নতুন ধরন নিয়ে সতর্ক বাংলাদেশ

দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ স্থগিত করার ঘোষণা। বিমানবন্দর, স্থলবন্দর বা দেশের সব প্রবেশপথে স্ক্রিনিং আরও জোরদার করার জন্য নির্দেশনা।

টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের করোনার টিকা প্রদান শুরু হয়েছে। ভিড় ঠেলে টিকা দিতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন কেউ কেউ। গতকাল দুপুরে মির্জাপুর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনের বাইরে

করোনাভাইরাসের নতুন ধরন (ভেরিয়েন্ট) ১১টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। সংক্রমণ প্রতিরোধে বিভিন্ন দেশ আন্তর্জাতিক চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা শুরু করেছে। সতর্কতা হিসেবে বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ স্থগিত করার ঘোষণ দিয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সময় নষ্ট না করে স্বাস্থ্য বিভাগকে মাঠে নামতে হবে।

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ কমে এলেও নতুন ধরনের উদ্ভব ও তা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি ছিল। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, ৯ নভেম্বর দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনার নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’ শনাক্ত হয়। বিজ্ঞান সাময়িকী নেচার বলেছে, নতুন ধরনটি প্রথম শনাক্ত হয়েছে আফ্রিকার দেশ বতসোয়ানায়।

গত বছর অক্টোবরেও ভারতে নতুন একটি ধরন শনাক্ত হয়েছিল। ‘ডেলটা’ নামের ওই ধরন অতি দ্রুত বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। ডেলটা ধরন বাংলাদেশে শনাক্ত হয় এ বছর ৮ মে। প্রথম শনাক্ত হওয়া ব্যক্তি ভারতফেরত ছিলেন।

এ পর্যন্ত আফ্রিকার ছয়টি দেশসহ হংকং, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ইসরায়েলে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন শনাক্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানিয়েছে, সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে ইউরোপের প্রায় প্রতিটি দেশ আফ্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ স্থগিত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে ফ্লাইট বাতিল করেছে। একই পথ বেছে নিয়েছে জাপান ও সিঙ্গাপুর।

করোনার নতুন ধরনকে ‘উদ্বেগজনক’ বলে আখ্যায়িত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

আফ্রিকার নতুন ধরনটি সম্পর্কে স্বাস্থ্য বিভাগ সতর্ক আছে বলে উল্লেখ করেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গতকাল সুইজারল্যান্ডে যাত্রার আগে গণমাধ্যমে পাঠানো এক বার্তায় তিনি বলেন, এই ভাইরাসটি খুবই আগ্রাসী। সে কারণে আফ্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ এখন স্থগিত করা হচ্ছে। সব বিমানবন্দর, স্থলবন্দর বা দেশের সব প্রবেশপথে স্ক্রিনিং আরও জোরদার করার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

হাসপাতালে রোগী ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করতে হবে। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নতুন ধরন আসার জন্য বসে থাকা উচিত হবে না। সময় নষ্ট না করে স্বাস্থ্য বিভাগকে মাঠে নামতে হবে।
আবু জামিল ফয়সাল, জনস্বাস্থ্যবিদ

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কী বলেছে

২৬ নভেম্বর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এক বিবৃতিতে বলেছে, নতুন ধরনটি নিয়ে এ পর্যন্ত মূল্যায়নে দেখা যায় আগের ধরনগুলোর চেয়ে নতুন ধরনটির ছড়িয়ে পড়ার গতি দ্রুততর। এর অর্থ হচ্ছে নতুন ধরনের মাধ্যমে সংক্রমণ ব্যাপক হওয়ার আশঙ্কা আছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সদস্যদেশগুলোকে চারটি পদক্ষেপ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে: নজরদারি জোরদার করার পাশাপাশি নতুন ধরনটি সম্পর্কে জানতে জিন বিশ্লেষণ করতে হবে; পূর্ণাঙ্গ জিন বিশ্লেষণের তথ্য সর্বসাধারণের জানার জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে; নতুন রোগী শনাক্ত হলে বা সংক্রমণ গুচ্ছ আকার ধারণ করলে তা বিশ্ব সংস্থাকে জানাতে হবে এবং নতুন ধরনের সংক্রমণের তীব্রতা, রোগনির্ণয় পদ্ধতিসহ বিদ্যমান জনস্বাস্থ্য ও সামাজিক উদ্যোগের কার্যকারিতা বোঝার জন্য কাজে সমন্বয় বাড়াতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আরও বলেছে, মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, ভিড় এড়িয়ে চলার পাশাপাশি টিকা নেওয়া অব্যাহত রাখতে হবে।

সরকার কী করছে

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনাবিষয়ক কমিটিগুলো নিয়মিত বৈঠক করে না বা সভা ডাকা হয় না। আট সদস্যের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সর্বশেষ সভা হয়েছিল গত বছর অক্টোবর মাসে। অন্যদিকে রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটির সর্বশেষ
সভা হয় এ বছর ফেব্রুয়ারিতে। এসব কমিটি করোনাবিষয়ক বৈজ্ঞানিক তথ্য ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের পাশাপাশি সরকারকে নানা বিষয়ে পরামর্শ দিত।

নতুন ধরন মোকাবিলার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পয়েন্ট অব এন্ট্রি বা বিদেশ থেকে বাংলাদেশে ঢোকার নির্দিষ্ট স্থানগুলোতে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা আছে। সেসব স্থানে পরীক্ষা জোরদার করার মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে নির্দেশ এলে সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি আজ রোববার সভা করবে বলে জানিয়েছেন কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ সহিদুল্লা। এই সভায় নতুন পরিস্থিতিতে সরকারের করণীয় বিষয়ে আলোচনা হবে।

ভাইরাসের নতুন ধরন বা নতুন রোগী শনাক্তে বড় ভূমিকা আছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর)। আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘নমুনা পরীক্ষা চলমান। সেসব নমুনা থেকে নিয়মিতভাবে জিন বিশ্লেষণ করা হয়। আশা করি নতুন ধরন এলে আমরা দ্রুততম সময়ে শনাক্ত করতে পারব।’

দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের তথ্য জানানো হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। দেশে এ পর্যন্ত ১৫ লাখ ৮৫ হাজার ৫৭৯ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন ২৭ হাজার ৯৭৫ জন। গতকাল শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সর্বশেষ দুজন মারা যাওয়ার কথা জানিয়েছে। গতকাল নমুনা পরীক্ষার তুলনায় রোগী শনাক্তের হার ১ দশমিক ১৫ শতাংশ। সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে আসার এই সময়ে করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের তথ্য জানাল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটির সদস্য জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশ থেকে দেশে প্রবেশের স্থানগুলোতে রোগ শনাক্তকরণ ব্যবস্থা জোরদার করার পাশাপাশি কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ), আইসোলেশন (বিচ্ছিন্নকরণ) ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। হাসপাতালে রোগী ব্যবস্থাপনা আরও উন্নত করতে হবে। মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। নতুন ধরন আসার জন্য বসে থাকা উচিত হবে না। সময় নষ্ট না করে স্বাস্থ্য বিভাগকে মাঠে নামতে হবে।