খুব কাছের মানুষটিও যখন করোনার সংক্রমণের ভয়ে স্বজনকে ফেলে চলে গেছেন, তখন পরম মমতায় তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন চিকিৎসকেরা। বেশির ভাগ মানুষ যখন ঘরবন্দী, তখন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিরামহীনভাবে রোগীদের সেবা দিয়ে গেছেন তাঁরা।
অন্যকে বাঁচাতে নিজের জীবনকে তুচ্ছ ভেবেছেন। পর্যাপ্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা না নিয়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একের পর এক চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। একই সঙ্গে চিকিৎসকদের মৃত্যুর তালিকাও দীর্ঘ হয়েছে। গতকাল সেই সংখ্যা ১০০ হয়েছে।
ডা. সেলিম আহমেদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে চিকিৎসকদের মৃত্যুর তালিকা ১০০ স্পর্শ করল। করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে বা করোনার উপসর্গ নিয়ে গত সাড়ে ছয় মাসে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে।
করোনায় দেশে প্রথম চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছিল ১৫ এপ্রিল। ওই দিন মারা গিয়েছিলেন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মঈন উদ্দীন আহমদ (৪৭)। ডা. মঈন উদ্দীন আহমেদ করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়েই সংক্রমিত হয়েছিলেন। ঢাকার একটি হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর খবরে চিকিৎসক সমাজসহ সব পেশাজীবী শ্রেণি ও সাধারণ মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে আসে।
চিকিৎসকদের মৃত্যুর তালিকায় যোগ হওয়া সবশেষ নামটি ডা. সেলিম আহমেদের। বৃহস্পতিবার বেলা তিনটার দিকে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন। ডা. সেলিম আহমেদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে চিকিৎসকদের মৃত্যুর তালিকা ১০০ স্পর্শ করল। করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে বা করোনার উপসর্গ নিয়ে গত সাড়ে ছয় মাসে তাঁদের মৃত্যু হয়েছে।
অল্প সময়ের ব্যবধানে এভাবে এত চিকিৎসকের মৃত্যু দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউজিসির অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ।
করোনায় আমরা অনেক বিশেষজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ চিকিৎসককে হারিয়েছি। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তৈরি হতে অনেক সময় ও শ্রমের প্রয়োজন হয়। তাঁরা দেশের সম্পদ। কষ্টের মধ্যেও গর্বের বিষয় হচ্ছে, জীবনের ঝুঁকি রয়েছে জেনেও সম্মুখসারির এই যোদ্ধারা পিছপা হননি, নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন।অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ
ডা. আবদুল্লাহ মহৎ এই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যেসব চিকিৎসক মারা গেছেন, তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করেন।
করোনায় রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, পুলিশ, সাংবাদিক, সরকারি কর্মকর্তাসহ সব শ্রেণির সব বয়সী মানুষের মৃত্যু দেশের জন্য বড় ক্ষতি। তবে চিকিৎসক, নার্স বা অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর মৃত্যু সমাজকে নাড়া দিয়েছে। কারণ সংক্রমণ প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় তাঁদের দায়িত্ব সবচেয়ে বেশি।
দেশে করোনায় প্রথম মৃত্যু হয় ১৮ মার্চ। তার ১ মাস পর ১৮ এপ্রিল জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মাহমুদ মনোয়ার ফেসবুকে লেখেন, ‘একজনের মৃত্যু একটি ট্র্যাজেডি। যখন মৃত্যুসংখ্যা লাখ ছাড়ায়, তখন তা শুধুই পরিসংখ্যান। চিকিৎসকেরা এই পরিসংখ্যানের অংশ হওয়ার চেষ্টা কোরো না।নিরাপদ থাকার চেষ্টা কোরো।’
তবে ফেসবুকে ওই স্ট্যাটাস দেওয়ার দুই মাসের মধ্যে করোনার কাছে হার মানেন ডা. মাহমুদ মনোয়ার। গত ১২ জুন তিনি মারা যান।
এই তালিকায় সম্ভাবনায় নবীন চিকিৎসক যেমন আছেন, তেমনি আছে নানা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। অনেকেই ছিলেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের নাম করা অধ্যাপক। চিকিৎসাসেবা ও চিকিৎসা শিক্ষার অগ্রগতিতে অনেকেরই আছে অসামান্য অবদান। এসব চিকিৎসকের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৮ জুন বিশেষ আয়োজনে বের হয় প্রথম আলো।
শুধু জুন মাসেই মারা গেছেন ৪৫ জন চিকিৎসক; যা মোট মৃত্যুর প্রায় ৪৫ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে গত ৪ জুন, ওই দিন ৫ জন চিকিৎসক মারা যান, যা এক দিনে সর্বোচ্চসংখ্যক চিকিৎসক মৃত্যুর ঘটনা।
চিকিৎসকেরা করোনা মোকাবিলায় সামনের সারির যোদ্ধা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মহামারির শুরু থেকে চিকিৎসকসহ সব ধরনের স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষায় বিশেষ নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছে। সংস্থাটি বলেছে, স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে অন্য সবার সুরক্ষা নিশ্চিত হবে না।
চিকিৎসকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, ডা. সেলিম আহমেদ ১৯৯৭-৯৮ সালে বিএমএর কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ছিলেন। কর্মজীবনে দীর্ঘ সময় ইরানে কাটিয়েছেন, এরপর দেশে ফিরে নিয়মিত রোগী দেখতেন।
এই চিকিৎসকের স্মৃতিচারণা করে বিএমএর সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ডা. সেলিম আহমেদ ও তিনি একসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ালেখা করেছেন। তাঁরা একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভরতে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। প্রশিক্ষণ শেষে সেলিম আহমেদ রাজবাড়ীতে (তাঁর গ্রামের বাড়ি) যুদ্ধে অংশ নিতে চলে যান।
দুঃসহ জুন
জুন মাসটি ছিল চিকিৎসক ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জন্য দুঃসহ। জুনে প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো এলাকা থেকে এসেছে চিকিৎসকের মৃত্যুর খবর। বিএমএর তথ্য অনুযায়ী, শুধু জুন মাসেই মারা গেছেন ৪৫ জন চিকিৎসক; যা মোট মৃত্যুর প্রায় ৪৫ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি চিকিৎসকের মৃত্যু হয়েছে গত ৪ জুন, ওই দিন ৫ জন চিকিৎসক মারা যান, যা এক দিনে সর্বোচ্চসংখ্যক চিকিৎসক মৃত্যুর ঘটনা।
এরপর ওই মাসের ১২ ও ১৭ তারিখে ৪ জন করে এবং ৩, ৮, ২০ ও ২৪ তারিখে ৩ জন করে চিকিৎসক মারা গেছেন।
এক মাসে এত চিকিৎসকের মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিএমএর দপ্তর সম্পাদক ডা. মোহা. শেখ শহীদ উল্লাহ প্রথম আলোকে জানান, মূলত ওই সময়ে সংক্রমণ প্রতিরোধে নানা ধরনের অব্যবস্থাপনা ছিল। পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সামগ্রী (পিপিই) ও মানসম্মত মাস্কের সংকট ছিল। পাশাপাশি এগুলো ব্যবহারেও অসচেতনতা ছিল। যে কারণে জুন মাসে বেশিসংখ্যক চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন এবং মৃত্যুর ঘটনাও বেশি ঘটেছে।
মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা কমেছে
আশার কথা হচ্ছে, গত ছয় মাসের মধ্যে এই অক্টোবর মাসে সবচেয়ে কমসংখ্যক চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যুর ঘটনাও কম। বিএমএর তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাস থেকে চিকিৎসক মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে, তবে বন্ধ হয়নি। জুলাই মাসে ১৫, আগস্টে ১২, সেপ্টেম্বরে ৮ ও অক্টোবরে (২৯ তারিখ পর্যন্ত) ৭ জন চিকিৎসক মারা গেছেন।
বিএমএর তথ্য বলছে, গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে ২ হাজার ৮৫৩ জন চিকিৎসক করোনায় সংক্রমিত হয়েছেন। এর মধ্যে এপ্রিল মাস পর্যন্ত আক্রান্ত হন ৩৯২ জন।
জুন মাসে ৮৪২, জুলাইয়ে ৮৯৫ ও আগস্টে ৫৫৯ জন চিকিৎসক আক্রান্ত হন। সেপ্টেম্বর মাস থেকে চিকিৎসকদের মধ্যে সংক্রমণ কমতে থাকে। ওই মাসে সারা দেশে ১৩৮ জন চিকিৎসক করোনায় সংক্রমিত হন। আর চলতি মাসে (২৯ অক্টোবর) ২৭ জন চিকিৎসক আক্রান্ত হয়েছেন।
বিএমএর সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, আগে এই রোগ সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা ছিল না, এখন চিকিৎসকেরা অনেক কিছুই জানেন। তাঁরাও সচেতন হয়েছেন—এ জন্য চিকিৎসকদের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা কমেছে। এতে রোগীরাও আগের চেয়ে ভালো সেবা পাচ্ছেন।