বর্তমানে সহজ বৈশ্বিক যোগাযোগ মানুষকে সুযোগ করে দিয়েছে সামাজিক, শিক্ষা এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়ার। এটা যেমন মুদ্রার এপিঠ। ঠিক অপর পিঠেই আছে করোনাভাইরাসের মতো মহামারি সারা বিশ্বে আগের চেয়ে আরও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার মতো নিষ্ঠুর বাস্তবতা। এ রকম মহামারির বিস্তার রোধে তাই দরকার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষ জনবল, সঠিক তথ্য-উপাত্তের বিশ্লেষণ এবং সময়োচিত পদক্ষেপ।
করোনাভাইরাস আসলে কতটা ভয়ংকর সেটা জানা জরুরি। সেটা পরিমাপ করা হয় একটা ভাইরাসের বেসিক রিপ্রোডাকটিভ নম্বরে (R0)।
এই সংখ্যাটি হলো একজন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে গড়ে কয়জন আক্রান্ত হচ্ছে তা। যখন এই সংখ্যা ১–এর বেশি হয়, তখন সেটা মহামারির দিকে যায়। নভেল করোনাভাইরাসে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা বিশ্লেষণ করে আনুমানিক R0 হিসাব করা হয়েছে ২.৯, তবে তা ২.২ থেকে ৪.১ পর্যন্তও হতে পারে (সূত্র ১)।
করোনা তুলনামূলকভাবে ভয়ংকর, কারণ মৌসুমি ফ্লু–এর R0 ১.৫। এই সংখ্যাটা কোনো একটা রিজিয়ন বা দেশের জন্য নির্ণয় করা জরুরি। তাই কোনো একটা দেশের শুরুতে কতজন আক্রান্ত, তার সঠিক তথ্য জানা থাকলে তার ওপর ভিত্তি করে জনস্বাস্থ্য রক্ষায় যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৭ জানুয়ারি গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী উহানে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫০। কিন্তু ইনস্টিটিউট ফর ডিজিজ অ্যান্ড ইমার্জেন্সি অ্যানালিটিকস, ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন ওই সময়ে থাইল্যান্ড এবং জাপানে আক্রান্তের সংখ্যা এবং উহান থেকে কতগুলো ফ্লাইট থাইল্যান্ড এবং জাপান গেছে, এসব থেকে হিসাব করে বের করেছিল আক্রান্তের সংখ্যা হয় ১ হাজার ৭০০।
বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত এ–সংক্রান্ত তথ্য উন্মোচিত করা, যাতে বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে কেউ চাইলে এই ডেটা ব্যবহার করতে পারে। তা ছাড়া এ রকম তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ঠিক করে থাকে কেমন ব্যবস্থা সরকারকে নিতে হবে রোগের বিস্তার রোধ করতে।
ভাইরাসের বিস্তারের জন্য হোস্ট প্রয়োজন এবং নভেল করোনাভাইরাসের হোস্ট হচ্ছে মানুষ। কাজেই সংক্রমণ রোধ করতে হলে প্রথমেই জানতে হবে ভাইরাস কীভাবে ছড়ায়। সার্স ভাইরাসের ক্ষেত্রে এটা নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল যে তা আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যাদের লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছিল, তারাই ছিল মূল উৎস। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে এখনো এটা নিশ্চিত নয় (যারা আক্রান্ত কিন্তু কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায়নি, তারাও ছড়াতে পারে; সূত্র ২)। কাজেই যাদের শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ–সংশ্লিষ্ট উপসর্গ আছে, তাদের থেকে ৬ ফুট দূরে থাকলে এই রোগ ছড়াতে পারে না বলেই বলা হচ্ছে এবং সেভাবেই প্রতিরোধের জন্য ব্যক্তিগত পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার ওপর জোর দিয়ে প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি নিচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু তার সফলতা অনেকটাই আসলে নির্ভর করে পারিপার্শ্বিকতার ওপর।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্লু বিস্তার রোধ নিয়ে একটি পুস্তিকায় দেখানো হয়েছে বিভিন্ন পরিবেশে ফ্লু সংক্রমণের ব্যাপকতা বিভিন্ন। এর মধ্যে সবচেয়ে কম বসতবাড়িতে কেউ আক্রান্ত হলে পরিবারের বাকিদের মধ্যে সংক্রমণের হার ১৩-৩২ শতাংশ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই হার ২৪ শতাংশ। হাসপাতাল বা ক্লিনিক, ছাত্রাবাস বা মিলিটারি ক্যাম্পে আরও বেশি এবং সবচেয়ে বেশি ছড়ায় বিমানে (একজন অসুস্থ রোগী থাকলে ৩ দিনের মধ্যে ৭২ শতাংশ যাত্রী আক্রান্ত হয়েছে বলে গবেষণায় পাওয়া গেছে; সূত্র ৩)।
