■ হাসপাতালটি প্রায় ২৫ কোটি টাকায় কেনা হলেও প্রকাশ্যে লেনদেন হয়েছে প্রায় ১৯ কোটি টাকা।
■ ফারমার্স ব্যাংকের তিন ঋণ গ্রাহকের হিসাব থেকে গেছে ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা।
ফারমার্স ব্যাংক (এখন নাম বদল করে পদ্মা ব্যাংক) থেকে ঋণ নিয়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। সেই ঋণের একটি অংশ দিয়ে কেনা হয়েছে গাজীপুরের সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। সে সময়ে ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বর্তমান সাংসদ মহীউদ্দীন খান আলমগীর। সিটি মেডিকেলেরও মালিক তিনি।
গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় অবস্থিত ওই হাসপাতাল কেনা হয় প্রায় ২৫ কোটি টাকায়। অথচ ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে প্রকাশ্যে লেনদেন হয়েছে প্রায় ১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে ফারমার্স ব্যাংকের তিন ঋণ গ্রাহকের হিসাব থেকে গেছে ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ব্যাংকের গুলশান শাখার এই তিন প্রতিষ্ঠান হচ্ছে এটলাস গ্রিনপ্যাক লিমিটেড, ক্রিয়েটিভ ফ্যাশন ট্রলার এবং আয়েশা এন্টারপ্রাইজ। তাদের কাছে সুদ ও আসল মিলিয়ে ফারমার্স বা পদ্মা ব্যাংকের পাওনা ১১৫ কোটি টাকার ওপরে, যা আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ। একই প্রক্রিয়ায় ঋণের টাকার একটি অংশ দিয়ে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরা ট্রলার ও কার্গো জাহাজ কেনা হয়েছে। এরও মালিক মহীউদ্দীন খান আলমগীর।
গ্রাহকের ঋণের টাকা সরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়ায় ব্যাংকটির নিরীক্ষা কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহবুবুল হক চিশতী ওরফে বাবুল চিশতীর সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুর্নীতির মাধ্যমে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের বিভিন্ন মামলায় চিশতী ও তাঁর পরিবারের কয়েকজন সদস্য এখন কারাগারে। একই সময়েই মহীউদ্দীন খান আলমগীর ছিলেন ব্যাংকটির চেয়ারম্যান। তবে তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়নি।
অন্যের ঋণের টাকা হাসপাতালে
সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের গুলশান শাখার গ্রাহক ক্রিয়েটিভ ফ্যাশন ট্রলার ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ নেয়। এই ঋণ হিসাব থেকে ৪ কোটি ৬৪ লাখ টাকা যায় সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিক্রেতার কাছে। অর্থের চেকগুলোয় সই করেন ক্রিয়েটিভ ফ্যাশনের স্বত্বাধিকারী এম এ মোতালেব। তিনি প্রথম আলোর কাছে ক্যাশ চেক দেওয়ার কথা স্বীকারও করেছেন। হাতে আসা তথ্যপ্রমাণ অনুযায়ী, সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের টাকা নেওয়া হয়েছে ওই হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রিফায়েত উল্লাহ শরীফের মাধ্যমে। সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ৯০ শতাংশের মালিক মহীউদ্দীন খান আলমগীর এবং ১০ শতাংশের মালিক রিফায়েত উল্লাহ শরীফ।
এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য গত এক সপ্তাহে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ করার চেষ্টা হয়। তাঁকে ফোন করা হয় অনেকবার। গত ২২ আগস্ট সরকারি ও ব্যক্তিগত ই-মেইলে তাঁকে বক্তব্য দেওয়ার অনুরোধ করা হয়। এরপর ২৪ আগস্ট আবারও বক্তব্য চেয়ে তাঁকে ই-মেইল করা হয়। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রিফায়েত উল্লাহ শরীফ এ বিষয়ে প্রথম আলোকে জানান, ব্যাংক থেকে সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টাকা স্থানান্তরের প্রক্রিয়া সম্পর্কে তিনি অবগত নন। গ্রাহকের ঋণ হিসাব থেকে টাকা তোলা এবং সেই টাকা পে-অর্ডার করার আবেদনে সই থাকার তথ্যপ্রমাণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘এটা হতে পারে না। আমি এমন কোনো পে-অর্ডারের আবেদনে সই করিনি।’
যদিও প্রথম আলোর কাছে এ-সংক্রান্ত প্রমাণ রয়েছে এবং দুদকের তদন্তেও টাকা হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ করা হয়েছে।
হাসপাতালটি বিক্রি করেছেন ডা. এস এম বদরুদ্দোজা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বিশেষ পরিস্থিতিতে জমা, অবকাঠামোসহ হাসপাতালটি বিক্রি করেছেন। টাকা ক্রেতা কোথা থেকে এবং কীভাবে দিয়েছেন, সেটি তাঁর জানা নেই।
অন্যের নামে কোম্পানি খোলা
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থায় মহীউদ্দীন খান গভীর সমুদ্রে মাছ ধরার লাইসেন্স নিয়েছিলেন। ক্রিয়েটিভ ফ্যাশনসের ঋণের অর্থ দিয়ে কেনা হয়েছে মাছ ধরার এই ট্রলার ও কার্গো জাহাজ। ক্রিয়েটিভ ফ্যাশনসের মালিক সড়ক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী এ কে এম আবদুল মোতালেব। তাঁর বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়ায়, মহীউদ্দীন খান ওই এলাকার সংসদ সদস্য। মোতালেব কচুয়া আওয়ামী লীগের নেতা এবং মহীউদ্দীন খানের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
এ সম্পর্কে জানতে চাইলে এ কে এম আবদুল মোতালেব প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাকে জোর করে ব্যবসায়ী বানানো হয়েছে। নতুন কোম্পানি খুলে ফারমার্স ব্যাংক থেকে ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া হয়েছিল। এরপর সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ফিশিং বোট এবং কার্গো কেনার জন্য সাড়ে ১২ কোটি টাকা নেওয়া হয়। এমনকি আমার স্বাক্ষর ছাড়াই সাড়ে তিন কোটি টাকা ঋণ হিসাব থেকে তোলা হয়েছে। এ জন্য আমি মামলা করেছি বাবুল চিশতীসহ অন্যদের বিরুদ্ধে।’ ব্যাংকের চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খানকে মামলা থেকে বাদ দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বোঝেন তো, উনি আমাদের নেতা।’
এভাবে আমানতকারীর টাকা নয়ছয় করা বড় ধরনের আর্থিক অপরাধ। এ জন্য ফৌজদারি মামলা হতে পারে। একজন ব্যক্তি কেন ঋণ নিচ্ছেন, তা ঋণ নথিতে লেখা থাকে। এর বাইরে সেই ঋণ ব্যবহার করা অপরাধ।খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর।
টাকা নেওয়ার আরও ঘটনা
ফারমার্স ব্যাংক থেকে ৬১ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছিল প্যাকেজিং প্রতিষ্ঠান অ্যাটলাস গ্রিনপ্যাক। এই ঋণ হিসাব থেকে ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর দুই কোটি টাকার দুটি চেক নগদায়ন করা হয়। এরপর মুতাসির উদ্দিন খান ইয়ামিনের স্বাক্ষরে পে-অর্ডার হয়। মুতাসীর উদ্দীন খান হলেন মহীউদ্দীন খানের ভাতিজা।
কোম্পানিটির মূল মালিক সৈয়দ ফজলে রাব্বী ২০১৭ সালে কানাডায় মারা যান। তাঁর স্ত্রী, পুত্র ও কন্যা বিদেশে আছেন। আর কারখানাটির ভবন ও সম্পদের পাওনাদার আরেকটি প্রতিষ্ঠান দখলে নিয়েছে। সেই ঋণ সুদাসলে ৮৩ কোটি টাকা হয়েছে।
আবার মেসার্স আয়েশা এন্টারপ্রাইজ ফারমার্স ব্যাংক থেকে দুই কোটি টাকা ঋণ নেয়। এই ঋণ হিসাবের বিপরীতে ১ কোটি ৬৯ লাখ ৭৫ হাজার টাকার ক্যাশ চেক দেওয়া হয়। ওই টাকা নগদায়ন করে ২০১৬ সালের ২৮ জুলাই সিটি হাসপাতালের নামে পে-অর্ডার করা হয়।
আয়েশা এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী জসীমউদ্দিন এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঋণ আবেদন করলেও আমি টাকা পাইনি। ঋণ অনুমোদনের সময় অগ্রিম চেক নেওয়া ছিল। সেই চেকে টাকা অবৈধভাবে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে।’ সেই টাকা কোথায় গেছে, তা-ও তাঁর জানা নেই। ওই টাকা সিটি মেডিকেল কলেজে যাওয়ার কথা শুনে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, তাঁকে বিষয়টি জানানো হয়নি।
এদিকে এভাবে কেনা ৫০০ শয্যার আলোচিত এই সিটি হাসপাতালটির অনুমোদনও নেই। গত ১০ আগস্ট র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত সেখানে অভিযান চালিয়ে সাড়ে সাত লাখ টাকা জরিমানা করেন।
সামগ্রিক বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে আমানতকারীর টাকা নয়ছয় করা বড় ধরনের আর্থিক অপরাধ। এ জন্য ফৌজদারি মামলা হতে পারে। একজন ব্যক্তি কেন ঋণ নিচ্ছেন, তা ঋণ নথিতে লেখা থাকে। এর বাইরে সেই ঋণ ব্যবহার করা অপরাধ। এ ধরনের অপরাধের মাধ্যমে ব্যাংকটি প্রায় ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে, এ জন্য সংশ্লিষ্টদের বিচার নিশ্চিত করা উচিত।