এখনকার করোনা পরিস্থিতি স্বস্তিদায়ক। এই অবস্থা ধরে রাখতে নজরদারি ও রোগী ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিতে হবে।
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে। এর মধ্যে গত এক সপ্তাহে চারটি জেলায় রোগী শনাক্তের হার শূন্যের কোঠায়। আর ১৪টি জেলায় এই হার ১ থেকে ২ শতাংশের মধ্যে।
করোনার সংক্রমণ কমার পাশাপাশি মৃত্যুও অনেক কমে এসেছে। দেশের ১৯টি জেলায় গত এক সপ্তাহে করোনায় কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। তবে করোনায় যাঁদের মৃত্যু হচ্ছে, তাঁদের একটি বড় অংশেরই এখনো ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগের মতো অন্য কোনো দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত থাকার ইতিহাস নেই।
চার জেলায় রোগী শনাক্তের হার শূন্যের কোঠায়। ১৪টি জেলায় রোগী শনাক্তের হার ছিল ২ শতাংশের নিচে। ১৯ জেলায় মৃত্যু হয়নি।
জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, এখনকার করোনা পরিস্থিতি স্বস্তিদায়ক। এই অবস্থা ধরে রাখতে নজরদারি ও রোগী ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিতে হবে। পাশাপাশি হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় যেসব ঘাটতি আছে, সেগুলো দ্রুত পূরণ করতে হবে। টিকাদানে জোর দিতে হবে। কারণ, এর আগেও সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসার কিছুদিন পর পরিস্থিতি আবার ভয়ানক আকার ধারণ করতে দেখা গেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারণ করা মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো দেশে রোগী শনাক্তের হার টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ৫ শতাংশের নিচে থাকলে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়। গতকাল রোববার দেশে টানা ১৩তম দিনের মতো রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে ছিল।
গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত স্বাস্থ্য বুলেটিনে অধিদপ্তরের মুখপাত্র নাজমুল ইসলাম বলেন, সারা বিশ্বেই করোনা সংক্রমণ কমছে। এই মুহূর্তে দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি স্বস্তিদায়ক। তবে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কারণ নেই। সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। তাহলে এই পরিস্থিতি অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে।
চার জেলায় শনাক্তের হার শূন্যের কোঠায়
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২৭ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ অক্টোবর—এই এক সপ্তাহে দেশের চারটি জেলায় পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার শূন্যের কোঠায় বা ১ শতাংশের নিচে। এই জেলাগুলো হলো কিশোরগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, পাবনা ও লালমনিরহাট। এর বাইরে ১৪টি জেলায় এই সপ্তাহে রোগী শনাক্তের হার ছিল ২ শতাংশের নিচে। সেগুলো হলো মাদারীপুর, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, নোয়াখালী, কুমিল্লা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, খুলনা, নড়াইল, সাতক্ষীরা, ঝালকাঠি, সিলেট ও সুনামগঞ্জ।
এই এক সপ্তাহে দেশের ১৯টি জেলায় করোনায় সংক্রমিত হয়ে কারও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, এই জেলাগুলো হলো মাদারীপুর, নেত্রকোনা, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, নাটোর, নওগাঁ, পাবনা, জয়পুরহাট, কুড়িগ্রাম, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, বাগেরহাট, চুয়াডাঙ্গা, নড়াইল, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর, বরগুনা ও ঝালকাঠি।
সাত মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন শনাক্ত
গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, শনিবার সকাল আটটা থেকে গতকাল সকাল আটটা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ২১ হাজার ২৪৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ৬১৭ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়। পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হার ২ দশমিক ৯০। এটি গত সাত মাসের মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় সর্বনিম্ন রোগী শনাক্তের হার। এর আগে সর্বশেষ এর চেয়ে কম শনাক্তের হার ছিল গত ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২ দশমিক ৮৭ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় মৃত্যু হয়েছে ১৮ জনের।
সংক্রমণের শুরু থেকে গতকাল পর্যন্ত দেশে মোট ১৫ লাখ ৫৭ হাজার ৯৬৪ জনের দেহে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২৭ হাজার ৫৭৩ জনের। আর সুস্থ হয়েছেন ১৫ লাখ ১৮ হাজার ৭৫৪ জন। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন ১ হাজার ১১২ জন।
৪৬ শতাংশের অন্য রোগ ছিল না
ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি রোগের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত (কোমরবিডিটি) ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে করোনায় মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। করোনার সংক্রমণে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটির টেনেসি অঙ্গরাজ্যের তথ্য (১৫ মার্চ থেকে ১৫ আগস্ট ২০২০) বিশ্লেষণ করে সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলছে, সেখানে করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ২০ শতাংশের কোমরবিডিটি বা অন্য রোগে আক্রান্ত থাকার ইতিহাস ছিল না। বাংলাদেশে এই হার অনেক বেশি। গত ১৩ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর—দুই সপ্তাহের ৪৮৩টি মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাতে দেখা যায়, ৪৫ দশমিক ৭৬ শতাংশের অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত থাকার ইতিহাস ছিল না। বাকিরা করোনার পাশাপাশি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, বক্ষব্যাধি, হৃদ্রোগ, কিডনি রোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিলেন। এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরে ২৬৭টি মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছিল, তাঁদের মধ্যে ৫২ শতাংশের করোনার বাইরে অন্য কোনো দীর্ঘমেয়াদি রোগের ইতিহাস ছিল না।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশের অনেক মানুষ স্বাস্থ্যসচেতন নন। তাঁদের অনেকে হয়তো জানেন না যে তাঁরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। যে কারণে এই চিত্র উঠে এসেছে। এ ছাড়া যাঁরা বয়স্ক, তাঁদের অন্য রোগ না থাকলেও করোনায় মৃত্যুঝুঁকি তুলনামূলক বেশি।
হাসপাতাল ও রোগী ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে
২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়। ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের সব দেশে। বাংলাদেশে প্রথম সংক্রমণ শনাক্তের খবর জানানো হয়েছিল গত বছরের ৮ মার্চ। ওই বছরের মে মাসের শেষ থেকে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছিল। আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত রোগী শনাক্তের হার ছিল ২০ শতাংশের ওপরে। এরপর তা কমতে শুরু করে। মাঝে নভেম্বরে সংক্রমণ বেড়েছিল। তবে ডিসেম্বরের শেষে তা আবার কমতে শুরু করে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে ছিল।
গত বছরের সঙ্গে চলতি বছরের সংক্রমণচিত্রে কিছু মিল দেখা যায়। সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয় চলতি বছরের মার্চে। জুন মাস থেকে সংক্রমণ দ্রুত বাড়তে থাকে, জুলাইয়ে গিয়ে পরিস্থিতি ভয়ানক আকার নেয়। প্রথম ঢেউয়ের তুলনায় দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যু অনেক বেশি ছিল। আগস্টে গিয়ে সংক্রমণ কমতে শুরু করে। এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পথে। গত বছরও এই সময়টাতে সংক্রমণ কমে এসেছিল। ওই সময় থেকে জনস্বাস্থ্যবিদেরা চিকিৎসা সুবিধার আওতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু তা যথাযথ হয়নি। দ্বিতীয় ঢেউয়ে গিয়ে সংক্রমণ বেশি হয়েছে গ্রামে। মৃত্যুও বেশি হয়েছে।
করোনার চিকিৎসা-সুবিধা বাড়াতে গত বছরের জুনে দেশের সব জেলা হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে এখনো সব হাসপাতালে এই সুবিধা সম্প্রসারিত হয়নি।
টিকায় জোর দেওয়ার তাগিদ
সরকার দেশের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশকে করোনার টিকা দিতে চায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, এ পর্যন্ত ১০ শতাংশ মানুষ পূর্ণ দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন। বাংলাদেশের অবস্থান শুধু প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের চেয়ে কিছুটা ভালো। দেশটিতে দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন ৭ শতাংশ মানুষ।
এ পর্যন্ত দেশে টিকা এসেছে প্রায় ৫ কোটি ৬০ লাখ ডোজ। সরবরাহ ও টিকাদানের হিসাব বিশ্লেষণে দেখা যায়, মানুষকে দেওয়ার পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাতে ৫০ লাখের মতো টিকা মজুত আছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এখন নজরদারি শক্তিশালী করতে হবে। কোথাও সংক্রমণ বাড়ছে কি না, সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর রাখতে হবে। যেহেতু রোগী কম, তাই রোগী ব্যবস্থাপনাও এখন সহজ। ইউরোপ বা আমেরিকার তুলনায় টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। যত দ্রুত সম্ভব বেশি মানুষকে টিকার আওতায় আনতে হবে। এতে সংক্রমণ আবার বাড়লেও মৃত্যুর হার কমবে। তিনি বলেন, এখনকার পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় যেসব ঘাটতি আছে, সেগুলো দ্রুত পূরণ করতে হবে। বিশেষ করে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা এবং পর্যাপ্ত নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) স্থাপন করতে হবে।