মেঘ দেখে ভয় করিস নে, আড়ালে তার সূর্য হাসে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

যাপিত জীবনে করোনা–আতঙ্ক এক অস্বস্তিকর অধ্যায়। আমাদের সুখের পৃথিবীতে বিষণ্নতার নদী বয়ে যায় অবিরাম। এই যেন চরম উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা আর আতঙ্কের মধ্যে প্রতিনিয়ত পথচলা। কখন–কীভাবে করোনার নামক সংক্রমণে সংক্রমিত হব বলা মুশকিল। একটু হাঁচি–কাশি দিলে চোখ বড় করে থাকতে হয়। এই বুঝি করোনার লক্ষণ। জ্বর কিংবা গলাব্যথা হলে তো কথাই নেই। নিশ্চিত করোনার ছোঁয়া। মনের অজান্তে আপনাআপনি এসে যায় ভয়ের প্রতিচ্ছবি।

শীতপ্রধান দেশে সর্দি–কাশি সব সময় লেগে থাকে। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হেইপিবার নামক রোগের উপদ্রব হয় বেশি। বাচ্চাদের ফ্লু কিংবা ডায়রিয়ায় সংক্রমিত হতে হয় সহজে। মজার ব্যাপার হলো এ দেশে ডাক্তাররা স্বভাবত সর্দি–কাশি কিংবা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে কোনো ওষধ প্রেসক্রাইব করে না। বড়জোর প্যারাসিটামল অর প্লান্টি অব ফ্লুইড। প্রথম প্রথম খুব অস্বাভাবিক মনে হতো। এখন সয়ে গেছে।

সেদিন ছিল শুক্রবার। শেষ উইক ডে। মেঘলা আকাশ, তাপমাত্রায় শীত বলা যায়। রাত থেকে আমার ছেলের কফিং শুরু। ছোটকাল থেকে সে ঠান্ডাজনিত রোগে সংক্রমিত হয় খুব সহজে। ইতিমধ্যে কয়েকবার হানি লেমন সেবন করা হয়েছে। গরম পানির গরগরা আর বুকে শর্ষে তেল মালিশে নিরাময়ের নিরন্তর চেষ্টা। সকাল সকাল ক্লিনিকে ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য ফোন করা হলো। বারবার এনগেইজ হওয়ায় ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। সামনে উইকএন্ড দুই দিন সব বন্ধ। ডাক্তার পাওয়া মুশকিল। আনলেস ইমার্জেন্সি। অবশেষে বার কয়েক চেষ্টাতে লাইন পাওয়া গেল। ভিডিও কলের মাধ্যমে রোগের উপসর্গ জিজ্ঞেস করে ফোন রেখে দিল, আই উইল কল ব্যাক লেটার। বোঝা গেল নতুন ডাক্তার, সিদ্ধান্তে সিদ্ধহস্ত নয়। অস্থির সময়ে অপেক্ষার পালা। ফোনের ভলিউম আপ করা হলো। হাতে কাছে রেখে সময় গণনার পালা। প্রায় ৪৫ মিনিট পরে আননোন নম্বর থেকে রিং এল। ডাক্তারের পরামর্শ হলো সিম্পটন, ‘করোনাভাইরাস’ ইমিডিয়েট টেস্ট করাতে হবে। কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। কেমন করে ভাইরাসের সংস্পর্শে আসা? পার্কে না সাইকেলিং?

অনলাইনে করোনা টেস্ট অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করতে হবে। লিংক দেওয়া হলো। পরামর্শ হলো, ঘরের সবাইকে ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে। জরুরি প্রয়োজনে ১১১–এ কল করে পরামর্শ নিতে হবে। গৃহিণী নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের তালিকা করে নিল দুধ, ডিম ও ব্রেড।

প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

অনলাইনে করোনা টেস্ট বুক করতে গিয়ে বারবার প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন। কী করব বুঝে উঠছি না। শঙ্কিত মনে বিশ্বব্যাপী করোনার ইমপেক্ট চোখের সামনে ভেসে ওঠে। করোনার উৎপত্তি, বাতাসের গতিতে সংক্রমিত হওয়া, স্বজন হারানো মানুষের হাজারো গল্প এখনো কানে বাজে। এত সাবধানতা অবলম্বনের পরে করোনা টেস্ট ভাবতে গা শিহরণ করে। সম্ভবত প্রত্যেক বাবা–মার কাছে সন্তানের অসুখ মানে অচেনা উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা। পরে ১১১–এ কল করে জানতে পারলাম, করোনাভাইরাস হেল্প লাইন ১১৯। করোনা টেস্ট অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করা, জরুরি পরামর্শের অনেকগুলো অপশন দেওয়া আছে। বুকিং অপশনে সরাসরি উত্তর আসল স্কটিস এক্সসেন্টে, হাউ ক্যান আই হ্যাল্প ইউ? মনে হলো কোনো এক আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছে, বড় বিদ্‌ঘুটে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করা হলো পরদিন সকালে। নিয়ারেস্ট টেস্ট সেন্টার হাটপোটসায়র কাউন্টি হল।

