দেশব্যাপী গণটিকাদান কর্মসূচির প্রথম দিনে টিকাকেন্দ্রে উপচে পড়া ভিড়। টিকা পেতেও অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘক্ষণ। সারি না থাকায় তৈরি হয় বিশৃঙ্খলা। গতকাল সকালে রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজে
দেশব্যাপী গণটিকাদান কর্মসূচির প্রথম দিনে টিকাকেন্দ্রে উপচে পড়া ভিড়। টিকা পেতেও অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘক্ষণ। সারি না থাকায় তৈরি হয় বিশৃঙ্খলা। গতকাল সকালে রাজশাহী টিচার্স ট্রেনিং কলেজে

ভয়ংকর এক মাস পার করল দেশ

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের ১৭তম মাস পূর্ণ হচ্ছে আজ রোববার। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে শনাক্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বিবেচনায় সবচেয়ে ভয়ংকরতম মাস (৯ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট) পার করল বাংলাদেশ। এই এক মাসে সাড়ে তিন লাখের বেশি নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। আর মারা গেছেন সাড়ে ছয় হাজারের বেশি মানুষ। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত দেশে যত রোগী শনাক্ত ও যত মৃত্যু হয়েছে, তার এক-চতুর্থাংশের বেশি হয়েছে ১৭তম মাসে।

সংক্রমণের ১৭তম মাসে রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুতে একের পর এক নতুন রেকর্ড হয়েছে। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায়ও (গত শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল শনিবার সকাল ৮টা) করোনায় সংক্রমিত হয়ে ২৬১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এটি এক দিনে দেশে করোনায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। এর আগে গত বৃহস্পতিবার এক দিনে সর্বোচ্চ ২৬৪ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ নিয়ে টানা ১৪ দিন ধরে প্রতিদিনই দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।

জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, করোনার ডেলটা ভেরিয়েন্টের (ভারতে উৎপত্তি) দাপটে দেশে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হয়েছে। অবশ্য গত এক সপ্তাহে শনাক্তের হার কিছুটা কমতে শুরু করলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে বাংলাদেশ অনেক দূরে। এ অবস্থায় দ্রুততার সঙ্গে বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি, বিশেষত মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে হবে। অবস্থা বুঝে পর্যায়ক্রমে বিধিনিষেধ শিথিল করতে হবে। না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর আকার ধারণ করতে পারে।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। ক্রমে তা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে প্রথম এই ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের কথা জানানো হয় গত বছরের ৮ মার্চ। চলতি বছরের মার্চে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়। মাঝে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর মে মাস থেকে সংক্রমণ বাড়তে থাকে। বিশেষ করে ভারতের সঙ্গে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে পরিস্থিতির অবনতি হয়। জেলাভিত্তিক বিধিনিষেধ দিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ওই সময়টাতেই দেশে প্রথম ডেলটা ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। জুন থেকে সারা দেশেই সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। এ সময় দেশে ডেলটা ভেরিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামে সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে শুরু করে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল গত জুনে ৭৮ শতাংশ সংক্রমণের জন্য দায়ী ছিল ডেলটা ভেরিয়েন্ট। আর এখন শনাক্তদের ৯৮ শতাংশ এই ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত বলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় উঠে এসেছে। সংক্রমণ বাড়তে থাকার একপর্যায়ে জুনের মাঝামাঝি নাগাদ মৃত্যুও বাড়তে শুরু করে। জুনের শেষে এসে দৈনিক মৃত্যু ১০০ ছাড়ায়। জুলাই মাসে এসে পরিস্থিতি ভয়ংকর আকার ধারণ করে।

৩০% মৃত্যু শেষ এক মাসে

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, শুরু থেকে গতকাল শনিবার পর্যন্ত সারা দেশে মোট ১৩ লাখ ৪৩ হাজার ৩৯৬ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এর মধ্যে ৯ জুলাই থেকে ৭ আগস্ট পর্যন্ত (১৭তম মাস) ৩ লাখ ৫৪ হাজার ১৭৭ জনের দেহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়, যা মোট শনাক্তের ২৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ। এই এক মাসে সাত দিন বাদে প্রতিদিনই দেশে ১০ হাজারের বেশি নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে। বেশির ভাগ দিন পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হারও ৩০ শতাংশের কাছাকাছি ছিল।

গতকাল পর্যন্ত করোনায় মোট ২২ হাজার ৪১১ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর মধ্যে ৬ হাজার ৬১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে সর্বশেষ এক মাসে, যা মোট মৃত্যুর ২৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এই মাসে সাত দিন বাদে প্রতিদিনই দুই শতাধিক মৃত্যু দেখেছে বাংলাদেশ।

শুরু থেকে দেশে ষাটোর্ধ্ব এবং নারীদের তুলনায় পুরুষের মৃত্যু বেশি হচ্ছে। এখনো সে ধারা অব্যাহত। তবে এখন অপেক্ষাকৃত কম বয়সী এবং নারীদের মৃত্যু ক্রমে বাড়ছে।

মোট শনাক্তের সংখ্যা বিবেচনায় দেশে করোনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ। মৃত্যুর হারের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ তৃতীয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ২৬তম। আর মোট মৃত্যুর দিক থেকে ২৯তম।

এখনো শনাক্তের হার বেশি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল সকাল ৮টা পর্যন্ত নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে ৮ হাজার ১৩৬ জন। পরীক্ষার বিপরীতে গতকাল রোগী শনাক্তের হার ২৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী, কোনো দেশে টানা দুই সপ্তাহের বেশি সময় রোগী শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে বলে ধরা যায়। দেশে সে হার এখনো ২৫ শতাংশের ওপরে। ১১ আগস্ট থেকে বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া হচ্ছে। তখন স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করা না গেলে সংক্রমণে আবার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাওয়ার আশঙ্কা আছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত এক সপ্তাহের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত এক সপ্তাহে মোট পরীক্ষার বিপরীতে সারা দেশে রোগী শনাক্তের হার ২৮ দশমিক ০৭ শতাংশ। এর মধ্যে ২৭টি জেলায় শনাক্তের হার ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশের মধ্যে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোতে সংক্রমণের হার তুলনামূলক বেশি। এর মধ্যে আছে ঢাকা বিভাগের ফরিদপুর, গাজীপুর, গোপালগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, নরসিংদী, রাজবাড়ী ও শরীয়তপুর। চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার মধ্যে ৮টিতে শনাক্তের হার ৩০ শতাংশের ওপরে। সেগুলো হলো চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙামাটি, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, কুমিল্লা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ বাদে বাকি তিন জেলাতেই (সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ) রোগী শনাক্তের হার ৩০ শতাংশের ওপরে। এ ছাড়া বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পটুয়াখালী ও ভোলা; খুলনা বিভাগের কুষ্টিয়া এবং রংপুরের রংপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরে রোগী শনাক্তের হার ৩০ শতাংশের ওপরে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিন ধরে শনাক্তের হার কিছুটা নিম্নগামী, কিন্তু তা স্থিতিশীল নয়। বিধিনিষেধ শিথিল হলে পরিস্থিতির অবনতি হওয়ার আশঙ্কা আছে। সবকিছু একবারে খুলে না দিয়ে পর্যায়ক্রমে বিধিনিষেধ শিথিল করতে হবে। এ ক্ষেত্রে যেসব এলাকায় ঝুঁকি বেশি, সেগুলো চিহ্নিত করে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে।