সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি আপাতত আর হচ্ছে না। তবে টিকাদান বাড়ানোর চিন্তা আছে স্বাস্থ্য বিভাগের।
মানুষের আগ্রহের সঙ্গে তাল মিলিয়ে করোনার টিকা দিতে পারছে না স্বাস্থ্য বিভাগ। নিবন্ধন করে টিকার অপেক্ষায় আছে দেড় কোটির বেশি মানুষ। নিবন্ধন করা মানুষের সংখ্যা যত বাড়ছে, টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রে অব্যবস্থাপনার বিষয়টি তত বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, প্রস্তুতি ও ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে এমন হচ্ছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার করোনা টিকার সম্প্রসারিত কর্মসূচি শেষ হয়েছে। কর্মসূচির ছয় দিনে ৫৫ লাখ ৬৬ হাজারের বেশি মানুষ টিকা পেয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেছেন, আপাতত এ ধরনের কর্মসূচির মাধ্যমে টিকাদান বাড়ানোর পরিকল্পনা নেই। তবে স্বাস্থ্য বিভাগ করোনা টিকাদানের পরিমাণ বাড়ানোর চিন্তা করছে।
কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রসারিত কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল মূলত দুটি। প্রথমত অল্প সময়ে বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া। দ্বিতীয়ত তুলনামূলকভাবে গ্রামের যেসব মানুষের টিকা নেওয়ার প্রয়োজন বেশি, তাঁদের টিকা দেওয়া। প্রাথমিকভাবে সেই উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে।
৭ আগস্ট থেকে দেশব্যাপী করোনা টিকার সম্প্রসারিত কর্মসূচি শুরু করে স্বাস্থ্য বিভাগ। ছয় দিনে নিয়মিত করোনা টিকাকেন্দ্রের বাইরে ৪ হাজার ৬০০ ইউনিয়ন, ১ হাজার ৫৪টি পৌরসভার ওয়ার্ড এবং ১২টি সিটি করপোরেশনের ৪৩৩টি ওয়ার্ডে টিকাকেন্দ্রে করোনার টিকা দেওয়া হয়। এ ছাড়া কক্সবাজার জেলার শিবিরে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গাকে এ সময় টিকা দেওয়া হয়েছে।
গত ছয় দিনে অনেক টিকাকেন্দ্রে উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে, বৃষ্টি-কাদা-পানি উপেক্ষা করে মানুষ টিকা নিয়েছেন। কেন্দ্রের সামনে রাতভর অপেক্ষা করে পরদিন টিকা নেওয়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। মানুষের আগ্রহ দেখে জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, টিকার কার্যকারিতা নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ বা দ্বিধা নেই। মহামারি বিষয়ে সচেতনতা টিকা নেওয়ার ব্যাপারে মানুষকে আগ্রহী করে তুলেছে। তবে ইচ্ছা থাকলেও বহু মানুষ টিকা নিতে পারেননি।
জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগ মানুষের মধ্যে টিকার ব্যাপারে চাহিদা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। তবে মানুষের সাড়া কী হতে পারে, সে ব্যাপারে ধারণা ছিল না, তারা বুঝে উঠতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে মানুষ বাঁকা পথে টিকা নিতে চাইবে, এতে অনিয়ম দেখা দেওয়ার আশঙ্কা আছে।
আইসিটি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, গতকাল সন্ধ্যার পর নিবন্ধন করা মানুষের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ১৫ লাখ। এর মধ্যে ১ কোটি ৫৩ লাখের কিছু বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। টিকা পাওয়ার অপেক্ষায় আছেন ১ কোটি ৬২ লাখ মানুষ।
সম্প্রসারিত কর্মসূচির ফলে অল্প সময়ে বেশি মানুষকে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে ঠিকই, তবে এই সময়ে নিবন্ধন করে টিকার অপেক্ষায় থাকা মানুষের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে এখন টিকা আছে ৮২ লাখের বেশি। গতকাল স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, আগামী এক সপ্তাহে ৫৪ লাখ টিকা আসবে। এ মাসের শেষ নাগাদ আসবে আরও প্রায় ৫০ লাখ টিকা।
