করোনার টিকা নিয়ে মানুষের মধ্যে নানা ধরনের সংশয় ছিল। তবে এই টিকার তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার খবর গণমাধ্যমে আসেনি।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার টিকার প্রথম ডোজ নেওয়ার পর ৭৪ শতাংশ টিকাগ্রহীতা এবং দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর ৫৫ শতাংশ টিকাগ্রহীতা কোনো না কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা জানিয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অর্থায়নে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের শিক্ষকেরা এই গবেষণা করেছেন। গবেষণাটি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ জার্নালে ছাপা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, করোনা টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পুরুষের তুলনায় নারীদের ক্ষেত্রে কিছুটা বেশি।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে ময়মনসিংহ জেলায় টিকা নেওয়া ২৯৩ জনের তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকেরা। এঁদের মধ্যে নারী ছিলেন ১৫৯ জন এবং পুরুষ ১৩৪ জন। গড় বয়স ৪০ বছর ৩ মাস। ১০ শতাংশ ছিল ধূমপায়ী। গবেষণায় অংশগ্রহণকারীদের ৮৭ শতাংশ ছিলেন স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী। এরা প্রত্যেকেই অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার দুই ডোজ করে টিকা নিয়েছিলেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, ৫৮ শতাংশ ব্যক্তি বলেছেন, প্রথম ডোজ নেওয়ার পর টিকা নেওয়ার স্থানে ব্যথা হয়েছিল, দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর এই হার ছিল ৪৯ শতাংশ। প্রথম ডোজ নেওয়ার পর জ্বর হওয়ার কথা বলেছিলেন ৩৩ শতাংশ, দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর সেই হার কমে দাঁড়ায় ২১ শতাংশে। প্রথম ডোজ নেওয়ার পর মাথাব্যথার কথা বলেছিলেন ২১ শতাংশ। অন্যদিকে দ্বিতীয় ডোজ টিকা নেওয়ার পর একই ধরনের সমস্যার কথা বলেছিলেন ৮ শতাংশ।
আমরা শুধু একটি টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি। অন্য টিকা নিয়ে গবেষণা করলে আরও তথ্য পাওয়া যাবে। গবেষণা বাড়ালে টিকা নিয়ে মানুষের সংশয় দূর হবে।মোহাম্মদ কামরুজ্জামান খান, কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ
গবেষকেরা দেখেছেন, করোনা টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পুরুষের তুলনায় নারীদের ক্ষেত্রে কিছুটা বেশি দেখা গেছে। প্রথম ডোজ নেওয়ার পর ৭৮ শতাংশ নারীর কোনো না কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। প্রথম ডোজ নেওয়ার পর পুরুষের মধ্যে এই হার ছিল ৬৯ শতাংশ। দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার পর ৬৫ শতাংশ নারীর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল। পুরুষের ক্ষেত্রে তা ৪৪ শতাংশ।
এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান মোহাম্মদ কামরুজ্জামান খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শুধু একটি টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছি। অন্য টিকা নিয়ে গবেষণা করলে আরও তথ্য পাওয়া যাবে। গবেষণা বাড়ালে টিকা নিয়ে মানুষের সংশয় দূর হবে, টিকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়াও সহজ হবে।’
বাগেরহাট সদর হাসপাতালে ২০২১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম যে পাঁচজনকে করোনার টিকা দেওয়া হয়েছিল, তাঁর মধ্যে ছিলেন বিষ্ণু প্রসাদ চক্রবর্ত্তী। টিকা নেওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে তাঁর বুকে ব্যথা, মাথাব্যথা শুরু হয়। তিনি চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করেন।
একটি বেসরকারি টেলিভিশনের এই প্রতিনিধিকে প্রথম ভর্তি করা হয় বাগেরহাট সদর হাসপাতালে। তাঁর চিকিৎসায় একটি বোর্ড গঠিত হয়। বোর্ড বিষ্ণু প্রসাদ চক্রবর্ত্তীকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেয়। বিষ্ণুকে পরে খুলনা মেডিকেল কলেজ থেকে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) পাঠানো হয়।
গত শনিবার (২০ আগস্ট) বিষ্ণু প্রসাদ চক্রবর্ত্তী প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএসএমএমইউতে ২২ দিন ভর্তি ছিলাম। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছিল। কিন্তু অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি। এরপর আমি ভারতের হায়দরাবাদ ও বেঙ্গালুরুর দুটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিই। আমি এখনো সুস্থ হয়ে উঠতে পারিনি।’
বিষ্ণু প্রসাদ চক্রবর্ত্তীর চিকিৎসায় গঠিত কমিটির প্রধান ছিলেন বিএসএমএমইউয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সোহেল মোহাম্মদ আরাফাত। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অন্যান্য টিকার মতো করোনার টিকারও কিছু মানুষের ক্ষেত্রে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে, দেখা দিয়েছে। অ্যালার্জিজনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেকের প্রভাব পড়ে স্নায়ুতন্ত্রে।’
দেশে এ পর্যন্ত ১২ কোটি ৯৮ লাখ মানুষকে করোনা টিকার প্রথম ডোজ এবং ১২ কোটি ১০ লাখ মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। আর তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ দেওয়া হয়েছে ৪ কোটি ২৫ লাখ মানুষকে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনা টিকার গুরুতর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার তথ্য তেমন নেই। মৃদু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে।
যেমন টিকা দেওয়ার পর জ্বর, টিকা দেওয়ার স্থানে ব্যথা বা সারা শরীরে ব্যথা। তীব্র পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার যে দু–একটি খবর পাওয়া গেছে, পরে সেগুলো অনুসন্ধান করা হয়। এতে দেখা গেছে, এর সঙ্গে টিকার সরাসরি যোগসূত্র পাওয়া যায়নি।’