বাংলাদেশে প্রথম সংক্রমণ পৌঁছেছিল ইউরোপের কয়েক সপ্তাহ পর। দ্বিতীয় ঢেউয়ের ক্ষেত্রেও সেই একই ধারায় তা আসার আশঙ্কাই বেশি।
প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, তাঁরা প্রস্তুত। ২৩ সেপ্টেম্বর তিনি এ কথাও বলেছেন যে বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রস্তুত বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন, সেটি করোনার প্রথম ঢেউ বাংলাদেশে আঘাত হানার সময়ের মতো কি না, সেটা অবশ্য তিনিই ভালো বলতে পারবেন।
বাংলাদেশে করোনার প্রথম ঢেউ মিলিয়ে গেছে, এমনটি অবশ্য কোনো সংক্রামক রোগবিশেষজ্ঞ বা জনস্বাস্থ্যবিদ বলেননি। প্রয়োজনের তুলনায় শনাক্তকরণের পরিমাণ অনেক কম হওয়ায় এবং নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্তের অভাবে পরিস্থিতির যথাযথ বিশ্লেষণই যেখানে কঠিন, সেখানে বিশেষজ্ঞদের এ রকম উপসংহারে পৌঁছানোর কোনো কারণ নেই। তবে একটি ঢেউ শেষ হওয়ার আগেই যদি দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানে, তাহলে সংক্রমণ এবং মৃত্যুহারে তার প্রতিফলন ঘটত, এই দুটোই অথবা অন্তত সংক্রমণ নাটকীয়ভাবে বেড়ে যাওয়ার কথা।
দ্বিতীয় ঢেউ কতটা তীব্র হতে পারে, তার কিছুটা আঁচ এখন পাওয়া যাচ্ছে ইউরোপে। সংক্রমণ ও মৃত্যুর দিক থেকে সর্বোচ্চ রেকর্ড করা শীর্ষ দুই দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে স্পষ্টতই প্রথম ঢেউ এখনো চলমান। আর ইউরোপের দেশগুলোতে প্রথম ধাক্কা কাটতে না–কাটতেই দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়তে শুরু করেছে। ব্রিটেনে দু-তিন দিন ধরেই দেখা যাচ্ছে, আক্রান্তের সংখ্যা ছয় মাসের রেকর্ডে পৌঁছেছে। তবে মৃত্যুর সংখ্যা এখনো তুলনামূলকভাবে বেশ কম। দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণ সবচেয়ে বেশি তরুণদের মধ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন বছরের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে সেপ্টেম্বরের প্রথমার্ধে এবং সপ্তাহ না যেতেই ছাত্রাবাসগুলোতে উদ্বেগজনক হারে সংক্রমণ শনাক্ত হচ্ছে। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীকে ছাত্রাবাসের নিজ নিজ ঘরে থাকতে বলা হয়েছে দুই সপ্তাহের সেলফ-কোয়ারেন্টিনে। তাঁদের এমনকি ডিসেম্বরে বড়দিনের ছুটিতে বাড়িতে না যাওয়ার পরামর্শও দেওয়া হচ্ছে।
ব্রিটেনে স্থানীয় পর্যায়ে লকডাউনের সমতুল্য বিধিনিষেধের আওতায় আছে জনগোষ্ঠীর প্রায় এক-চতুর্থাংশ। ছয়জনের বেশি কিংবা দুটির বেশি পরিবার একত্র হওয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে। স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ডে এই নিষেধাজ্ঞা আরও কঠিন, এক পরিবার অন্য পরিবারের বাসায় যেতে পারবে না। এসব বিধিনিষেধ অমান্যের জন্য জরিমানা ৫০ পাউন্ড এবং বারবার ভঙ্গের ক্ষেত্রে তা ৩ হাজার ২০০ পাউন্ড পর্যন্ত বাড়তে পারে। আর বিদেশ থেকে আসার পর সেলফ-কোয়ারেন্টিন ভাঙলে ১ হাজার থেকে ১০ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত জরিমানা।
