গ্রামবাংলায় একটা কথা আছে, পাগলের সুখ মনে মনে। এ কথাটার গূঢ় অর্থ কিন্তু অনেক অর্থবহ। যেটার সহজ মানে করলে দাঁড়ায়, মনের সুখই প্রকৃত সুখ। এ ছাড়া ছোটবেলায় পড়া একটা ছড়ার কথা মনে পড়ে, ‘দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া/ ঘর হইতে শুধু দুই পা ফেলিয়া/ একটি ধানের শীষের উপরে/ একটি শিশির বিন্দু!’
অবশ্য এই কথাগুলোকে অন্যভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়। যেমন সাধ্য নেই তাই সাধারণ জিনিসের মধ্যেই সুখ খুঁজে নেওয়া। সে যাইহোক, সুখের অনুভূতিটাই আসল। সেটা যেকোনোভাবেই আসতে পারে। আমাদের সুখের অনুভূতিগুলো নিতান্তই সাদামাটা, তবে তাতে প্রাণের স্পর্শ থাকে ষোলো আনা। ভোরবেলায় শিশিরে পা ভিজিয়ে হাঁটা থেকে শুরু করে দুপুরের বৃষ্টিতে ভেজা, বিকেলের নরম আলোয় দৌড়াদৌড়ি আর রাতের বেলায় হাঁটাহাঁটি—সবকিছুই আমাদের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। এগুলো দেখে আড়ালে মানুষ বিভিন্ন উপনামে আমাদের ডাকলেও আমরা অবিরাম এগুলো করে চলেছি।
এবার আসি জ্যোৎস্নাবিলাসের গল্পে। করোনাভাইরাসের আতঙ্কের কারণে একটা খুবই রূঢ় সত্য সামনে চলে এসেছে, সেটা হলো মানবতা নিয়ে আমরা যতই বড় বড় গল্প ফাঁদি না কেন, আধুনিক যুগে মানবতার অবস্থান আস্তাকুঁড়ে। সারা পৃথিবীতে মানুষ স্বার্থপরের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মজুত রাখতে শুরু করেছে। আর অস্ট্রেলিয়ানরা স্টোর করতে শুরু করেছে স্যানিটাইজার আর টিস্যু। এর কারণ হিসেবে আমার স্কুলপড়ুয়া মেয়ে বলল, বাবা কিছুদিন পর চীন থেকে এগুলো আমদানি নিষিদ্ধ করা হবে, তাই সবাই আগাম মজুত শুরু করেছে। পাশাপাশি মুদির অনেকগুলো আইটেমও সোল্ড আউট। আমাদের পরিবারে কোনো কিছুর ঘাটতি পড়লে একেবারে শেষ মুহূর্তে আমরা টের পাই। আগের বাসায় থাকতে প্রতিবেশী নাজমুল ভাইয়েরা ছিলেন আমাদের জরুরি জোগানদাতা, কিন্তু এখন ছুটতে হয় শপিংমলে। তরকারি চুলায় তুলে দেওয়ার পর দেখা যায়, লবণ মরিচ নেই। চায়ের পানি বসানোর পর আবিষ্কার হয় যে চা–পাতা অথবা চিনি শেষ। পরশু দিনও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। লবণ এবং চা–পাতা নেই। তরকারি তখন চুলায়। আমি আর রায়ান তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম। মিন্টো শপিংমলের উলিসে যেয়ে চা–পাতা পেলেও রান্নার লবণ পাওয়া গেল না। তাই আপাতত এক কৌটা টেবিল সল্টই নিয়ে এলাম। সেখানে একজন নারী কর্মী রিফিল করছিলেন, আমি উনাকে বললাম, এগুলো আগাম মজুত করে কোনো লাভ নেই। কারণ, যখন সারা পৃথিবীর মানুষ মরবে, তুমি আমি আলাদাভাবে বেঁচে থাকতে পারব না। উনিও আমার সঙ্গে একমত হয়ে বললেন, দিস ইজ ম্যাডনেস। অনেক আগেই টয়লেট টিস্যু শেষ হয়ে গেছে, তাই আমি আর টয়লেট টিস্যুর সারিগুলোর দিকে গেলাম না। কারণ, মানুষের স্বার্থপরতার বাস্তব উদাহরণ আমি নিতে পারব না।