কোভিড-১৯ টিকা ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মীরজাদী সেব্রিনা প্রথম আলোকে বলেন, নিবন্ধন করা সব মানুষকে টিকা দেওয়ার বিষয়টিকে এখন অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। নিয়মিত কেন্দ্রগুলোতে এক বা একাধিক উপকেন্দ্র তৈরি করে দৈনিক টিকা দেওয়ার পরিমাণ বাড়ানোর কথা চিন্তা করা হচ্ছে।
তবে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলেছেন, গত সপ্তাহের মতো সম্প্রসারিত কর্মসূচি খুব শিগগির আর করা হবে না। এই কর্মসূচির আওতায় যাঁদের প্রথম ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে, তাঁদের সেপ্টেম্বর মাসে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হবে। সেই সময় টিকা দেওয়ার পরিমাণ বাড়বে।
রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা জামিল বিন সিদ্দিক টিকার জন্য কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী সরকারি হাসপাতাল কেন্দ্রে নিবন্ধন করেছেন ২৪ জুলাই। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত টিকা নেওয়ার তারিখের বিষয়ে কোনো খুদে বার্তা তাঁর মুঠোফোনে আসেনি। একজন গৃহিণী এক মাস আগে সাভার উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিবন্ধন করে গতকাল রাত পর্যন্ত টিকা নেওয়ার তারিখ জানতে পারেননি।
অভিযোগ আরও আছে। একজন প্রবাসী শ্রমিক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ কেন্দ্র থেকে মডার্নার টিকা নিয়েছেন। টিকা কার্ডে মডার্নাই লেখা আছে। কিন্তু আইসিটি বিভাগের ওয়েবসাইট থেকে তিনি যে সনদ সংগ্রহ করেছেন, তাতে সিনোফার্মের টিকার নাম লেখা আছে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ এই প্রবাসী শ্রমিককে বলেছে, এই ভুল তারা সংশোধন করতে পারবে না। ওই শ্রমিকের বিদেশ যাওয়া আটকে আছে।
সাতক্ষীরার এক গৃহিণী প্রথম আলোকে বলেছিলেন, তিনি নির্ধারিত দিনে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ কেন্দ্রে গিয়ে টিকা নিতে পারেননি। কিন্তু তিনি টিকা নিয়েছেন এমন খুদে বার্তা তাঁর মুঠোফোনে এসেছে। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ কেন্দ্র থেকে তাঁর স্ত্রী দুই ডোজ টিকা নির্দিষ্ট সময়ে নিয়েছেন। কিন্তু ওয়েবসাইট থেকে তিনি সনদ সংগ্রহ করতে পারছেন না। এ রকম উদাহরণ বহু আছে। নিবন্ধন বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের অভিযোগও বাড়তে থাকবে—এমন আশঙ্কা করছেন অনেকেই।
অন্যদিকে সম্প্রসারিত কর্মসূচি চলাকালে টিকাকেন্দ্রগুলোতে নানা ধরনের অব্যবস্থাপনার অভিযোগ উঠেছে। এসব অভিযোগ বেশি শোনা গেছে শহরের ওয়ার্ডভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে। কেন্দ্রগুলোতে দৈনিক বরাদ্দ ছিল ৩০০ বা ৩৫০ ডোজ টিকা। কিন্তু কোনো কোনো কেন্দ্রে কয়েক হাজার মানুষ টিকা নেওয়ার জন্য ভিড় করেছেন। গণটিকাকরণের শুরুতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলেছিল, টিকা নেওয়ার পর কেন্দ্রেই ২০ থেকে ৩০ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে, কেন্দ্রে অপেক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। অধিকাংশ ওয়ার্ডভিত্তিক এসব কেন্দ্রে সেই ব্যবস্থা ছিল না।
এমন অব্যবস্থাপনা প্রস্তুতির অভাবেই ঘটছে বলে জনস্বাস্থ্যবিদেরা অভিযোগ করছেন। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা বলছেন, বৈশ্বিক উদ্যোগ কোভাক্স ফাইজারের ৬০ লাখ টিকা দেওয়ার জন্য তৈরি। কিন্তু নির্দিষ্ট তাপমাত্রার সংরক্ষণ ব্যবস্থার প্রস্তুতি নেই বলে ফাইজারের সব টিকা বাংলাদেশ নিতে পারছে না।