এ জন্যই সামাজিক দূরত্বায়ন ভাইরাসের বিস্তার রোধে কার্যকরী পদ্ধতি। সামাজিক দূরত্বায়ন বলতে বোঝানো হচ্ছে যারা কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হতে পারে, তাদের চলাচল সীমিত করে দেওয়া। মানে বাসার বাইরে না যাওয়া। যেমন ইতালি পুরো দেশেই মানুষের চলাচল সীমিত করে দিয়েছে। কারা আক্রান্ত হতে পারেন? উত্তর, সবাই। সবাই কি মারা যাবেন? না, সবাই মারা যাবেন না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে এখন পর্যন্ত আক্রান্তের ৩.৪ শতাংশ মারা গেছেন (সূত্র 8)। যাঁরা বেঁচে আছন, তাঁদের দেহের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করে ভাইরাসকে পরাজিত করতে পেরেছে এবং তাঁদের আবার সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
এর মানে কোনো আক্রান্ত এলাকায় তিন ধরনের মানুষ পাওয়া সম্ভব, ১. আক্রান্ত হয়নি ২. আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছে ৩. আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। কোনো এলাকায় যদি সামাজিক দূরত্বায়ন আরোপ করা হয়, ইতালির মতো, তাহলে যারা আক্রান্ত, তাদের সঙ্গে সুস্থ মানুষের যোগাযোগ (প্রায়) বন্ধ করতে হবে এবং কিছু সময় পরে ওরা যখন সেরে উঠতে শুরু করবে, তখন ওই এলাকা ভাইরাসমুক্ত হতে থাকবে। কিন্তু যদি কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে সামাজিক দূরত্বায়ন মেনে চলার জন্য জনসাধারণকে সচেতন করা বা আইন প্রয়োগ করা না হয়, তাহলে প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের যোগাযোগে সবাই আক্রান্ত হবে এবং খুবই কাছাকাছি সময়ের মধ্যে। ফলে স্থানীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর হঠাৎ চাপ পড়বে এবং এতে অনেক বেশি লোক চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবে এবং ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হবে। কিছু পরিসংখ্যান দেখুন, প্রতি ১ হাজার জনের জন্য বাংলাদেশে হাসপাতালের বেড আছে ০.৮টি, চিকিৎসক ০.৫ জন এবং নার্স এবং ধাত্রী ০.৩ জন (সূত্র ৫)।
ইতালির ক্ষেত্রে এই সংখ্যা ২.৮টি, ৪.১ জন চিকিৎসক এবং ৫.৯ জন নার্স এবং ধাত্রী। আজকের দ্য টেলিগ্রাফের খবর ইতালিতে ৮০ বছরের বেশি বয়স্ক এবং যাদের স্বাস্থ্য খারাপ, তাদের আইসিইউ ব্যবহার করতে না দিয়ে কম বয়সীদের দেওয়া হবে মর্মে নীতিমালা তৈরি করছে তুরিনের সংকট মোকাবিলায় গঠিত কমিটি।
বাংলাদেশে মোট আইসিইউর সংখ্যা সরকারি ২৫০ এবং প্রাইভেট ২৫০। এমনিতেই সবগুলোতে রোগী ভর্তিই থাকে। কাজেই এই করোনা মৌসুমে সামাজিক দূরত্বায়ন বজায় রাখুন এবং নিজে তথা পরিবার বিশেষ করে যারা বয়স্ক এবং দেশের কল্যাণে এগিয়ে আসুন। বেশি বেশি ঘরে থাকুন। বাইরে প্রয়োজন না হলে যাবেন না। হাঁচি, কাশির শিষ্টাচার মেনে চলুন। ঘন ঘন ২০ সেকেন্ড সাবান দিয়ে হাত কচলে ধোয়ার অভ্যাস করুন। যাঁরা বিদেশ থেকে দেশে ফিরছেন, তাঁদের অবশ্যই কোয়ারিন্টিনে থাকতে হবে। সে রকম মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই দেশে ফিরতে পারেন। সবচেয়ে ভালো, যেখানে আছেন সেখানে থাকুন এবং সামাজিক দূরত্বায়ন মেনে চলুন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্লু বিস্তার রোধ নিয়ে একটি পুস্তিকায় যুক্তরাজ্যের মডেল এর উল্লেখ করে বলা হয়েছে R0 দুইয়ের কম এমন ফ্লু–এর ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিলে সর্বোপরি ২০ শতাংশের বেশি সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়। যদিও শক্তিশালী বৈশ্বিক মহামারির ক্ষেত্রে বলা হয়েছে ১০ শতাংশ প্রতিরোধের কথা (সূত্র ৩)।
লেখক: শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট গবেষক, কিংস কলেজ লন্ডন, যুক্তরাজ্য।
দেখতে ক্লিক করুন :
সূত্র:
১। আবদুল লতিফ জামিল ইনস্টিটিউট ফর ডিজিজ অ্যান্ড ইমার্জেন্সি অ্যানালিটিকস, ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন
https://www.coursera.org/learn/covid-19/lecture/pBr4Z/the-basic-reproduction-number-feb-4th
২। https://www.cdc.gov/coronavirus/2019-ncov/prepare/transmission.html?CDC_AA_refVal=https%3A%2F%2Fwww.cdc.gov%2Fcoronavirus%2F2019-ncov%2Fabout%2Ftransmission.html&fbclid=IwAR2Bv09CcQs6d9Wm43zr6X_dJnYTPHAqbtefYdib42M1oWm2ZvkQCm-KOR8
৩। https://www.who.int/influenza/resources/research/research_agenda_influenza_stream_2_limiting_spread.pdf
৪। https://www.who.int/dg/speeches/detail/who-director-general-s-opening-remarks-at-the-media-briefing-on-covid-19---3-march-2020?fbclid=IwAR3Pi_hd82rkl7kTTvoFi5UNO7UFodhMs8FFoT1pZ_9Z_eAniJrR8c23PDA
৫। https://databank.worldbank.org/home.aspx