করোনার ঢেউ কি তবে বিদায়ের পথে

করোনা টিকা
ফাইল ছবি

দেশের মহামারিবিশেষজ্ঞ ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা গত জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে বলেছিলেন, করোনা পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে, তা ওই সপ্তাহে স্পষ্ট হতে পারে। এর ঢেউ শেষের পথে কি না, তারও নির্ণায়ক হয়ে উঠেছিল সপ্তাহটি। দেখা গেছে, জুলাইয়ের বিশেষ ওই সপ্তাহজুড়ে করোনা শনাক্ত তার আগের সপ্তাহের চেয়ে প্রায় ৩৬ শতাংশ কম হয়েছে। এখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর বড় ধরনের সংক্রমণের আশঙ্কা নেই।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে গতকাল সোমবার বলেন, ‘এবারের ঢেউ শেষের পথে আছে বলে মনে হয়। এ ঢেউয়ের উচ্চতা ছোট ছিল। কিন্তু যে হারে উঠেছিল, নেমেছে তার চেয়ে কম সময়ে। বড় ধরনের সংক্রমণের আশঙ্কা আর করছি না।’

বাংলাদেশে এযাবৎ করোনার যে পাঁচটি ঢেউ গেছে, তার মধ্যে চলতি বা পঞ্চম এ ঢেউই অপেক্ষাকৃত কম সময়জুড়ে ছিল। এর পেছনে কয়েকটি উদ্যোগ কাজ করেছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এবারের ঢেউ আকারে ছোট হলেও নতুন কোনো ঢেউয়ের আশঙ্কা উড়িয়ে দেননি বিশেষজ্ঞরা।

করোনাভাইরাস

গতকাল পর্যন্ত দেশে ২০ লাখ ৫ হাজার ৬০৬ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন ১৯ লাখ ৪৩ হাজার ৪২১ জন। এ পর্যন্ত করোনায় মারা গেছেন ২৯ হাজার ২৯২ জন।

দেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হন। করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ মার্চ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গত জুন মাস থেকে করোনার অমিক্রন ধরনের দুই উপধরন বিএ৪৩ ও বিএ৫–এর প্রকোপে যে ঢেউ শুরু হয়েছিল, সেটি করোনার পঞ্চম ঢেউ। প্রথম ঢেউ ছিল ২০২০ সালের মার্চ থেকে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত। দ্বিতীয় ঢেউটি শুরু হয় ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এটি করোনার আলফা ধরন দিয়ে শুরু হয়ে বিটা দিয়ে শেষ হয়।

করোনার ডেলটা ধরন দিয়ে তৃতীয় ঢেউয়ের শুরু হয়েছিল ২০২১ সালের এপ্রিল মাস থেকে, এটি চলে জুলাই পর্যন্ত। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ থেকে চতুর্থ ঢেউ অমিক্রন ধরন দিয়ে শুরু হয়। এটি চলে এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আর জুন থেকে শুরু পঞ্চম ঢেউ এখন এর গতি একেবারে হারিয়ে ফেলেছে।

কয়েক সপ্তাহ ধরে সংক্রমণের নিম্নগতি জানান দিচ্ছে এবারের ঢেউয়ের নিঃশেষ হওয়ার লক্ষণ। তবে এ ঢেউ শুরুতে ছিল ভয়ানক। গত ২০ জুন থেকে ২৬ জুন পর্যন্ত দেশে করোনা মহামারির এ বছরের ২৫তম সপ্তাহে শনাক্ত আগের সপ্তাহের চেয়ে প্রায় ৩০০ শতাংশ বেড়ে যায়। পরের সপ্তাহে, অর্থাৎ ২৭ জুন থেকে ৩ জুলাই পর্যন্ত শনাক্ত আগের সপ্তাহের তুলনায় প্রায় ৫৩ শতাংশ বাড়ে। অবশ্য এর পরের সপ্তাহ থেকে কমতে থাকে। গত চার সপ্তাহে শনাক্তের হার আগের সপ্তাহ থেকে কমেছে। সর্বশেষ সপ্তাহে, অর্থাৎ ২৫ থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত এর আগের সপ্তাহের তুলনা শনাক্ত প্রায় ৩৬ শতাংশ কমেছে।

শনাক্ত বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছিল মৃত্যুর সংখ্যাও। এ বছরের ২৫তম সপ্তাহে (২০ থেকে ২৬ জুন) দেশে করোনায় মৃত্যু হয়েছিল ৯ জনের। পরের সপ্তাহেই এ সংখ্যা হয়েছিল ২২। এর পরের সপ্তাহে তা বেড়ে হয় ৩৮ জন। অবশ্য এর পর থেকে এ সংখ্যা কমতে থাকে। গত সপ্তাহে মৃত্যু কমে হয় ২৫।

জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমদ বলেন, ‘এবারের ঢেউ একেবারে শেষ হয়েছে বলব না। নতুন কোনো মিউটেশন হলে সংক্রমণ বাড়তে পারে। কিন্তু এটি নিশ্চিত করে বলা যায়, এ দফায় সংক্রমণ আর বেশি হবে না।’

এ দফায় বা করোনার পঞ্চম ঢেউয়ের সময় শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যাও আগের ঢেউগুলোর চেয়ে কম ছিল। যেমন করোনার চতুর্থ ঢেউ, অর্থাৎ চলতি বছরের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে অমিক্রন ধরনের প্রকোপে ৯৬৫ জনের মৃত্যু হয়। আর পঞ্চম ঢেউয়ে গত জুন ও জুলাই মাসে মোট মৃত্যু হয় ১৬০ জনের।
বে-নজির আহমদ এবং আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এস এম আলমগীর মনে করেন, ক্রমে ক্ষীয়মাণ পঞ্চম ঢেউয়ের প্রকোপ কম হওয়ার পেছনে প্রধান ঢাল হিসেবে কাজ করছে টিকা।