অপ্রত্যাশিত এমন পরীক্ষায় বিচলিত হওয়া স্বাভাবিক। মনের মধ্যে কত কিছুই আসে যায়। করোনা পজিটিভ হলে কী করতে হবে? রাত–দিন কীভাবে একটা ছেলেকে আট বাই দশ ফিট কামরার মধ্যে একাকী রাখা যাবে? আমাদের করণীয় কী? হোম কোয়ারেন্টিনের গাইডেনস কতটুকু মানা সম্ভব? অনুমানের ভিত্তিতে হাজারো নেগেটিভ পজিটিভ চিন্তা। আবেগ আর অনিশ্চয়তার মধ্যে আমাদের নির্ঘুম রাত কেটে গেল।

পরদিন সকালে তড়িঘড়ি করে রেডি হয়ে গেলাম। নেভিগেশনে পোস্টকোড দিয়ে জানা গেল দূরত্ব ৮.২ মাইল, সময় লাগবে ১৪ মিনিট। বোঝা গেল কোনো ট্রাফিক জ্যাম নেই।

প্রতীকী ছবি

আমরা ঘর থেকে যখন বের হই আকাশে মেঘ সূর্যের লুকোচুরি খেলা। উইক এন্ড হওয়ায় রাস্তায় ট্রাফিক চোখে পড়ার মতো নয়। Dual carriage way দুই পাশে চোখধাঁধানো সবুজের সমারোহ। মাঠের পর মাঠে চাষ করা হয়েছে ভুট্টাজাতীয় শস্য। দূরে বহু দূরে ছবির মতো এক একটি কুঁড়েঘর। আমরা যথাসময়ে নির্দিষ্ট পোস্টকোডে পৌঁছে গেলাম। কাউন্টি হলের বাঁ পাশে বিশাল ক্রিকেট গ্রাউন্ডের পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা ওয়ান ওয়ে রাস্তা চলে গেছে ওপরের দিকে। প্রথম মিলিটারি পারসন আমাদের গাড়ি স্টপ করে জানতে চাইল আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে কি না। ২য় জন ই–মেইল বার কোড স্ক্যান করে নিলেন। মেইন রিসিপশনে কয়েক মিনিটের ইনডাকসন দেওয়া হলো। কীভাবে করোনা টেস্ট করাতে হবে। টেস্টের পরে কী করতে হবে। সিদ্ধান্ত হলো আমরা পুরো পরিবার টেস্ট করে ফেলব। প্রত্যেকে এক একটা প্যাক দেওয়া হলো। আমরা সুবিধামতো গাড়ি পার্ক করে নিলাম। নিয়মাবলি পড়ে টেষ্ট করব কিন্তু কে আগে?

ড্যাডি, মামি নাকি ছেলে-মেয়ে? ছেলে আগে টেস্ট করতে রাজি হলো। প্রথমে তুলার কাঠিটি জিবের শেষ প্রান্তে ১০ সেকেন্ড রেখে নাকের ভেতর আরও ১০ সেকেন্ড রাখতে হয়। তারপর কাঠির অর্ধেক ভেঙে একটা শিশির মধ্যে রেখে সিল করা হলো। প্যাকেটে প্রত্যেক রিসিপের সঙ্গে একটা করে বারকোড দেওয়া হলো। যা দিয়ে অনলাইন রেজিস্টারি করতে হবে।

আমরা ঘরে এসে যথারীতি বারকোড স্ক্যান করে রেজিস্টার করে নিলাম। ভাবনায় কত কিছু মনে আসে। এবার কি আমাদের পালা? করোনার এমন অজানা আমঙ্কা আমাদের সরব সংসারে নীরবতার হাতছানি দেয়। তবে ভরসা এই, ছেলের কাশি ছাড়া আর কোনো উপসর্গ নেই। তবু মা। বাবার চেয়ে মায়ের স্নেহ বেশি প্রকাশিত। যার কোনো সীমারেখা নেই। আয়তন নেই। সন্তানের জ্বর হলে মায়ের উদ্বেগ বেড়ে যায় দ্বিগুণ। সময় যতই যায় আমাদের বিষণ্নতা বাড়তে থাকে।

সময়ের কাঁটা বিরামহীনভাবে চলছে শনি থেকে রবি, সোমবার। বিস্তৃত হয় অপেক্ষার প্রহর। অন্য কোনো উপায়ে তাড়াতাড়ি রেজাল্ট পাওয়ায় সুযোগ সীমিত। এখানে দেনদরবার বা সুপারিশের কোনো বালাই নেই। নেই কোনো ঘুষ–বাণিজ্যের বিশেষ সুবিধা। অবশেষে প্রায় ৫৫ ঘণ্টা পরে টেক্সট পেলাম সঙ্গে ই–মেইল। রেজাল্ট নেগেটিভ। সবাই করোনামুক্ত। কবির ভাষায়, ‘মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে পার হয়ে আসিলাম আজি নব প্রভাতের শিকড় চূড়ায়’। এই যেন না ফেরার দুয়ার থেকে ফেরা। গৃহিণী খুশির আত্মোৎসর্গ পড়ল দুই রাকাত নফল নামাজ। হয়তোবা আরও কিছুদিন উপভোগ করতে পারব আমাদের ভালোবাসার পৃথিবীটা।