লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক মানুষ এখনো টিকা পায়নি

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনার টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে বরাবরের মতো পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।

ভাসমান মানুষদের করোনার টিকা দিচ্ছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। গতকাল রাত আটটায় রাজধানীর কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকায়

করোনার টিকাদানে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখাতে পারেনি বাংলাদেশ। এক বছরে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকের বেশি মানুষ এখনো পূর্ণ দুই ডোজ টিকা পায়নি। টিকাদানের পরিমাণ বাড়াতে এখন নানা বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

দেশের ৮০ শতাংশ মানুষকে করোনার টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে জাতীয় টিকা প্রয়োগ পরিকল্পনা তৈরি করেছিল স্বাস্থ্য বিভাগে। গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে করোনার টিকাদান শুরু হয়। আজ সোমবার টিকাদানের এক বছর পূর্ণ হলো। এই সময়ে প্রথম ডোজ টিকা পেয়েছে ৯ কোটি ৯১ লাখ বা ৫৭ শতাংশ মানুষ। পূর্ণ দুই ডোজ পেয়েছে সাড়ে ৬ কোটি বা ৩৭ শতাংশ মানুষ।

টিকাদানের এক বছরের মূল্যায়ন সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিকাবিষয়ক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা টিকাদানে ভালো করেছি। টিকাদানের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করে টিকার প্রাপ্যতার ওপর। শুরুর দিকে টিকার প্রাপ্যতায় কিছু সমস্যা ছিল, তা কাটিয়ে উঠেছি। ছোট-বড় আরও কিছু সমস্যা ছিল, তার সমাধান করেছি, করছি।’

তবে জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, শুরু থেকেই ছোট–বড় ভুল করেছে সরকার ও স্বাস্থ্য বিভাগ। এ কারণে টিকাদানে বাংলাদেশের কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি দেখা যায়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, করোনার টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে বরাবরের মতো পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। বছর শেষে অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ—প্রতিটি দেশ প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। বাংলাদেশ শুধু এগিয়ে আছে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের চেয়ে কিছুটা। সামরিক জান্তা শাসিত দেশটিতে গত কয়েক মাসে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। দেশটির বর্তমান পরিস্থিতি টিকা কার্যক্রমের সহায়ক নয়।

টিকা এসেছে ২৭ কোটি ৬৭ লাখ

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, শুরুতে একাধিক বিকল্প উৎস না খুঁজে টিকার জন্য শুধু ভারতের ওপর নির্ভর করা ছিল বড় ভুল। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট ও বেক্সিমকো ফার্মার সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী ছয়টি চালানে তিন কোটি টিকা সরবরাহ করার কথা ছিল। কিন্তু সেরাম ইনস্টিটিউট চুক্তি অনুযায়ী টিকা সরবরাহ না করায় টিকাদান কর্মসূচি হোঁচট খায়। চীনের সিনোফার্মের টিকা কেনার চুক্তি করে পরিস্থিতি সামাল দেয় বাংলাদেশ। তবে কী দামে টিকা কিনছে বা কেনা হচ্ছে, সেই তথ্য গোপন রেখেছে সরকার।

সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচির (ইপিআই) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গতকাল রোববার ৩০ লাখ ফাইজারের টিকা এসেছে। এ নিয়ে দেশে উপহারের, অনুদানের ও কেনা টিকা এসেছে মোট ২৭ কোটি ৬৭ লাখ ২৩ হাজার।

একটা সময় টিকার মজুত কম থাকত বলে বেশি মানুষকে টিকা দিতে পারত না স্বাস্থ্য বিভাগ। গত কয়েক মাসের হিসাবে দেখা যায়, স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে সব সময় কয়েক কোটি টিকা থাকছে। যেমন গতকাল মজুত ছিল ১১ কোটির বেশি টিকা। মজুতের তুলনায় এখন টিকা দেওয়া হচ্ছে কম।

মানুষ কেন্দ্রে আসছে কম

টিকাদান পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে ৩০ জানুয়ারি রাজধানীর মহাখালীর বিসিপিএসে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, মানুষ এখন টিকাকেন্দ্রে টিকা নিতে কম আসছে।

