■ বর্তমানে পরীক্ষাকেন্দ্র আছে ২৬ জেলায়।
■ এখন দৈনিক ১১ থেকে ১৪ হাজার নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে।
■ দুই লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন এমন ২৩টি দেশের তালিকায় পরীক্ষার সংখ্যায় দ্বিতীয় বাংলাদেশ।
দেশে করোনা সংক্রমণের ছয় মাস পেরোলেও এখনো সব জেলায় নমুনা পরীক্ষাকেন্দ্র (ল্যাব) চালু করতে পারেনি সরকার। বর্তমানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় ২৬টি জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র চালু আছে। কিন্তু নমুনা পরীক্ষা এখনো পর্যন্ত যথেষ্ট নয়। ফলে জনসংখ্যা অনুপাতে পরীক্ষার দিক থেকে বেশ পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
জেলাভিত্তিক নমুনা পরীক্ষা এবং রোগী শনাক্তের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, করোনা পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে এমন জেলাগুলোতে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা বেশি। পরীক্ষাকেন্দ্র না থাকা ৩৮ জেলায় রোগী শনাক্তের পরিমাণ কম। এসব জেলায় নমুনা পরীক্ষার ফলাফল পেতেও সময় বেশি লাগছে। দূরের পরীক্ষাকেন্দ্রে পাঠানোর সময় অনেক ক্ষেত্রে নমুনা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সরকারের করোনাবিষয়ক পুরো কার্যক্রমেই একটা গাছাড়া, ঢিলেঢালাভাব দেখা যাচ্ছে। পর্যাপ্ত সময় পাওয়ার পরও জেলা পর্যায়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু করেনি। পরীক্ষা কম হওয়ায় সন্দেহভাজন অনেক রোগী শনাক্ত করা যাচ্ছে না।অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
করোনা মহামারির শুরু থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে আসছে, করোনার সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক শর্ত রোগী শনাক্ত করা। পরীক্ষা যত বেশি হবে আক্রান্ত ব্যক্তিও তত বেশি শনাক্ত হবে। রোগী শনাক্ত হলে এবং এরপরের ধাপগুলো ট্রেসিং (আক্রান্তের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা), কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) ও আইসোলেশন (বিচ্ছিন্ন থাকা) যথাযথভাবে পালন করা হলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। কিন্তু দেশে নমুনা পরীক্ষা কম হওয়ায় সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের করোনাবিষয়ক পুরো কার্যক্রমেই একটা গাছাড়া, ঢিলেঢালাভাব দেখা যাচ্ছে। পর্যাপ্ত সময় পাওয়ার পরও জেলা পর্যায়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু করেনি। পরামর্শক কমিটি পরীক্ষা বাড়ানোর সুপারিশ করলেও পরীক্ষার সংখ্যা কমানো হয়েছে। পরীক্ষা কম হওয়ায় সন্দেহভাজন অনেক রোগী শনাক্ত করা যাচ্ছে না।
সব জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র চালুর ঘোষণা দিলেও তা কার্যকর হয়নি। জনসংখ্যা অনুপাতে পরীক্ষার দিক থেকে বেশ পিছিয়েছে বাংলাদেশ।
ঢাকাসহ দেশের ২৬টি জেলায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় করোনা শনাক্তকরণের পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও সেটি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। অবশ্য টাঙ্গাইলে করোনা পরীক্ষা শুরু হলেও সেখানে আরটিপিসিআর যন্ত্র নেই। টাঙ্গাইল বক্ষব্যাধি ক্লিনিকে যক্ষ্মা শনাক্তে ব্যবহৃত সিবি ন্যাট পরীক্ষার মাধ্যমে করোনার পরীক্ষা করা হচ্ছে। সেখানে দিনে সর্বোচ্চ ২০টি পরীক্ষা করা যায়।
ঢাকা বিভাগের ১৩ জেলার মধ্যে ঢাকা বাদে ৫ জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। নারায়ণগঞ্জে দুটি ও গাজীপুরে চারটি কেন্দ্র রয়েছে। কিশোরগঞ্জ ও ফরিদপুরে একটি করে পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। চট্টগ্রাম জেলায় রয়েছে ৬টি পরীক্ষাকেন্দ্র। চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জেলার মধ্যে চট্টগ্রাম ছাড়া ৭টি জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে।
ঠাকুরগাঁওয়ে করোনা পরীক্ষাকেন্দ্র চালু করতে বহুবার অনুরোধ জানানো হয়েছে। জেলায় করোনা পরীক্ষাকেন্দ্র থাকলে অনেক সুবিধা। এখন নমুনা দিনাজপুরে পাঠানোয় ফলাফল পেতে দেরি হয়। জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র থাকলে ফলাফল দ্রুত দেওয়া যেতমাহফুজার রহমান সরকার, ঠাকুরগাঁওয়ের সিভিল সার্জন
উত্তরবঙ্গের পাশাপাশি দুই জেলা দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও। গতকাল পর্যন্ত ঠাকুরগাঁওয়ে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৯৯২ জনের। জেলায় করোনা পরীক্ষার কেন্দ্র নেই। এই জেলার নমুনা পাঠানো হয় দিনাজপুরের এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। দিনাজপুরে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৩ হাজার ১৭৯ জনের।
ঠাকুরগাঁওয়ের সিভিল সার্জন মাহফুজার রহমান সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ঠাকুরগাঁওয়ে করোনা পরীক্ষাকেন্দ্র চালু করতে বহুবার অনুরোধ জানানো হয়েছে। জেলায় করোনা পরীক্ষাকেন্দ্র থাকলে অনেক সুবিধা। এখন নমুনা দিনাজপুরে পাঠানোয় ফলাফল পেতে দেরি হয়। জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র থাকলে ফলাফল দ্রুত দেওয়া যেত।
খুলনা বিভাগের ১০ জেলার মধ্যে খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া ও নড়াইলে পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। সিলেট বিভাগের দুটি পরীক্ষাকেন্দ্রই সিলেট জেলায় অবস্থিত। রংপুর বিভাগের ৮ জেলার মধ্যে রংপুর ও দিনাজপুরে পরীক্ষাকেন্দ্র আছে। রাজশাহী বিভাগের রাজশাহী ও বগুড়ায় দুটি করে এবং সিরাজগঞ্জে একটি পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। ময়মনসিংহ বিভাগে ময়মনসিংহ ও জামালপুরে পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। বরিশাল বিভাগের ৬ জেলার জন্য বরিশাল ও ভোলায় পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে।
বেশ কিছু কারণে জেলা পর্যায়ে করোনা পরীক্ষাকেন্দ্র চালু করা যায়নি। করোনার অ্যান্টিজেন টেস্ট কিটের কার্যকারিতা পরীক্ষা করছে আইইডিসিআর। যেসব জেলার করোনা পরীক্ষাকেন্দ্র নেই, সেগুলোতে দ্রুত অ্যান্টিজেন পরীক্ষা চালু করা হবে। যেসব জেলায় আরটিপিআর যন্ত্র রয়েছে, সেখানেও অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবেআবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক
গত ১৮ জুন করোনাবিষয়ক নিয়মিত বুলেটিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানিয়েছিলেন, যত দ্রুত সম্ভব সরকারি ব্যবস্থাপনায় জেলা পর্যায়ে আরটিপিসিআর পরীক্ষা শুরু হবে। সেদিন দেশের ৪৩ জেলায় করোনা পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল না। এরপর আড়াই মাসের বেশি সময় পার হলেও নতুন করে মাত্র ৫ জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র চালু হয়েছে।
পরীক্ষাকেন্দ্র চালু না হওয়ার বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, বেশ কিছু কারণে জেলা পর্যায়ে করোনা পরীক্ষাকেন্দ্র চালু করা যায়নি। করোনার অ্যান্টিজেন টেস্ট কিটের কার্যকারিতা পরীক্ষা করছে আইইডিসিআর। যেসব জেলার করোনা পরীক্ষাকেন্দ্র নেই, সেগুলোতে দ্রুত অ্যান্টিজেন পরীক্ষা চালু করা হবে। যেসব জেলায় আরটিপিআর যন্ত্র রয়েছে, সেখানেও অ্যান্টিজেন পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা অনেক দিন ধরেই দেশে দৈনিক কমপক্ষে ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করার কথা বলছেন। জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা শুরু করে। জুন মাসে দৈনিক ১৭ থেকে ১৮ হাজার নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। কিন্তু গত ৩ জুলাই থেকে সরকারের নিয়ন্ত্রণমূলক সিদ্ধান্তের কারণে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কমতে থাকে। এখন দৈনিক ১১ থেকে ১৪ হাজার নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে।
পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারস শুরু থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের করোনাবিষয়ক হালনাগাদ তথ্য দিয়ে আসছে। গতকাল সন্ধ্যা ছয়টার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশসহ ২৩টি দেশে দুই লক্ষাধিক কোভিড-১৯ শনাক্ত রোগী রয়েছে। আক্রান্তের এই শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম পরীক্ষার দিক থেকে দ্বিতীয় বাংলাদেশ। দেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে ১০ হাজার ৫৯ জনের পরীক্ষা হয়েছে।