দ্বিতীয় ঢেউয়ে প্রায় একই অবস্থা এখন স্পেন, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসেও। ফ্রান্সেও পরপর দুই দিন সংক্রমণ রেকর্ড ছুঁয়েছে। স্পেনের মাদ্রিদে আবারও লকডাউন দেওয়ার কথা উঠেছে। প্রথম দফা লকডাউনের কারণে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে, তার ধাক্কা সামলাতে নাকাল ইউরোপের নেতারা এখন যেকোনোভাবেই দ্বিতীয় আরেকটি জাতীয়ভিত্তিক লকডাউন এড়াতে মরিয়া। কিন্তু তারা সেই সম্ভাবনা নাকচ করে দিতে পারছে না। খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব বড়দিনের পারিবারিক আয়োজনগুলো যাতে ভন্ডুল না হয়, সে জন্য তারা নাগরিকদের প্রতি স্বাস্থ্যবিধি মেনে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা দিতে সবাইকে উৎসাহিত করছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইউরোপজুড়ে এই দ্বিতীয় দফা সংক্রমণ উদ্বেগজনক রূপ নিচ্ছে বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছে, শীতকালীন ফ্লুর মৌসুম শুরুর আগেই সরকারগুলোর এই সংক্রমণ বন্ধ করা প্রয়োজন। সংস্থার জরুরি কার্যক্রমের পরিচালক মাইক রায়ান বলেন, ‘আমরা একটা বড় অঞ্চলজুড়ে রোগটির উদ্বেগজনক বিস্তার দেখতে পাচ্ছি।’ একই কথা বলছেন সংস্থার কোভিড–১৯-এর টেকনিক্যাল লিড মারিয়া ভ্যান কারখোভ। তিনি বলছেন, ‘ফ্লুর মৌসুম শুরুর আগেই আমরা এসব প্রবণতায় উল্টোমুখী যাত্রার আশঙ্কা দেখতে পাচ্ছি।’
ইউরোপে এখন নতুন করে বিতর্ক শুরু হয়েছে যে প্রথম দফার সংক্রমণ থেকে দেশগুলোর রাজনীতিকেরা আদৌ কোনো শিক্ষা নিয়েছেন কি না। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এবং নিউজিল্যান্ডের কথাও ঘুরেফিরে আলোচিত হচ্ছে। এসব দেশ প্রথম দফাতেও করোনার সংক্রমণ যেমন অল্পতেই নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে, তেমনই দ্বিতীয় দফাও বড় কোনো সমস্যা করতে পারেনি। প্রথম ঢেউটি ঠেকিয়ে দেওয়ায় সফলতার জন্য ভিয়েতনাম ও তাইওয়ানের কথা বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে। আবার দক্ষিণ কোরিয়া প্রথম দফায় কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দ্বিতীয় দফার ধাক্কা ভালোই সামাল দিয়েছে। ফলে এসব দেশের অর্থনীতি দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর পথে রয়েছে। বিদেশিদের আসা এবং স্বদেশিদের দেশে ফেরায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখায় সংক্রমণ ছড়াতে পারেনি। সময়মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগুলো, তা সে যত কঠোরই হোক না কেন, নেওয়ার ক্ষেত্রে এসব দেশের সরকারকে তেমন একটা বেগ পোহাতে হয়নি। আবার অল্প সময়েই সেসব বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হয়েছে। এখন ওই সব দেশে অভ্যন্তরীণ পর্যটন ও জনজীবন প্রায় স্বাভাবিক হয়ে আসায় অর্থনীতির ক্ষতি পশ্চিমা দেশগুলোর মতো ততটা ব্যাপক ও যন্ত্রণাদায়ক নয়।
অর্থনীতির নিম্নগামিতা ঠেকাতে ইউরোপের দেশগুলো গ্রীষ্মকালীন পর্যটনকে সাধ্যমতো সচল করার চেষ্টা করেছে। সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়, যাতে লোকজন রেস্তোরাঁ-বার-ক্যাফেগুলোতে ফিরতে শুরু করে। একই সঙ্গে দীর্ঘ লকডাউনে ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও নতুন শিক্ষাবর্ষের কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু এগুলোতে তড়িঘড়ি করা হয়েছে কি না, সেই প্রশ্নও এখন সামনে চলে আসছে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই যে বিষয়টিতে জোর দিচ্ছেন, তা হলো যেহেতু এখনো কোনো প্রতিষেধক টিকা তৈরি হয়নি, সেহেতু সংক্রমণ প্রতিরোধে শারীরিক দূরত্ব ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কোনো বিকল্প নেই। এই বিশেষজ্ঞদের একজন এডিনবরা ইউনিভার্সিটির পাবলিক হেলথের প্রফেসর দেবী শ্রীধর বলছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত জনস্বাস্থ্যের সমস্যাটির সমাধান না হচ্ছে, ততক্ষণ অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান সম্ভব হবে না।
অন্যদিকে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে যত বেশি সময় লাগছে, মানুষও ততই অধৈর্য হয়ে পড়ছে। এতে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করায় সরকারগুলোকে আরও কঠোর হতে হচ্ছে এবং জরিমানা ও সাজার পরিমাণ বাড়ছে। লন্ডন, বার্লিনসহ বিভিন্ন জায়গায় ডান ও বাম উভয় ধারার উগ্রপন্থীরা এসব বিধিনিষেধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ করছে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ক্ষেত্রে অবশ্য কিছু লক্ষণীয় বিষয় রয়েছে, যা পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারগুলোকে সহায়তা করতে পারে। ইউরোপে এখন পর্যন্ত যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাতে সংক্রমণের হার আগের চেয়ে বেশি হলেও হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন হচ্ছে এমন রোগীর হার এখনো কম। বলা হচ্ছে আগের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশ। তরুণেরা আক্রান্ত হলেও তাঁদের হাসপাতালমুখী হওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে কম। ফলে মৃত্যুর সংখ্যাও আপেক্ষিকভাবে বেশ কম। এর সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হিসেবে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, রোগটির ধরন এবং তার চিকিৎসা সম্পর্কে চিকিৎসকেরা এখন যথেষ্ট অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। ফলে রোগ ব্যবস্থাপনায় উন্নতি ঘটেছে। মৃত্যুর হার কমাতে সক্ষম এমন একাধিক ওষুধের কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। বয়স্ক এবং নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্তদের সুরক্ষা দেওয়া গেলে এই মৃত্যুহার কমানো সম্ভব।
তবে এরপরও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আরও জোরালো নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন। তাঁদের আশঙ্কা, অল্প সময়ের মধ্যেই পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটতে পারে। তাঁরা বিশেষ করে গত সপ্তাহখানেকের পরিসংখ্যানকেই উদ্বেগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করে বলছেন, এই প্রবণতায় ইঙ্গিত মেলে, হাসপাতালের ওপর রোগীর চাপ অচিরেই বেড়ে যেতে পারে। আর শীতকালের মৌসুমি ফ্লুর সঙ্গে কোভিড-১৯-এর চাপ যুক্ত হলে ইউরোপে গভীর বিষাদের ছায়া নেমে আসতে বাধ্য। বাংলাদেশে প্রথম সংক্রমণ পৌঁছেছিল ইউরোপের কয়েক সপ্তাহ পর। দ্বিতীয় ঢেউয়ের ক্ষেত্রেও সেই একই ধারায় আসার আশঙ্কাই বেশি। কিন্তু প্রস্তুতি যদি প্রথম দফার মতো হয়, তাহলে তার পরিণতি গুরুতর হতে বাধ্য।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক