ক্রিকেটার থেকে জাতীয় তারকা হয়ে ওঠা মাশরাফি বিন মর্তুজার জীবনে রয়েছে নানা রকম ঈদের গল্প। সেই গল্প শোনাচ্ছেন দেবব্রত মুখোপাধ্যায়
সে এক চানরাতের গল্প।
প্রতিবারের মতো ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসেছেন মাশরাফি। ও আচ্ছা, মাশরাফি নয়; নড়াইলের ‘কৌশিক’। সন্ধ্যার পর বন্ধুদের সঙ্গে খুব আড্ডা দিচ্ছেন। ঢাকা থেকে আসা কজন সাংবাদিকও আছেন। শ্বাস ফেলার সুযোগ নেই আড্ডার ফাঁকে। এর মধ্যেই দূর থেকে একটা হইচইয়ের শব্দ ভেসে এল।
আড্ডার সবাই একটু ভয় পেলেন। কোনো গোলমাল নয়তো?
মনে হচ্ছে মিছিল নিয়ে কারা এদিকে আসছে। অনেকেই উঠে পড়তে চাইলেন। বিশেষত সাংবাদিকেরা ভয় পাচ্ছেন। মাশরাফির অনুগত ৪০ জনের মতো বন্ধু তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। তখন তিন ফরম্যাটের অধিনায়ক মাশরাফি সবাইকে ধমক দিলেন, ‘ভয় পাওয়ার কী আছে? নড়াইলে কি আমাদের কেউ মারতে আসবে?’
বলতে বলতেই মিছিলটি কাছে চলে এল। মিছিল নয়, ট্রাকভর্তি ১৫-১৬ বছর বয়সী একঝাঁক কিশোর। তারা একটানা ‘মাশরাফি, মাশরাফি’ বলে স্লোগান দিচ্ছে। সবাই হতভম্ব। তখনো জনপ্রতিনিধি হননি মাশরাফি, রাজনীতি শুরু করেননি। তাহলে মাশরাফিকে নিয়ে এই মিছিল কিসের!
ট্রাক থেকে নেমে এল কিশোরেরা। হাঁপাতে হাঁপাতে যা বলল, তারা যশোর থেকে ট্রাক ভাড়া করে মাশরাফিকে দেখতে এসেছে।
কিন্তু আজ এই সন্ধ্যার পরই কেন মাশরাফিকে দেখতে আসতে হলো?
এক কিশোর একগাল হেসে বলল, ‘আইজ চানরাত না। তাই আমাগো চান কৌশিক ভাইরে দেখতে এসেছি।’
এতকাল পর মাশরাফির ঈদের গল্প লিখতে গিয়ে মনে পড়ল, এই দেশের লাখো এমন কিশোরের কাছে মাশরাফিই একটা ঈদের চাঁদ। তাঁর সঙ্গে সময় কাটাতে পারাটা তাদের কাছে যেন ঈদের আনন্দ।
মাশরাফির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা খুব সত্যি। তাঁর ঈদ মানে নড়াইল; আর নড়াইল মানেই ঈদ। মাশরাফির এখন অনেক পরিচয়—সংসদের হুইপ, সংসদ সদস্য, জাতীয় দলের সফলতম অধিনায়ক। কিন্তু নড়াইলের কাছে মাশরাফির একটাই পরিচয়—‘আমাগো কৌশিক’। আর এই নড়াইলে পৌঁছাতে পারলে মাশরাফির কাছে প্রতিটা দিনই ঈদের মতো উৎসবের।
ছোটবেলা থেকে একগাদা বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘোরা আর হইচই করাটা মাশরাফির স্বাভাবিক জীবন। এখন এই জীবনেও এসে তা বদলায়নি। ঈদের দিনগুলোয় সেটা আরও বেশি হয়।
এই ক্রিকেটারের একেবারে ছোটবেলার ঈদ ছিল তাঁর বাবার বাড়িতে। কথাটা একটু ব্যাখ্যার দাবি রাখে। মাশরাফিরা নড়াইল শহরের কাছে যে বাসায় থাকেন, সেটা তাদের আদি বাড়ি নয়। শহর থেকে একটু দূরে জমিদারবাড়ির মতো একটা প্রাচীন বাড়ি থেকে এখানে এসেছেন তাঁর বাবা গোলাম মুর্তজা। কিন্তু ঈদের দিন ওই বাড়িতে ফিরে যাওয়ার একটা রেওয়াজ ছিল তাঁদের বাড়িতে।
ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে নামাজ পড়ে ওই পুরোনো বাড়িতে যাওয়ার স্মৃতিটাই ঈদ নিয়ে মাশরাফির সবচেয়ে পুরোনো আর সুন্দর স্মৃতি। ওখানে তাঁর মা হামিদা মুর্তজা আগেই পৌঁছে যেতেন। ঈদের দিনের খাওয়াদাওয়া হতো। সেই সঙ্গে পুরোনো বাড়ির পাশের ঝোপঝাড়ে একটু লুকোচুরি; কিংবা গাছ বেয়ে ওঠার চেষ্টা।
একটু বড় হতেই জগৎটা বদলে গেল মাশরাফির। নামাজ পড়ার পর বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার অনুমতি মিলল বাসা থেকে। এবার ডানা মেলে আরও উড়াল দিল মাশরাফির ঈদস্বপ্ন। নামাজ পড়ে বন্ধুদের নিয়ে চিত্রার পাড়ে বসে আড্ডা। দুপুর হয়ে aআসতে পাঞ্জাবি খুলে চিত্রা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে এপার-ওপার করা। আর বিকেল হতে খোকাদার দোকানে ভিড় করা।
হ্যাঁ, সেই বয়সে ‘খোকাদার দোকান’ ছিল মাশরাফিদের ঈদের বড় আকর্ষণ। এই দোকানটাতে কোমল পানীয় পাওয়া যেত। সারা বছর তা খাওয়ার জন্য টাকা বা অনুমতি মিলত না। ঈদের দিন সালামির টাকা জমিয়ে সবাই মিলে খোকাদার দোকানে এসে একটা করে পেপসি খাওয়ার সে কি ঐশ্বরিক আনন্দ!
