গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের র্যাপিড টেস্টিং কিট নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে। খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এই পদ্ধতি গ্রহণ করেনি। বিশ্বের কোথাও এটা ব্যবহার করা হচ্ছে না। বিপক্ষ মহল গণস্বাস্থ্যের কিট নিয়ে অসত্য তথ্য দিচ্ছে কিনা সেই প্রশ্ন উঠেছে। সর্বশেষ পরিস্থিতি ও তথ্য সম্পর্কে তারা কতটা অবগত সেই প্রশ্নও রয়েছে।
প্রথম কথা হচ্ছে কোনো প্রযুক্তিকেই পুরোপুরি ভুল বা সফল বলে চিহ্নিত করার সুযোগ নেই। র্যাপিড টেস্টিং কিটের পক্ষে অনেক যুক্তি উপস্থাপন করা যাবে। আবার এর বিপক্ষেও যুক্তির অভাব হবে না। এরপরও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ র্যাপিড টেস্টিং কিট ব্যবহার করে। আফ্রিকার দেশ সেনেগাল র্যাপিড টেস্টিং কিট ব্যবহার করছে। কিট তৈরি করেছে মাত্র এক ডলার খরচ করে। করোনা শনাক্তে এই কিট তারা ব্যবহার করছে। সেনেগালের যে কেউই চাইলে নিজের করোনা পরীক্ষা করতে পারছেন। এর সুফলও পাচ্ছে সেনেগাল। আক্রান্তের হার খুব বেশি না। দ্রুতই আক্রান্ত ব্যক্তিকে পৃথক করে ফেলা যাচ্ছে। আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে সেনেগালে সুস্থ হওয়ার হার সব থেকে বেশি। আরা সারা বিশ্বে তৃতীয়। ইবোলা ও এইডস মোকাবিলায়ও সেনেগাল একই পদ্ধতি ব্যবহার করে সফল হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা সেনেগাল এখন করোনা মোকাবিলায় প্রয়োগ করছে।
কিট তৈরি করেই থেমে যায়নি সেনেগাল। সেনেগালের প্রকৌশলীরা মাত্র ৬০ ডলার ব্যয় করে ভেণ্টিলেটর মেশিন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। যেখানে বিদেশ থেকে একটি ভেন্টিলেটর আমদানি করতে ব্যয় হয় ১৬ হাজার ডলার। সেনেগালের এই উদ্ভাবন নিয়ে সারা বিশ্বের গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে আফ্রিকান সংবাদপত্রগুলোতে এর ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে। র্যাপিড টেস্টিং কিট কার্যকর না বা সেনেগালে সঠিক ফলাফল দিচ্ছে না অথবা এই পদ্ধতি এখনই বাতিল করতে হবে এমন কোনো তথ্য বা সংবাদ নজরে আসেনি। এশিয়ান পোস্টের তথ্যানুসারে ভিয়েতনামেও র্যাপিড টেস্টিং কিট ব্যবহার করা হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ২ লাখ কিট আমদানি করা ছাড়াও নিজস্ব প্রযুক্তিতে কিট তৈরি করেছে যা দিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে ভাইরাস শনাক্ত করা সম্ভব।
বিশ্বের কোথাও কারোনা শনাক্তে র্যাপিড টেস্টিং কিট ব্যবহার করা হচ্ছে না বা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন নেই— এমন বক্তব্যের মধ্যে সত্যতা নেই। বরং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২৪ এপ্রিলের এক সায়েন্টিফিক ব্রিফিংয়ে জানাচ্ছে, বিভিন্ন দেশ করোনা শনাক্তে র্যাপিড টেস্টিং কিট ব্যবহার করছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এই ধরনের পরীক্ষাকে সমর্থন করে এবং এই পদ্ধতি রোগের বিস্তার ও গতিপ্রকৃতি বুঝতে সহায়তা করে।
প্রযুক্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলেছি। এদের মধ্যে একজন হচ্ছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ও বন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্ল্যান্ট সেল বায়োলজি বিভাগের পিএইচডি গবেষক শাকিল মাহমুদ। আলাপকালে তিনি বলেন, র্যাপিড টেস্টিং কিট ভাইরাস শনাক্তে প্রচলিত একটি পদ্ধতি। তবে এরপর নতুন নতুন প্রযুক্তি বের হয়েছে। সার্স ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় র্যাপিড টেস্টিং কিট বহুল ব্যবহৃত পদ্ধতি ছিল। তবে কখন কোন প্রযুক্তি ও পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে তা নির্ভর করে আর্থিক সামর্থ্য ও জনবলের দক্ষতার ওপর। তাই কোনো পদ্ধতিকেই একেবারে বাতিল করার সুযোগ নেই।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের জার্নাল ল্যানসেটে ২০১৫ সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে গিনি, সিয়েরালিওন ও লাইবেরিয়ায় ইবোলা ভাইরাস শনাক্তে অ্যান্টিজেন র্যাপিড টেস্টিং কিট ও পিসিআর পদ্ধতি ব্যবহার করে একই ফলাফল পাওয়া গিয়েছে। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুইটি পিসিআরে একই নমুনা পরীক্ষার পর ভিন্ন ফল মিলেছে। তাই পিসিআর পদ্ধতিও যে নির্ভুল তা বলা যাবে না। কিছু কিছু দেশ আবার পিসিআর প্রযুক্তি থেকে আরও এগিয়েছে। জার্মানিতে করোনা শনাক্তে জিনোম সিকোয়েন্স পদ্ধতি ব্যবহার করছে। এই পদ্ধতিতে মানবদেহে করোনা ভাইরাসের আরএনএ-র উপস্থিতি খুঁজে দেখা হয়। বিশেষজ্ঞদের দাবি, জিনোম সিকোয়েন্স সর্বাধুনিক ও অনেক বেশি নির্ভুল ফলাফল দেয়। এখন পিসিআর পদ্ধতি পুরোনো বলে বাতিল করার দাবি সুবিবেচনার পরিচয় হবে না। একই সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে জিন নির্ণয় পদ্ধতির ব্যয় বহন করা সবার পক্ষে সম্ভব কিনা। জিন প্রযুক্তির পর নতুন নতুন প্রযুক্তি অবশ্যই আসবে। তাই বলে তখন জিনোম সিকোয়েন্স পদ্ধতি বাতিল করে দিতে হবে এমন কোনো কথা নেই।
মূল বিষয় হচ্ছে, নতুন, পুরোনো বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি থাকবে। এসব নিয়ে মতভিন্নতাও থাকবে। কিন্তু আর্থিক সক্ষমতা, জনবলের দক্ষতা, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। হোয়াইট হাউসের করোনা বিষয়ক মুখপাত্র ড. দেরোবা ব্রিক্স মনে করেন অ্যান্টিজেন শনাক্ত করে সবার করোনা পরীক্ষা করা সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষতা ও সমর্থ নিয়ে প্রশ্ন করার সুযোগ কমই আছে। এরপরও তারা অ্যান্টিজেন পরীক্ষার দিকে ঝুঁকতে চাইছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েছে। বহুল প্রচলিত পিসিআর প্রযুক্তি ব্যবহার করে সবার পরীক্ষা করা সম্ভব না। একই সঙ্গে সেনেগালও পরিস্থিতি অনুধাবন করেছে। তাই আর্থিক সামর্থ্য ও দক্ষতায় ভিন্ন মেরুতে থেকেও উভয় দেশ একই পদ্ধতি অবলম্বন করতে চাইছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সবার পরীক্ষা করা মুখ্য। আর সেনেগালের কাছে আর্থিক সক্ষমতাই বিবেচ্য বিষয়।
এসব দিক বিবেচনা করেই হয়তো গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বল্প মূল্যের কিট তৈরি করেছে। গণস্বাস্থ্যের এই কিট কতটা নির্ভুল ফল দেবে সেটা বলা সময় সাপেক্ষ বিষয়। কিন্তু এই পদ্ধতিকে ভুল বা অকার্যকর বলে উড়িয়ে দেওয়া কোনোভাবেই ঠিক হবে না। বরং এই উদ্যোগকে সবার সহযোগিতা করা প্রয়োজন। এমনকি কিটের কোনো ত্রুটি থাকলে সবাই মিলে সেটাকে উন্নত ও কার্যকর করার উদ্যোগ প্রয়োজন। ধরা যাক গণস্বাস্থ্যের কিটে ত্রুটি আছে। এই ত্রুটি সারাতে সহযোগিতার করতে পারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় বা আইইডিসিআর।
এসব না করে শুরু থেকেই কিট নিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের এক ধরনের বিরোধীতার বা বিষয়টিকে উপেক্ষা করার প্রবনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই কিট ব্যবহার বা পরীক্ষা না করেই আগাম অভিযোগ করা হচ্ছে গণস্বাস্থ্য সঠিক ও কার্যকর কিট তৈরি করতে পারেনি। অভিযোগ রয়েছে, গণস্বাস্থ্যের প্রতিনিধিকে সারা দিন বসিয়ে রেখেও নমুনা দেয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ল্যাবে ঘনঘন বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটেছে। অথচ দেশে এখন বিদ্যুতের চাহিদা কম থাকার কথা। এসব সমস্যা নিরসনে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তদবির করতে হচ্ছে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিট নিয়ে যা হচ্ছে তাতে সরকারের একটি মহলের ক্ষুদ্রতার বিষয়টি ফুটে উঠছে। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিট যদি সত্যিই কার্যকর হয় এবং তাকে সহজলভ্য করা গেলে জনসাধারণের হয়রানি কমবে এবং প্রকৃত সংক্রমণের হারও বোঝা যাবে।
এসব ছাড়াও গণস্বাস্থ্যের কিট অনুমোদন দেওয়ার জন্য বিভিন্ন আইনের কথা বলা হচ্ছে। আইন নিশ্চয়ই মেনে চলতে হবে কিন্তু পরিস্থিতির প্রয়োজনীয়তাও আমলে নিতে হবে। সরকারি উদ্যোগে এই কিট পরীক্ষা করে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে এটা ব্যবহার করা যাবে কি যাবে না। অন্যথায় গুজবের ডালপালা আরও ছড়াবে। তবে সন্দেহ হয়, তিক্ততা যে পর্যায়ে গেছে, সে আশা কম।
ড. মারুফ মল্লিক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক।