প্রসিদ্ধ চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য সাময়িকী দ্য ল্যানসেট করোনা পরীক্ষা নিয়ে বাংলাদেশের সমালোচনা করেছে। ল্যানসেট বলেছে, নমুনা পরীক্ষা ও নজরদারি বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি করোনা মোকাবিলাকে বাধাগ্রস্ত করছে। সাময়িকীটি মনে করে, মূল্য নির্ধারণের কারণে নমুনা পরীক্ষা কমেছে।
‘বাংলাদেশের কোভিড-১৯ পরীক্ষা সমালোচিত (বাংলাদেশস কোভিড-১৯ টেস্টিং ক্রিটিসাইজড)’ শিরোনামের এক পৃষ্ঠার প্রতিবেদন গতকাল শনিবার ল্যানসেটের অনলাইন সংস্করণে ছাপা হয়েছে। প্রতিবেদনে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান, জনস্বাস্থ্য গবেষণাবিষয়ক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এমিনেন্সের প্রধান শামীম তালুকদারসহ একজন চিকিৎসকের বক্তব্য ছাপা হয়েছে। চেষ্টা করেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো বক্তব্য পায়নি ল্যানসেট।
মহামারির শুরু থেকে বিভিন্ন দেশের করোনাবিষয়ক বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশ করছে ল্যানসেট। টিকা ও ওষুধ নিয়ে নানা গবেষণা প্রবন্ধও তারা নিয়মিত ছাপছে। ল্যানসেট–এ ছাপা তথ্য ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ব্যবহার করছে বিভিন্ন দেশের সরকার, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় নানা প্রতিষ্ঠান ও ওষুধ কোম্পানি।
ল্যানসেটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৬ কোটি ৮০ লাখ নাগরিকের দেশে দৈনিক ১২ থেকে ১৫ হাজার নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। করোনা পরীক্ষায় ফি নির্ধারণের কারণে দৈনিক প্রতি এক হাজার মানুষের ক্ষেত্রে দশমিক ৮টি নমুনা পরীক্ষা কমেছে।
‘অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা’ এড়ানোর জন্য সরকার জুনের শেষে করোনার নমুনা পরীক্ষায় ২০০ টাকা করে ফি নির্ধারণ করে। বাড়ি থেকে নমুনা সংগ্রহে ৫০০ টাকা মূল্য নির্ধারণ করা হয়। আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরীক্ষা করালে সাড়ে তিন হাজার টাকা ফি ঠিক করা হয়। পরে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে সরকার ফি কমায়। হাসপাতালে গিয়ে পরীক্ষা করালে ফি ১০০ টাকা। বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করলে ফি দিতে হবে ৩০০ টাকা। ল্যানসেট বলছে, ফি নির্ধারণের পর বাংলাদেশে নমুনা পরীক্ষা আকস্মিকভাবে কমে গেছে।
এমিনেন্সের প্রধান শামীম তালুকদার ল্যানসেটকে বলেছেন, করোনা মহামারি দেশের ‘অনৈতিক’ স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার চেহারা উন্মোচিত করেছে। তিনি বলেছেন, মহামারির শুরু থেকে সরকার কোভিড-১৯ পরীক্ষাপদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিল। শুরুতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে পরীক্ষা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এখন সরকারি পর্যায়ে পরীক্ষার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে, এর অর্থ হলো পরীক্ষা থেকে দরিদ্ররা বাদ।
ঢাকার একাধিক কবরস্থান ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে শামীম তালুকদার ল্যানসেটকে বলেছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত সংখ্যার চেয়ে করোনায় মৃত্যু কমপক্ষে চার গুণ বেশি বলে কবরস্থানের ব্যবস্থাপকেরা তাঁকে জানিয়েছেন। অনেকে করোনায় মারা গেছেন, কিন্তু তাঁদের করোনা পরীক্ষা হয়নি অথবা মৃত্যুর আগে পরীক্ষার ফলাফল জানা যায়নি।
আইইডিসিআরের সাবেক পরিচালক ও করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান ল্যানসেটকে বলেছেন, পরীক্ষার জন্য ফি নির্ধারণ বাস্তবিকই সমস্যা সৃষ্টি করেছে, বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের জন্য। মহামারির সময় মানুষের কাজ নেই, তাঁদের হাতে অর্থ নেই, তাঁরা ব্যাপক অসুবিধার মধ্যে আছেন...পরীক্ষার জন্য সরকারের ফি নির্ধারণ কর উচিত নয়। পরীক্ষার ফলাফলে বিলম্বসহ আরও কিছু সমস্যার উল্লেখ করে মাহমুদুর রহমান বলেন, স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা খুবই কম।
জুলাই মাসে জেকেজি ও রিজেন্ট হাসপাতালের দুর্নীতি নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হয়। এসব ঘটনারও ইঙ্গিত আছে ল্যানসেটের প্রতিবেদনে। কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির নাম উল্লেখ না করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ পরীক্ষার বিপুল পরিমাণ ভুয়া সনদ দেওয়ার কারণে মধ্য জুলাইয়ে একটি বেসরকারি হাসপাতালের মালিককে গ্রেপ্তার করা হয়। এই ঘটনা দেশের অনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তি খাতের ওপর আলো ফেলে।
ল্যানসেটের প্রতিবেদনের বিষয়ে মন্তব্য জানার জন্য গতকাল বিকেলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যোগাযোগ করে প্রথম আলো। একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বলেছেন, তিনি প্রতিবেদনটি পড়েছেন। তবে কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।
নাম ও পরিচয় গোপন রেখে ল্যানসেট একজন চিকিৎসকের বক্তব্য প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে। ওই চিকিৎসক বলেছেন, ‘এই মহামারি দীর্ঘ সময়ের জন্য থাকবে। আমি এই ভেবে ভীত যে কখন বাংলাদেশে শীতকাল আসবে। মানুষজন ভীত।’ অনেকের আশঙ্কা, শীতকালে করোনা সংক্রমণ বাড়তে পারে।