বিশ্বব্যাপী করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ৫৬ লাখ ১১ হাজার ৫৪০। সংখ্যাটি অফিশিয়াল। এটি প্রতিটি দেশের সরকার কর্তৃক ঘোষিত সংখ্যার বৈশ্বিক যোগফল। তবে সাধারণ মানুষ ও বিশেষজ্ঞদের ধারণা, করোনায় মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা ‘অনেক বেশি’।
এই ‘অনেক বেশি’ নিয়ে কাজ করা গবেষণার জন্য জটিল চ্যালেঞ্জ। সরকারগুলো যে সংখ্যা দিচ্ছে, তা যে প্রকৃত সংখ্যা নয়, এর একাধিক প্রমাণ এখন বিজ্ঞানী, গবেষক ও সাংবাদিকদের হাতে আছে। কিছু ক্ষেত্রে এটাও ঠিক, সরকার জেনেবুঝে মিথ্যা বা ভুল তথ্য দিচ্ছে না। পদ্ধতিগত কারণে মৃত্যুর পরিসংখ্যানে ত্রুটি থেকে যাচ্ছে। যেমন বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যুর একটি সরকারি পরিসংখ্যান আছে। কিন্তু করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান নেই। করোনায় মৃত্যু এবং করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর পার্থক্য এখনো মানুষের কাছে পরিষ্কার নয়।
২০ জানুয়ারি বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার করোনায় মৃত্যু নিয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য বেশ কয়েকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান মৃত্যুর যে সংখ্যা প্রকাশ করেছে, নিবন্ধে তা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো মৃত্যুর সংখ্যা পেতে কী পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল, তারও বর্ণনা আছে। সঠিক সংখ্যা পেতে কোনো পদ্ধতিই যে ত্রুটিমুক্ত নয়, সে কথাও নিবন্ধে আছে। নেচার বলছে, বিশ্বের প্রায় ১০০টি দেশ করোনায় মৃত্যুর সঠিক বা নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে না।
জনমিতিবিদ, উপাত্তবিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মহামারির শুরু থেকেই করোনায় মৃত্যুর ঠিক তথ্য জানার চেষ্টা করে আসছেন। গবেষক ও সাংবাদিকেরাও একই কাজ করে চলেছেন। তাঁদের প্রধান তিনটি পদ্ধতি অনুসরণ করতে দেখা গেছে: কবরস্থানের স্যাটেলাইট চিত্র তাঁরা বিশ্লেষণ করেছেন। কেউ কেউ বাড়ি বাড়ি ঘুরে মৃত্যুর তথ্য সংগ্রহ করেছেন। অনেকে কম্পিউটার মডেলিংয়ের মাধ্যমে সংখ্যা জানার চেষ্টা করেছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও প্রাত্যহিক ঘোষিত সংখ্যার বাইরে আরও একটি অনুমিত মৃত্যুর সংখ্যা বের করার চেষ্টায় আছে।
অফিশিয়াল সংখ্যাটি জানা আছে। প্রতিদিন তা হালনাগাদ করা হচ্ছে। বৈশ্বিক মৃত্যুর একটি সংখ্যা দিয়েছে লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী ইকোনমিস্ট। কম্পিউটারে নানা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তারা বলছে, করোনায় ১ কোটি ২০ লাখ থেকে ২ কোটি ২০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তাদের সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ সংখ্যার মধ্যে পার্থক্য ১ কোটি।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ ম্যাট্রিকস অ্যান্ড ইভাল্যুশন মডেলিং করে বলছে, করোনায় ৯০ লাখ থেকে ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ সংখ্যার মধ্যে পার্থক্য ৯০ লাখ।
এসব পরিসংখ্যান থেকে মডেলিংয়ের কিছু সমস্যাই স্পষ্ট হয়। যেমন ইকোনমিস্ট বলছে, করোনায় জাপানে অনুমিত মৃত্যুর সংখ্যা ৫৫০ থেকে ২৭ হাজার। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠানটি বলছে, জাপানে অনুমিত মৃত্যুর সংখ্যা ৭১ হাজার। মানুষ কোনটাকে গ্রহণ করবে, কোন যুক্তিতে করবে। ওই সময় জাপানের অফিশিয়াল মৃত্যুর সংখ্যা ১৮ হাজার ছিল।
গত বছর মে মাসে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্রে অনুমিত মৃত্যুর সংখ্যা বলেছিল প্রায় ৯ লাখ। এই সংখ্যা ছিল সে দেশের সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) অনুমিত সংখ্যার চেয়ে প্রায় ৩ লাখ বেশি। পরে অবশ্য ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠানটি তাদের অবস্থান থেকে সরে আসে।
যন্ত্র বা কম্পিউটারের মাধ্যমে পাওয়া এসব সংখ্যার বাইরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কবরস্থানের তথ্য বিশ্লেষণ করে মৃত্যুর সংখ্যা নির্ণয়ের চেষ্টা দেখা গেছে। আবার মহামারির শুরুর আগের এক বছরে একটি দেশের মোট মৃত্যু এবং মহামারির বছরে মোট মৃত্যুর যোগ-বিয়োগ-গুণ-ভাগ করে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা বের করার প্রচেষ্টাও আছে। যেসব দেশে ঠিকভাবে ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন হয়, অর্থাৎ জন্ম-মৃত্যুসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত ঠিকভাবে রাখা হয়, সেখানে মৃত্যুর হিসাব বের করা যায়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে ঠিকভাবে ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন হয় না, এ কথাও নিবন্ধে আছে। ভারতের ১০টি প্রদেশের স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানের মৃত্যুর তথ্য ও সিভিল-রেজিস্ট্রেশনের মৃত্যুর তথ্যের ভিত্তিতে গত বছর একদল গবেষক বলেছিলেন, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতে করোনায় মৃত্যু হয়েছিল সরকার যা বলেছিল তার চেয়ে ৬ থেকে ৭ গুণ বেশি।
লন্ডন স্কুল অব হাইজিন অ্যান্ড ট্রপিক্যাল মেডিসিনের গবেষকেরা ইয়েমেনের এডেন প্রদেশের ১১টি কবরস্থানের প্রতিচ্ছবি উপগ্রহের মাধ্যমে সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁরা দেখেছিলেন, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ওই সব কবরস্থানে কবর দেওয়া বেড়েছিল ২৩০ শতাংশ। তবে গবেষকেরা বলছেন, সবাই যে কবরস্থানে কবর দেয়, তাও নয়।
মৃত্যুর সংখ্যা অনুসন্ধানের প্রায় প্রতিটি পদ্ধতি বলছে, মৃত্যু বেশি হয়েছে। কিন্তু ঠিক সংখ্যাটি বলা যাচ্ছে না। ঠিক সংখ্যা হয়তো কখনোই বলা যাবে না।