এ এস এম আলমগীর বলছিলেন, ‘সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে বড় অংশকে টিকা দেওয়া হয়ে গিয়েছে। টিকা করোনাকে আটকাতে পারবে না, কিন্তু এ থেকে সুরক্ষা দিতে পারবে এবং তা পেরেছে। বাংলাদেশ ব্যাপক টিকাকরণের ফল পেয়েছে।’
স্বাস্থ্য বিভাগ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের মানুষকে করোনার টিকা দেওয়া শুরু করে।

করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০২২ সালের জুনের মধ্যে কোনো দেশের মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশকে পূর্ণ দুই ডোজ টিকার আওতায় আনার কথা বলেছিল। জুন মাস শেষ হওয়ার আগেই বাংলাদেশ সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে জনসংখ্যার ৭৬ শতাংশ করোনার টিকার প্রথম ডোজ এবং ৭১ শতাংশ দ্বিতীয় ডোজ টিকা পেয়েছে। আর ২৩ শতাংশ পেয়েছে বুস্টার ডোজ।

বে-নজির আহমদ বলছিলেন, ‘টিকার ফলে এক প্রতিরক্ষাবলয় সৃষ্টি হয়েছে, যার সুফল আমরা পেয়েছি।’ তবে অধ্যাপক বে-নজিরের মতে, টিকার পাশাপাশি আরও দুটি বিষয় বাংলাদেশে এবারের ঢেউ কম হওয়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছে। সে দুটি হলো ব্যাপকসংখ্যক মানুষের মধ্যে সংক্রমণ। আর এর ফলে বিশাল জনগোষ্ঠীর মধ্যে অ্যান্টিবডি সৃষ্টি হয়েছে। আর দ্বিতীয়টি হলো বাংলাদেশের জনসংখ্যার ধরন। তিনি বলছিলেন, জনসংখ্যার বিপুলসংখ্যক তরুণ বয়সী। এই বয়সীরা আক্রান্ত হলেও তাঁদের হাসপাতালে যাওয়ার পরিমাণ কম দেখা গেছে।

গত বছরের জুন মাসে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এক গবেষণায় জানায়, রাজধানী ঢাকায় ৭১ শতাংশ ও চট্টগ্রামে ৫৫ শতাংশ মানুষের শরীরে করোনার অ্যান্টিবডি সৃষ্টি হয়েছে। ৩ হাজার ২২০ জনের মধ্যে পাঁচ মাসের গবেষণায় এ তথ্য উঠে আসে। গবেষণায় দেখা গেছে, বস্তির বাইরে, বস্তিসংলগ্ন এলাকার নিম্নমধ্যম আয়ের মানুষের তুলনায় করোনা অ্যান্টিবডি হার বস্তিতে বেশি।

নতুন ঢেউ কবে আসতে পারে

যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ সংক্রামক রোগবিশেষজ্ঞ অ্যান্থনি ফাউসি সম্প্রতি বলেছেন, তিনি প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মেয়াদ শেষ হলে চাকরি ছাড়বেন। তবে সে সময় পর্যন্ত করোনার প্রকোপ শেষ হবে বলে মনে করেন না তিনি। ফাউসি বলেন, ‘আমার মনে হয়, এটা (কোভিড) নিয়েই আমাদের চলতে হবে।’ দেশের বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, করোনা শেষ হবে না। আমরাও এর প্রকোপ থেকে মুক্ত হব না দ্রুত।

আমাদের দেশে এত টিকাকরণের পরও করোনার নতুন কোনো ঢেউ আসার শঙ্কা কীভাবে থাকে? এর উত্তরে জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলছিলেন, ‘বাংলাদেশ অনেক মানুষকে টিকা দিয়েছে। অনেক দেশই দিয়েছে। কিন্তু টিকাকরণ ব্যাপকভাবে করতে পারেনি—এমন অনেক দেশ এখনো আছে। বিশ্বের সব দেশে কাঙ্ক্ষিত টিকাদান না হলে আমরা ঝুঁকির মুখেই থাকব।’

জনস্বাস্থ্যবিদদের কথা, দেশে এখনো যাঁরা টিকার বাইরে আছেন, তাঁদের টিকা দিতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে ঔদাসীন্য দেখালে চলবে না। মুশতাক হোসেন মনে করেন, অনেক টিকাকরণ হওয়ার পরও চতুর্থ থেকে পঞ্চম ঢেউয়ের মধ্যে সময়ের বেশি ফারাক ছিল না। এর কারণ স্বাস্থ্যবিধিতে উপেক্ষা।

করোনার নতুন কোনো ধরনের বিস্তারের আশঙ্কাও ফেলে দেওয়া যায় না। এরই মধ্যে ভারতে বিএ.২.৭৫ নামে অমিক্রনের আরেকটি উপধরন দেখা গেছে। জাপান, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্রেও এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তবে এর সংক্রমণের হার মারাত্মক হিসেবে এখনো প্রমাণিত হয়নি বলে জানান ডা. মুশতাক হোসেন।

এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পাশাপাশি ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদের টিকা দেওয়া নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশ আরও সুরক্ষিত থাকবে বলে মনে করেন বে-নজির আহমদ। সরকার এ মাসেই ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদের টিকা দেওয়া শুরুর কথা বলেছে।