যদিও স্বাস্থ্য বিভাগ গত এক বছরে বেশি মানুষকে টিকা দেওয়ার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। শুরুতে রাজধানীর সরকারি সব বড় হাসপাতাল, জেলা শহরের সরকারি হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে করোনার টিকাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পরবর্তী সময়ে এসব কেন্দ্রের বাইরে ১২টি সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার ওয়ার্ডে টিকাকেন্দ্র করা হয়। তারপর ইউনিয়ন পর্যায়ে টিকা দেওয়া হয়। এখন সারা দেশের ইপিআই কেন্দ্রগুলোতে করোনার টিকা দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে টিকার আওতায় আসছে ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী স্কুলশিক্ষার্থীরা।

এরপরও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী গত এক বছরে সব মানুষ টিকার আওতায় আসেনি। এ পর্যন্ত সুরক্ষা অ্যাপে টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন প্রায় ৮ কোটি ৮৬ লাখ মানুষ। সরকার যাদের টিকা দিতে চায়, তাদের মধ্যে চার কোটির বেশি মানুষ এখনো সুরক্ষা অ্যাপে নিবন্ধন বাকি। এদের টিকার আওতায় আনতে নানা বিকল্প হাতে নিয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

বিকল্প উপায়

গতকাল সকালে রাজধানীর মিরপুর জামিয়া সিদ্দিকীয়া নূরানী মহিলা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার মধ্য দিয়ে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের করোনার টিকা দেওয়া শুরু করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

মহিলা মাদ্রাসায় টিকা দেওয়ার পর হাজী আহামেদ আলী মক্কা ইন্টারন্যাশনাল হিফজুল কোরআন মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া হয়। সন্ধ্যায় কমলাপুরের কিছু ভাসমান মানুষকে টিকা দেওয়া হয়।

এর আগে কুড়িগ্রামের চরের মানুষের জন্য পৃথক উদ্যোগ নিয়েছিল স্বাস্থ্য বিভাগ। পোশাক কারখানার কর্মীদেরও আলাদা উদ্যোগ নিয়ে টিকা দেওয়া হয়েছে। বস্তিবাসীদের আলাদাভাবে টিকা দেওয়া হয়েছে। পরিবহনশ্রমিকদের টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। একইভাবে দোকানকর্মীদেরও টিকা দেওয়া হবে বলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তা জানিয়েছেন।

তবে জনস্বাস্থ্যবিদেরা মনে করেন, মানুষকে টিকা নেওয়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি স্বাস্থ্য বিভাগ। টিকা নেওয়ার জন্য যে পরিমাণ প্রচার–প্রচারণা করার দরকার ছিল, তা করা হয়নি। সংবাদপত্র বা টেলিভিশনগুলো টিকাদানের খবর প্রচার করেছে, মানুষকে কর্মসূচি জানিয়েছে। কিন্তু স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে প্রচার-প্রচারণায় ঘাটতি ছিল। করোনার টিকার জন্য প্রচারপত্র, পোস্টার মানুষের চোখে পড়েনি।

টিকাদানের সার্বিক পরিকল্পনায় ত্রুটি আছে বলে মন্তব্য করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক সায়েদুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের বয়স বেশি, তাঁদের টিকার আওতায় আনতে পারেনি স্বাস্থ্য বিভাগ। ঝুঁকিগ্রস্ত সব মানুষকে টিকার আওতায় আনার চেষ্টা করা হয়নি। উদ্দেশ্যহীনভাবে বয়সসীমা কমানো হয়েছে বারবার।

এই টিকা বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, অল্প সময়ে বেশি মানুষকে টিকা দিলে সুফল বেশি পাওয়া যায়, দীর্ঘ সময় ধরে টিকা দিলে সেই ফল পাওয়া যায় না। ইপিআইয়ের মাধ্যমে মা ও শিশুদের টিকাদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সুখ্যাতি আছে। ইপিআইয়ের সেই সক্ষমতা করোনার টিকার কাজে লাগাতে পারল না বাংলাদেশ।