প্রথম ডোজ পাওয়া অনেকে আপাতত দ্বিতীয় ডোজ টিকা পাবেন না। এতে টিকাব্যবস্থার ওপর আস্থা হারানোর আশঙ্কা আছে।
সরকার প্রথম ডোজের টিকা দেওয়া বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে প্রথম ডোজ নেওয়া ১৩ লাখ মানুষের দ্বিতীয় ডোজের টিকাও। এর মধ্য দিয়ে করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় দেশে গণটিকাদান শুরু হওয়ার সাড়ে তিন মাসের মাথায় টিকা কর্মসূচি কিছুটা এলোমেলো হতে দেখা যাচ্ছে।
পর্যবেক্ষক মহল ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করেন, ভারত থেকে পাওয়া টিকার মজুত ফুরিয়ে আসার পাশাপাশি আমদানি ও সংগ্রহ অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তাঁরা বলছেন, সরকার টিকার জন্য ভারতের ওপর বেশি নির্ভরতা দেখিয়েছে। সরকার বিকল্প উৎসের ব্যাপারে কম মনোযোগী ছিল। টিকা ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিকল্পনার ঘাটতিও রয়েছে। দ্বিতীয় ডোজের টিকা কম পড়ার ঝুঁকি অনেক আগে ধরা পড়লেও সরকার প্রথম ডোজ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিলম্বে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছে, আজ সোমবার থেকে সারা দেশে প্রথম ডোজের টিকা দেওয়া বন্ধ থাকবে। গতকাল দুপুরে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির পক্ষ থেকে দেশের সব সিভিল সার্জন, সব সিটি করপোরেশনের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং সব উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তাদের চিঠি দিয়ে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া সাময়িকভাবে বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। এ পর্যন্ত যাঁরা নিবন্ধন করেছেন, তাঁদের সবাই প্রথম ডোজ টিকা পাবেন না। তবে নিবন্ধন বন্ধ থাকার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম।
মহামারি মোকাবিলায় বিশ্বব্যাপী টিকা ব্যবহার শুরু হওয়ার আগে থেকে টিকা উৎপাদন ও সরবরাহে সম্ভাব্য সংকটের বিষয়টি আলোচনায় ছিল। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সর্বশেষ টিকা পরিস্থিতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান সায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘টিকা দেওয়া হচ্ছে বিশ্বের এমন প্রতিটি দেশে দ্বিতীয় ডোজ নিশ্চিত করেই প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বড় ধরনের ব্যত্যয় দেখা দিতে যাচ্ছে। দ্বিতীয় ডোজ টিকা না পেলে বেশ কয়েক লাখ মানুষ বঞ্চনাবোধে ভুগবেন।’
গতকাল সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর টিকার যে তথ্য গণমাধ্যমে পাঠিয়েছে, তাতে দেখা যায়, প্রথম ও দ্বিতীয় মিলে মোট ৮১ লাখ ৪৫ হাজার ২৬৬ ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। অধিদপ্তরের হাতে ২১ লাখ ৫৪ হাজার ৭৩৪ ডোজ টিকা মজুত আছে। নতুন করে অক্সফোর্ডের টিকার চালান না এলে ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৮০০ মানুষকে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া যাবে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে কোভ্যাক্স থেকে ফাইজারের এক লাখ টিকা পাওয়া যাবে। এ ছাড়া দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার ক্ষেত্রে যে ২০ লাখ টিকার মতো ঘাটতি আছে, তা–ও পাওয়া যাবে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আশা করছে।
অবশ্য গতকাল রোববার বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনৈতিক সূত্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের কাছ থেকে অক্সফোর্ডের টিকার পরের চালান কবে আসছে, তা নিশ্চিত নয়।
যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত ও ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত টিকা কোভিশিল্ড বাংলাদেশে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রথম ডোজ দেওয়ার ১২ সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হলে এ টিকার সর্বোচ্চ কার্যকারিতা দেখা গেছে। কিন্তু বাংলাদেশ শুরুতে ১২ সপ্তাহকে আমলে নেয়নি।
দেশে গণটিকাদান শুরু হয় ৭ ফেব্রুয়ারি। এর আগের দিন ৬ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, টিকাদান কর্মসূচি বাস্তবায়নের সুবিধার্থে চার সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে।
কিছুদিন পর দুই ডোজের মধ্যে চার সপ্তাহ সময়সীমা থেকে সরে আসে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার কথা বলা হয় আট সপ্তাহ পর। সেই হিসাবে ৮ এপ্রিল থেকে দ্বিতীয় ডোজ টিকা দেওয়া শুরু হয়। একই সঙ্গে চলতে থাকে প্রথম ডোজ দেওয়া।
এরই মধ্যে প্রথম ডোজের টিকা নিয়েছেন ৫৮ লাখ ১৮ হাজার ৪০০ জন। তাঁদের মধ্যে দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ২৩ লাখ ২৬ হাজার ৮৬৬ জন। আজ থেকে প্রথম ডোজ দেওয়া বন্ধ হওয়ায় আপাতত টিকার বাইরে থাকছেন নিবন্ধিত ১৪ লাখের বেশি মানুষ। আর ১৩ লাখ ৩৬ হাজার ৮০০ জনের দ্বিতীয় ডোজ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয় ডোজ সময়মতো না পেলে কী হবে, প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ দুই কোম্পানির টিকা হলে কোনো সমস্যা হবে কি না, এ নিয়ে মানুষের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়ে গেছে।
গতকাল দুপুরে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, এখন আট সপ্তাহ পরে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হচ্ছে। ১২ সপ্তাহ পরে দ্বিতীয় ডোজ দিলে লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। সুতরাং সরকার লাভের পথেই যাবে। তাহলে টিকা সংগ্রহের বাড়তি এক মাস সময় পাবে বাংলাদেশ।
সময়মতো ভারত থেকে টিকা না আসার কারণে সাধারণ মানুষ ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে নানা ধরনের সন্দেহ ও প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। সরকার যদি রাশিয়া বা চীনের টিকা আমদানি করে, তাহলে কি সেই টিকা দ্বিতীয় ডোজ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে? এখানে সমস্যা দুই ধরনের। প্রথমত দুই কোম্পানির টিকার দুই ডোজ নিয়ে সুফল ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বিষয়ে বৈশ্বিক কোনো গবেষণা এখনো বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কাছে নেই। অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, ‘এ বিষয়ে কোনো পরীক্ষিত ফলাফল নেই। সুতরাং দুই কোম্পানির দুই ডোজ দেওয়া হবে ঝুঁকিপূর্ণ।’
দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পর গ্রহীতাকে একটি সনদ দেওয়া হচ্ছে। কোন প্রতিষ্ঠানের টিকা দেওয়া হয়েছে তার উল্লেখ থাকছে সনদে। আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ক্ষেত্রে এ সনদ প্রয়োজনীয় দলিল হয়ে উঠছে। সে ক্ষেত্রে দুটি প্রতিষ্ঠানের দুই ডোজ দেওয়া হলে তা আন্তর্জাতিকভাবে কতটা গ্রহণযোগ্যতা পাবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়।
অন্য বিষয়টি আস্থার। সময়মতো দ্বিতীয় ডোজ না পেলে বা দুটি ডোজ একই কোম্পানির না হলে মানুষের আস্থায় চিড় ধরার আশঙ্কা আছে। জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে–নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দ্বিতীয় ডোজ দিতে না পারার বিষয়টি সরকারের পরিকল্পনার ব্যর্থতা বলে গণ্য হবে। আর যাঁরা দ্বিতীয় ডোজ পেলেন না, তাঁদের মন খারাপ হবে। তাঁদের সুরক্ষার বিষয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।’