সময় আরেকটু এগোয়। মাশরাফি আরেকটু উড়নচণ্ডী হয়ে ওঠেন। এত দিনে ভ্যানে ঘোরা শুরু করেছেন ঈদের দিনে। একবার ঈদের আগে মোটরসাইকেল চড়ারও অনুমতি পেয়ে গেলেন। ছোট মামার মোটরসাইকেল এবং বন্ধুদের আরও কয়েকটা মোটরসাইকেল নিয়ে বিরাট দল ধরে নামাজের পর গতির ঝড় তোলা হয়ে উঠল মূল নেশা।
তত দিনে মাশরাফি জাতীয় তারকা হয়ে গেছেন। মাশরাফিকে নিয়ে আগ্রহ সারা দেশের। আর মাশরাফির আগ্রহ কেবল নড়াইল নিয়ে। ঈদের সময় নড়াইল আসতেই হবে। নড়াইল এসে ঈদগাহে নামাজ পড়ে মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে ছুটতে না পারলে কিসের আনন্দ!
তবে জীবনটা তো সব সময় ইচ্ছেমতো যায় না। জাতীয় দলে খেললে কিছু জিনিস জোর করে নিজেকে মানিয়ে নিতে হয়। তেমনই নড়াইলের বাইরে মাশরাফির প্রথম ঈদ কাটল ২০০৩ সালে। সে এক বীভৎস অভিজ্ঞতা। দক্ষিণ আফ্রিকার এই বিশ্বকাপ ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের জঘন্যতম পারফরম্যান্স। মাশরাফি নিজেও ইনজুরিতে পড়ে ফিরে এসেছিলেন বিশ্বকাপ থেকে। তার আগে ওখানেই করতে হয়েছিল সে বছরের ঈদ।
কষ্টের একটা সীমা আছে তো! জীবনে প্রথম নড়াইলের বাইরের ঈদের আগের দিন মাশরাফিদের দল কানাডার বিপক্ষে হেরে গিয়েছিল! এরপর আর ঈদ হয়?
পরের বছরও খুব বাজে কাটল ঈদটা। ২০০৪ সালে ঈদের ঠিক আগের দিন অস্ট্রেলিয়ায় হাঁটুর অস্ত্রোপচার হয়েছিল। ঈদের দিনটা কেটেছিল পোস্ট অপারেটিভে শুয়ে শুয়ে। সেদিন মাশরাফির চোখের জল কোনো নিষেধ মানেনি।
এখন বড় হয়েছেন। অনেক কিছু মনের বিরুদ্ধে করতে হয়। এরপর তাই অনেক ঈদ দেশের বাইরে কাটাতে হয়েছে। তবে জীবনটা একটু শান্ত হয়েছে। এখন রাজনীতির সুবাদে বছরটাই প্রায় তাঁর কাটে নড়াইলে। ফলে ঘরের ঈদ খুব একটা মিস করতে হয় না। এই তো এ বছরও ঈদুল ফিতরের দিন বন্ধুবান্ধব নিয়ে ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন করেছিলেন। মজার ব্যাপার, সেখানে মাশরাফি একটা ম্যাচে ম্যান অব দ্য ম্যাচও হয়েছিলেন।
কিন্তু ঈদ এলে এত সব স্মৃতি ছাপিয়ে মাশরাফির মাথায় ভর করে একটি প্রতিবন্ধী ছেলের মুখ।
সেই সময় মাত্র জাতীয় দলে ঢুকেছেন তিনি। বাড়ির পাশেই একটি শারীরিক প্রতিবন্ধী ছেলে ছিল। প্রতি ঈদে মাশরাফির মা তাঁকে জামাকাপড় দিতেন, খাওয়াতেন। সেবার ঈদের দুই দিন আগে ছেলেটা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেল। ছেলেটার একমাত্র স্বজন মা থাকেন লেবাননে।
মাশরাফি নিজের হাতে ওই ছেলের দাফন করলেন। নিজে তাঁর মাকে ফোন করে ছেলের মৃত্যুসংবাদ জানালেন। পরদিন ঈদের নামাজ পড়ে আসা পর বুকের মধ্যে হু হু করতে থাকল, আহা, ছেলেটা আর সেমাই খেতে আসবে না!