বাইরে বেরিয়ে এসে পুব আকাশে তাকিয়ে দেখি, চাঁদমামা তার পূর্ণ যৌবন নিয়ে মিটিমিটি হাসছে। আর আমাদের দেখে ছাইরঙা মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়ছে। আমি আর রায়ান বাসায় ফিরে সদাইগুলো নামিয়ে গিন্নিকে বললাম, আমরা একটু জোছনাবিলাস করে আসি। গিন্নি মনে মনে বিরক্ত হলেও আর না করল না। কারণ, জানে, একবার যখন কোনো কিছু আমার মাথায় ঢুকেছে, তখন সেটা আমি করেই ছাড়ব। আমরা ড্রাইভ করে আমাদের ছোট নদীর পাড়ের খোলা জায়গাটায় চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে দেখি, ফ্লাডলাইট জ্বালিয়ে লোকজন রাগবি খেলছে। তাই বাধ্য হয়েই ফিরে আসতে হলো। এরপরই মনে হলো ওয়ান মিন্টোর কিগমাউন্ট রিজার্ভের কথা। মিন্টোর নতুন এলাকার নাম দেওয়া হয়েছে ওয়ান মিন্টো আর সেখানকার রাস্তা, পার্কগুলোও অনেক গোছানো। কিগমাউন্ট রিজার্ভের বিশেষত্ব হলো এটি অনেক উঁচুতে। ওখানে গিয়ে বসলে সামনের নিচু এলাকার বাড়িগুলোর আলো দেখা যায়। আমার কাছে মনে হয়, আকাশের সব তারা যেন মাটিতে খসে পড়ে মিটিমিটি জ্বলছে। ওখানে পৌঁছে দেখি, পুরো পার্কে সুনসান নীরবতা। পাশের একটি বাসা থেকে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে থেমে থেমে। অন্যান্য দিন হলে সেখানে রাতের বেলায়ও লোকে লোকারণ্য থাকত। রায়ান কিছুক্ষণ দোলনায় দোল খেল, আর আমি সেই ফাঁকে মেঘের ভেলায় চাঁদের ভেসে চলা দেখলাম। সূর্য এবং চাঁদের আলোর মধ্যে মূল পার্থক্য হলো আপনি সূর্যের দিকে তাকিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিতে পারবেন না, কিন্তু চাঁদের দিকে তাকিয়ে আপনি পুরো রাত পার করে দিতে পারবেন।
রায়ানের দোল খাওয়া শেষ হলে ভাবলাম, এই তো সুযোগ, একটা ছোটখাটো ড্রাইভ দেওয়া যায়। যেই ভাবা সেই কাজ। আমরা ড্রাইভ শুরু করলাম। এটা অবশ্য আমাদের বেশ পুরোনো অভ্যাস। রায়ান যখন আরও ছোট ছিল, রাতের বেলা ওকে ঘুম পাড়ানোর জন্য আমি ওকে নিয়ে বের হতাম আর ওর মা রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়ত। আমরা এদিক–ওদিক ড্রাইভ করে একটি জায়গায় চলে যেতাম, যেখানে রাস্তাটা শেষ হয়ে গেছে। চারদিকে শুধু উঁচু বৃক্ষরাজি। যেদিক দিয়ে এসেছি, সেদিক দিয়েই ফিরতে হবে। জায়গাটায় দিনের বেলা মানুষ বেড়াতে গেলেও রাতের বেলা আমাদের মতো শুধু দু–একজন পাগলেরই দেখা পাওয়া যায়৷ আমাদের বাসায় রাত্রে কেউ বেড়াতে এলেও আমরা তাঁদের এখানটায় নিয়ে আসি বেড়াতে। মোবাইলের নেটওয়ার্ক নেই, এটা সবচেয়ে ভালো ব্যাপার। মাথার ওপরে ফিনকি দেওয়া জোছনা আর নিচে নীরব বৃক্ষরাজি। এই সৌন্দর্য বর্ণনা করার ভাষা আমার জানা নেই। আমরা শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে অনুভব করি। বনের শীতল বাতাস মুহূর্তের মধ্যে গা জুড়িয়ে দেয়। গতকাল অবশ্য সেখানে যাওয়া হলো না, তার আগেই ফিরে আসতে হলো গিন্নির তলব পেয়ে। বাসায় ফিরে দেখি, আমাদের ঘরের চালার ওপর দাড়িয়ে চাঁদমামা নৃত্য শুরু করে দিয়েছে। আমরা সবকিছু গোছগাছ করে শুরু করলাম বাংলাদেশের ব্লকবাস্টার সিনেমা ‘ঢাকা অ্যাটাক’দেখতে। সব মিলিয়ে সিনেমাটা আমাদের ভালো লেগেছে। এমন আরও সিনেমা তৈরি হওয়া দরকার। আমাদের বাসায় বাংলাদেশের শিল্পীদের গানও বাজে সারা দিন। প্রিতম হাসানের যেকোনো গান বের হলে শুধু আমরাই কয়েক হাজারবার দেখে ফেলি। আর ছুটির দিনগুলো শুরু হয় সৈয়দ আব্দুল হাদীর দরাজ কণ্ঠ দিয়ে অথবা কখনো সুবীর নন্দী বা নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী বা লাকী আখন্দ্ বা একেবারে পুরোনো আমলের শচীনকর্তা বা আব্দুল আলীমকে দিয়ে। গান ছেড়ে দিয়ে আমরা আমাদের প্রাত্যহিক কাজকর্ম চালিয়ে যাই।
সিনেমা শেষ করে সবাই ঘুমাতে গেলে আমি পেছনের দরজা খুলে আস্তে করে বাইরে গিয়ে দেখি, চাঁদমামা একেবারে মগডালে উঠে পড়েছে। আমাকে দেখে বলল, ঘুমাবি না! আমি বললাম, ‘তোমার জ্বালায় কী আর ঘুমানোর উপায় আছে! তোমার মায়াবী আলোয় মনের মধ্যে প্রেমভাব জাগ্রত হয়েছে। ইচ্ছা ছিল কিছুক্ষণ তোমার পাশে বসার, কিন্তু মশা তার প্রেমভাব প্রকাশ করতে শুরু করেছে, তাই এক্ষুণি ভেতরে যেতে হবে। তুমি পৃথিবী পাহারা দাও, সকালে দেখা হবে। ভোরে ঘুম থেকে উঠে নাকে–মুখে তৈরি হয়ে ঘর থেকে বের হতেই দেখি, চাঁদমামা আমাকে দেখে মুচকি হাসছে আবার। জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, ঘুম কেমন হলো? আমি বললাম, মামা, ইদানীং গভীর ঘুম হয়। মনে হয় বয়স বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ। ততক্ষণে চাঁদমামার জৌলুসও ফিকে হয়ে এসেছে। কারণ, পুব আকাশে সুয্যিমামার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আমি বললাম, মামা ভালো থাকো, আমি দৌড় শুরু করি। এরপর আমি মিন্টো স্টেশনের দিকে ড্রাইভ করা শুরু করলাম আর চাঁদমামা পশ্চিমের গাছগুলোর আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। আবার তার সঙ্গে দেখা হবে পরের রাতে, হবে আলাপ, হবে মান–অভিমান। আপনি মানুষের পাশাপাশি যদি মহাজাগতিক কোনো কিছুর সঙ্গে বন্ধুত্ব করে ফেলেন, তাহলে জীবন থেকে কখনোই আনন্দের উপকরণগুলো হারিয়ে যাবে না। কারণ, জীবনে মানুষ বদলালেও প্রকৃতি, আকাশ, বাতাস, চন্দ্র–সূর্যের পরিবর্তন হয় না। তারা আপনাকে ঠিকই নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে যাবে, যত দিন আপনি বেঁচে থাকবেন।