টিকা দেওয়ায় বাংলাদেশের সক্ষমতার খ্যাতি আছে। তবে সেই সক্ষমতা কাজে লাগাতে পারছে না স্বাস্থ্য বিভাগ।
করোনার টিকা দেওয়া হচ্ছে ধীর গতিতে। ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে টিকা দেওয়ার যে সক্ষমতা বাংলাদেশের আছে, তা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না স্বাস্থ্য বিভাগ। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, বেশি মানুষকে টিকার আওতায় আনতে দৈনিক টিকা দেওয়ার পরিমাণ বাড়াতে হবে।
দেশে ৭ ফেব্রুয়ারি গণটিকাকরণ শুরু হওয়ার পর থেকে ১৩৫ দিন টিকা দেওয়া হয়েছে। চার ধরনের টিকার প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলে এ পর্যন্ত মোট ১ কোটি ১৮ লাখের বেশি ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ দৈনিক গড়ে ৮৭ হাজার ডোজ টিকা মানুষ পেয়েছে।
টিকা দেওয়ার সঙ্গে টিকার মজুতের সম্পর্ক আছে। দৈনিক বেশি টিকা না দেওয়ার একটি কারণ, পর্যাপ্ত টিকা না থাকা। তবে বর্তমানে সিনোফার্ম ও মডার্নার টিকা হাতে থাকা সত্ত্বেও দৈনিক টিকাদানের পরিমাণ কম।
গতকাল রোববার সারা দেশে দুই লাখের বেশি মানুষকে প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ১৯৪ জনকে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) কর্মকর্তারা বলছেন, একসঙ্গে বেশি টিকা হাতে এলে টিকাদানের গতি বাড়ানো হবে। ইউনিয়ন বা তার নিচের স্তরের এলাকায় টিকাকেন্দ্র স্থাপনের কথা ভাবা হচ্ছে।
সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির আওতায় সারা দেশের শহরে ও গ্রামে ১ লাখ ২০ হাজার স্থায়ী টিকাকেন্দ্র আছে। হাম-রুবেলা বা অন্য কোনো টিকার বিশেষ প্রচারণার সময় এসব কেন্দ্র থেকে এক দিনে প্রায় ২ কোটি শিশুকে টিকা দেওয়া হয়।
করোনার টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকায় কিছু শর্ত সাপেক্ষে টিকাকেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত হয়। টিকা নেওয়ার পর হঠাৎ কোনো তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে তা সামাল দেওয়ার ব্যবস্থা সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রেই থাকতে হবে। দ্বিতীয়ত কোনো কোনো টিকা তীব্র শীতল তাপমাত্রায় সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা থাকায় গ্রামাঞ্চলে টিকাকেন্দ্র স্থাপন থেকে বিরত থাকে সরকার।
শুরু থেকে মহানগর, জেলা সদর ও উপজেলা পর্যায়ের ১ হাজার ৫টি কেন্দ্রে করোনার টিকা দেওয়া হচ্ছে। কোনো কেন্দ্রে একাধিক বুথ আছে। প্রতিটি বুথে দিনে অন্তত ১৫০ ডোজ দেওয়ার সক্ষমতা আছে। সকাল ৮টা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত টিকা দেওয়া হয়। গণটিকাকরণ শুরুর আগের দিন সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, দৈনিক ৩ লাখ ৬০ হাজার মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে তাঁরা মাঠে নামছেন। এ পর্যন্ত কোনো দিন সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।
* এ পর্যন্ত দেশে টিকা এসেছে ২ কোটি ১৫ লাখ ৪৫ হাজার ডোজ * গতকাল পর্যন্ত নিবন্ধন করেছেন ১ কোটি ২১ লাখ ৭০ হাজার ৪৪৫ জন * টিকার প্রথম ডোজ পেয়েছেন ৭৫ লাখ ৬০ হাজার ৩৭২ জন * টিকার দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন ৪৩ লাখ ৫ হাজার ৯৬৫ জন
ইপিআইয়ের মতো টিকাদানের অভিজ্ঞতা না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র এক দিনে ৩০ লাখ মানুষকে টিকা দিতে পেরেছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত এক দিনে ৮০ লাখ মানুষকে টিকা দিয়েছে—এমন খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের মতো না পারলেও আমাদের দিনে ১০ থেকে ১৫ লাখ মানুষকে টিকা দিতে হবে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে অল্প সময়ে বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া দরকার।’
দেশে এ পর্যন্ত টিকা এসেছে ২ কোটি ১২ লাখ ৪৫ হাজার। এর মধ্যে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ১ কোটি ৫ লাখ ৪৫ হাজার, ফাইজারের ১ লাখ, সিনোফার্মের ৫১ লাখ এবং মডার্নার ৫৫ লাখ।
প্রথম দফায় আসা ১ কোটি ৩ লাখ ডোজের মজুত শেষ হওয়ার পর অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা দেওয়া আপাতত বন্ধ আছে। প্রথম ডোজ পাওয়া ১৫ লাখের বেশি মানুষ দ্বিতীয় ডোজের অপেক্ষায় আছেন। গত পরশু আসা ২ লাখ ৪৫ হাজার টিকা শুধু ঢাকা বিভাগের বিভিন্ন কেন্দ্রে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
১ লাখ ফাইজারের টিকা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রবাসী শ্রমিকদের দেওয়া হচ্ছে। এই টিকার অর্ধেক শেষ। এখন দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া শুরু হয়েছে।
১২টি সিটি করপোরেশন ছাড়া দেশের অন্য সব জেলা শহর ও উপজেলা পর্যায়ে চীনের সিনোফার্মের টিকা দেওয়া হচ্ছে। এ পর্যন্ত টিকা দেওয়া হয়েছে ১২ লাখের বেশি মানুষকে।
মডার্নার টিকা দেওয়া হচ্ছে দেশের ১২টি সিটি করপোরেশন এলাকায়। এ পর্যন্ত ৩ লাখ ৬৩ হাজার ৯০৪ মানুষকে এই টিকা দেওয়া হয়েছে। এই টিকার মজুত আছে ৫০ লাখের বেশি। কিন্তু দৈনিক এই টিকা দেওয়ার পরিমাণ কম। গতকাল দেওয়া হয়েছে ৫৭ হাজার ৭৮১ জনকে। তার আগের দিন ৩৬ হাজার ৫৮৬ জনকে।
টিকা নেওয়ার ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ আছে। কিন্তু অব্যবস্থাপনার কারণে অনেকে টিকাকেন্দ্রে যেতে পারছেন না, আগ্রহে বাধা পড়ছে। নিবন্ধন করার ১৫-২০ দিন পরেও অনেকে মুঠোফোনে কেন্দ্র থেকে টিকা নেওয়ার খুদে বার্তা পাচ্ছেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ খুদে বার্তা পাওয়া যাচ্ছে। যেমন গতকাল একজনের খুদে বার্তায় বলা হয়েছে, ‘কোভিড ভ্যাকসিনের পরিবর্তিত সময়সূচি: নিউরোসায়েন্স হাসপাতালের নিচতলা (...)।’
চট্টগ্রামের একজন প্রবাসী শ্রমিক ১১ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের মডার্নার প্রথম ডোজ নিয়েছেন। আগস্টের ১৪ তারিখ তাঁর দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার কথা। কিন্তু তিনি ইতিমধ্যে যে সনদ তুলেছেন তাতে লেখা আছে, তিনি চীনের সিনোফার্মের ভেরোসেল টিকা নিয়েছেন। ওই কেন্দ্রের কর্মকর্তারা বলেছেন, সনদে কোনো পরিবর্তন তাঁরা করতে পারবেন না। করণীয় জানতে ওই প্রবাসী শ্রমিকের আত্মীয় প্রথম আলোতে ফোন করেছিলেন। এ ধরনের অভিযোগ নিয়মিত পাওয়া যাচ্ছে।
স্বাস্থ্য বিভাগ করোনার টিকাকেন্দ্রের সংখ্যা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। তবে হাতে সন্তোষজনক টিকার মজুত থাকলেই কেবল এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নামবে তারা। সে ক্ষেত্রে ইউনিয়ন স্বাস্থ্য উপকেন্দ্র ও কমিউনিটি ক্লিনিককে টিকাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
পরিকল্পনা সম্পর্কে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য কর্মসূচির পরিচালক ডা. সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাতে ১ কোটি টিকা থাকলে তা ৫০ লাখ মানুষকে দেওয়া হবে। একযোগে আট দিন সারা দেশে এই টিকা দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। তখন দিনে ৬ লাখের বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হবে।’
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, আগামী বছরের শুরু নাগাদ ২১ কোটি টিকা দেশে আসবে। এই টিকা ব্যবহার করতে হলে দৈনিক টিকা দেওয়ার পরিমাণ আরও বাড়ানো প্রয়োজন বলে জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করছেন। অধ্যাপক সায়েদুর রহমান বলেন, বিএসএমএমইউতে দিনের অর্ধেক সময় টিকা দেওয়া হয়। বাকি অর্ধেক সময় কাজে লাগালে দ্বিগুণ টিকা দেওয়া যাবে। এভাবে সারা দেশেই টিকাদান বাড়ানো সম্ভব।