়ে ফারজানা আর তাঁর ছেলেমেয়েদের জীবন চলে। আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘আমার ছোট বাচ্চাটাকে একটা চকলেট, এক প্যাকেট চিপস কিনে দেওয়ারও কেউ নেই। আমাদের জীবনে কোনো উৎসব–অনুষ্ঠান নেই। বেড়াতে যাওয়া নেই। একদিন শুনবেন গুম পারভেজের বউ আত্মহত্যা করেছে।’
স্বামী–শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে মায়ের কাছে উঠে এসেছেন জেসমিন আক্তারও। সাতক্ষীরার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক মোখলেছুর রহমানের স্ত্রী তিনি। মোখলেছ নিখোঁজ হন ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট। জেসমিন তখন অন্তঃসত্ত্বা। তিনি বলছিলেন, নিজেকে ক্ষমতাহীন বোঝার মতো মনে হয়, বন্ধুহীন মনে হয় এখন। অপেক্ষা করছেন, মোখলেছ একদিন ফিরলে জমে থাকা সব কথা বলবেন...।
>২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের জুলাই পর্যন্ত ৫৩২ জন গুম হয়েছেন
১৫৮ জনের সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি।
স্বামী গুম হওয়ার পর কেউ কেউ বাবা-মায়ের কাছে ফিরে গেছেন
কষ্টে আছেন রাজধানীর সবুজবাগ থানার ২৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদল সভাপতি কাজী ফরহাদের স্ত্রী ফারিয়া আক্তার। ঢাকার বাসা ছেড়ে মায়ের কাছে সিলেটে চলে গেছেন। মেয়েটাকে স্কুলে দিয়েছেন। বাবা কোথায় জানতে চাইলে মেয়ে নিজেই বানিয়ে বানিয়ে বলে, বাবা ঢাকায় চাকরি করেন। একটু একটু করে মেয়ে বড় হচ্ছে, খরচ বাড়ছে। সামনে কী করে চলবেন, জানেন না।
পল্লবী থানা যুবলীগের সভাপতি নূর আলমের স্ত্রী রিনা আলমের গল্পটা একটু আলাদা। তাঁর তিন ছেলের মধ্যে এক ছেলের পড়ার খরচ স্বামীর এক রাজনৈতিক সহকর্মী চালান। নূর আলম বাড়ি করে দিয়েছিলেন স্ত্রীকে। সেখানে চারটি ঘর তুলে ভাড়া দিয়েছেন। এভাবেই চলছে। স্বামী নিখোঁজ হওয়ার পর নিজের জন্য কখনো কিছু কেনেননি।
ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা কে এম শামীম আক্তার সাত বছরের ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে বাড়ি ফেরার পথে গুম হয়েছিলেন ২০১১ সালে। পুরানা পল্টন লাইন থেকে তাঁকে তুলে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যক্ষদর্শী আছেন। তাঁরা যখন জানতে চেয়েছিলেন কেন শামীমকে মুখে স্কচটেপ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, জবাব এসেছিল তাঁরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোক। সব বাহিনীর কাছে গেছেন তাঁর স্ত্রী ঝরনা খানম। কোনো জবাব পাননি। তিনি নিজে একটি মানবাধিকার সংগঠনে কাজ করেন। এই চাকরিটাই তাঁর সম্বল। শাশুড়ি আর ১৫ বছর বয়সী ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে স্বাভাবিক জীবনযাপনের চেষ্টা করেন। তাঁর কথা, একটা মানুষ যখন মারা যায়, তার একটা কবর থাকে। অন্তত কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আপনজনেরা মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তি কামনা করেন। তাঁর ছেলে বাবার জন্য কোথায় গিয়ে প্রার্থনা করবে?