তখনো চলছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এরই মধ্যে পুরো পৃথিবী আরেক মহাবিপদে পড়েছিল। তা হলো মহামারি। নাম তার স্প্যানিশ ফ্লু।
স্প্যানিশ ফ্লুর উৎপত্তিস্থল নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। কেউ কেউ আঙুল তোলেন চীনের দিকে। তবে সে ব্যাপারে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়া যায় না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সেই সময়ে সংঘাত-বিক্ষুব্ধ পৃথিবীতে এমন রোগ নিয়ন্ত্রণ করা ছিল অত্যন্ত কঠিন।
১৯১৮ সালের শুরুর দিকে এই ফ্লু উত্তর আমেরিকায় দেখা দেয়। পরে তা ইউরোপে ছড়ায়। স্পেনের মাদ্রিদে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর এর নাম হয় ‘স্প্যানিশ ফ্লু’। এই মহামারিতে বিশ্বব্যাপী প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। বিশ্বব্যাপী আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫০ কোটি। ১৯১৯ সালের গ্রীষ্মে এই রোগের প্রকোপ কমে আসে।
এবার আসুন জেনে নেওয়া যাক এই ফ্লু জয় করা কয়েকজন বিখ্যাত ব্যক্তির কথা:
ওয়াল্ট ডিজনি (১৯০১-৬৬)
ডিজনি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ওয়াল্ট ডিজনির নাম শোনেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। মিকি মাউসের এই জনক আক্রান্ত হয়েছিলেন স্প্যানিশ ফ্লুতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে রেডক্রস অ্যাম্বুলেন্স কোরের সদস্য হতে জোর চেষ্টা করেছিলেন ওয়াল্ট ডিজনি। কিন্তু কোরের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। স্প্যানিশ ফ্লু জেঁকে ধরে। পরে ধীরে ধীরে সুস্থও হয়ে উঠেছিলেন ডিজনি। কিন্তু রেডক্রস অ্যাম্বুলেন্স কোরে আর তাঁর যাওয়া হয়নি। তত দিনে যুদ্ধ শেষ হয়ে গিয়েছিল।
মেরি পিকফোর্ড (১৮৯২-১৯৭৯)
নির্বাক যুগের সিনেমাজগতের তারা ছিলেন মেরি। স্প্যানিশ ফ্লুতে যখন তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন, তখন মেরি ছিলেন খ্যাতির শীর্ষে। তবে এই রোগে মেরির শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হয়নি। বরং দ্রুততম সময়ের মধ্যেই সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। কিন্তু স্প্যানিশ ফ্লুর কারণে সিনেমা প্রদর্শনী বা থিয়েটার ব্যবসা মারাত্মক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছিল। রোগ ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে সিনেমা হলগুলোতে ছবি প্রদর্শন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
ডেভিড লয়েড জর্জ (১৮৬৩-১৯৪৫)
করোনা মহামারিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন যুক্তরাজ্যের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। এটি পুরোনো খবর। এরই মধ্যে সেরে উঠে আবার সরকারি কাজে ফিরেছেন বরিস। তবে বরিসের আগেও আরেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী মহামারির কবলে পড়েছিলেন। তাঁর নাম ডেভিড লয়েড জর্জ। স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে জর্জের অবস্থা সঙিন হয়ে পড়েছিল। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। প্রায় ৯ দিন শয্যাশায়ী ছিলেন ডেভিড। এক মাসের বেশি সময় ধরে চিকিৎসকদের সার্বক্ষণিক সহযোগিতা নিতে হয়েছিল তাঁকে। তবে তিনি সুস্থ হওয়ার আগপর্যন্ত এই সব খবর গোপন রাখা হয়েছিল। আশঙ্কা করা হয়েছিল যে প্রধানমন্ত্রীর অসুস্থ হওয়ার খবরে সাধারণ মানুষের মনোবল টুটে যেতে পারে। ডেভিড লয়েড জর্জ স্প্যানিশ ফ্লু জয় করার পরই সব তথ্য প্রকাশ্যে আসে।
ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট (১৮৮২-১৯৪৫)
১৯১৮ সালে নৌবাহিনীর সহকারী সচিব হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট। স্প্যানিশ ফ্লুর সময় প্রায় দুই মাস যাবৎ ইউরোপে ছিলেন তিনি। স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে রুজভেল্টের নিউমোনিয়া হয়েছিল। অসুস্থতার মাত্রা খুব বেশি ছিল না। নিউইয়র্কে মায়ের বাসায় থেকেই তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। সেরে ওঠার পরপরই ওয়াশিংটন ডিসিতে সরকারি কাজেও তিনি যোগ দিয়েছিলেন।
এডভার্ড মুংখ (১৮৬৩-১৯৪৪)
নরওয়ের এই বিখ্যাত চিত্রশিল্পী ১৯১৮ সালের স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। ‘দ্য স্ক্রিম’, ‘ম্যাডোনা’, ‘ভ্যাম্পায়ার’, ‘দ্য ড্যান্স অব লাইফ’ প্রভৃতি চিত্রকর্মের জন্য খ্যাতিমান তিনি। এডভার্ড মুংখ ১৯১৯ সালের শুরুর দিকে এ রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ হওয়ার পরই তিনি আঁকতে বসে গিয়েছিলেন। ওই সময়টায় নিজের আত্মপ্রতিকৃতি আঁকায় মনোযোগ দিয়েছিলেন মুংখ। তখনকার ছবিগুলোতে মুংখকে দেখা গিয়েছিল কৃশকায়রূপে। পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আগপর্যন্ত এভাবে ছবি আঁকা চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। অবশেষে একপর্যায়ে তিনি পরিপূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন।
উড্রো উইলসন (১৮৬৫-১৯২৪)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ওই সময়টায় আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন উড্রো উইলসন। যুদ্ধের অবসানেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ১৯১৯ সালের শুরুর দিকে স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন উড্রো উইলসন। এতটাই যে তাঁর চিকিৎসকেরা ভাবতে শুরু করেছিলেন যে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে হয়তো বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে! তবে বেশ ভোগার পর একসময় তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ অবসানে প্রয়োজনীয় ভূমিকাও পালন করেছিলেন।
তথ্যসূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, মেন্টাল ফ্লস, হিস্টরি ডট কম ও দ্য টেলিগ্রাফ