কোভিড-১৯–এ বিশ্বে মানুষ মারা যাচ্ছে। মুষ্টিমেয় মহৎ মনের বিশ্বনেতা তাঁদের দেশ ও জনগণকে এ মহামারি থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করছেন নিরন্তর, হৃদয়ের অকৃত্রিম কর্তব্যপরায়ণতা আর দায়িত্ববোধ নিয়ে। ঠিক তখনো ক্ষমতার মোহে অনেক বিশ্বনেতা অপরাজনীতির দাবা চালছেন কোভিড-১৯–এর সুযোগে।
অর্থলোলুপ অবৈধ বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত অনেকেই সম্পদের পাহাড়কে পর্বতে রূপান্তর করার দিবা স্বপ্নে বিভোর। সময়োপযোগী যথাযথ প্রতিরোধমূলক পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে এক দেশ অন্য দেশকে, এক নেতা অন্য নেতাকে দুষছেন। প্রতিদিন শত শত অমূল্য প্রাণ হারিয়ে যাচ্ছে। নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতির কথা হরহামেশা ফলাও করে প্রচার করা হলেও বাস্তবে এর অনেকটাই অকার্যকর বলে প্রতীয়মান হচ্ছে দেশে দেশে। মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টার চেয়ে অধিক গুরুত্ব পাচ্ছে কোভিড-১৯–এর জন্মদাতা কোন দেশ, এমন জল্পনা–কল্পনা নিয়ে। দুর্ভাগ্য মানবতার, দুর্ভাগ্য মানবজাতির। স্রষ্টার কাছে আমরা সবাই একযোগে প্রার্থনা করি মহামারি কোভিড-১৯ থেকে মানবজাতিকে মুক্তি দেওয়ার জন্য।
চারদিকে মানবতার এত সব বিপর্যয়ের মধ্যেও যে সংবাদ, যে দৃষ্টান্ত মানুষের মনে বেঁচে থাকার আশা সঞ্চার করে, তেমন কিছু ত্যাগী, মানবদরদি মানুষের কথা এ মুহূর্তে না বললেই নয়। তাঁরা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছেন, এ পৃথিবীতে সবাই অমানুষ নয়, সবাই স্বার্থপর নয়, ক্ষমতালোভী নয়। উদাহরণস্বরূপ সগৌরব আমরা উল্লেখ করতে পারি বর্তমানে বহুল আলোচিত কোভিড-১৯ প্রতিরোধী ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী স্বেচ্ছাসেবকদের কথা। মানবদেহে পরীক্ষামূলক এই ভ্যাকসিনের প্রয়োগ শুরু হয়েছে ১৬ মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে ‘কাইছার পার্মানেন্তে ওয়াশিংটন রিসার্চ ইনস্টিটিউটে (KPWRI)’। প্রথম দফার পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ৪৫। তাদের বয়স ১৮ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল হেলথ ইনস্টিটিউট (NHI) এই পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিনের ওপর গবেষণার ব্যয় বহন করছেন এবং বাইও টেকনোলজি কোম্পানি ‘মডার্না থেরাপিউটিকস’–এর গবেষকেরা সরাসরি এই পরীক্ষা–নিরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন।
গবেষণাক দলের প্রধান চিকিৎসক লিসা জ্যাকসন বলেছেন, ‘পরীক্ষা–নিরীক্ষা শুরু হয়েছে মাত্র, পরবর্তী ধাপে আমরা এর মূল্যায়ন করতে পারব।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সবাই চেষ্টা করছি এই দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য কার্যকরী একটা কিছু জরুরি ভিত্তিতে করার জন্য।’
আমার এই লেখায়, কে গবেষণায় অর্থায়ন করছেন বা কারা গবেষণা পরিচালনা করছেন, সেটি মুখ্য বিষয় নয়। বরং আমি অধিক গুরুত্ব দিতে চাই মানবতার সেবায় সাধারণ মানুষ যারা এই গবেষণায় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নিজেদের উৎসর্গ করেছেন পরীক্ষা–নিরীক্ষা চালানোর জন্য। আমরা সবাই এ মহামারি থেকে নিজেদের বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছি, আতঙ্কিত হয়ে আছে সারা দুনিয়ার মানুষ, তখন স্বেচ্ছাসেবীরা নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে মানবতার কল্যাণে নিজেকে এগিয়ে দিয়েছেন পরীক্ষা চালানোর জন্য। কয়জনার মন আছে এমন করে অন্যের জন্য, মানবজাতির জন্য ত্যাগ স্বীকার করার উদাহরণ?
পরীক্ষার জন্য যদিও আসল করোনাভাইরাসের জীবাণু স্বেচ্ছাসেবকদের শরীরে ঢোকানো হবে না, পরীক্ষাটি মানবদেহে কৃত্রিম জীবাণুর ওপর প্রয়োগ করলে তার কী কী প্রতিক্রিয়া হয় এবং এর কার্যকারিতা কতটা গ্রহণীয়, তা যাচাই করা। তা সত্ত্বেও গবেষকেরা নিশ্চিত নন মানবদেহে এর দীর্ঘমেয়াদি ফল কী হতে পারে। এর অর্থ স্বেচ্ছাসেবকেরা কিছুটা হলেও জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেই এই পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন নিজ সন্তানসন্ততি, পরিবার–পরিজনের মায়া–মমতা ত্যাগ করে। এই স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ। তাঁদের সহায়তায় পরীক্ষা–নিরীক্ষা শেষে কোভিড-১৯–কে পরাস্ত করার কার্যকরী ভ্যাকসিন আবিষ্কারে বিজ্ঞানীরা যেন সফল হন এবং সুস্বাস্থ্যে স্বেচ্ছাসেবকেরা তাঁদের পরিবারে ফিরতে পারেন, সে কামনা রইল আমাদের সবার পক্ষ থেকে।
প্রথম দফার প্রথম ভ্যাকসিন নিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক সিয়াটলের ৪৩ বছর বয়সী জেনিফার হলার। তিনি পেশায় একটি টেক কোম্পানির ম্যানেজার এবং দুই সন্তানের মা, ছেলের বয়স ১৬ এবং মেয়ের বয়স ১৩ বছর। ১৬ মার্চ তার শরীরে পরীক্ষার জন্য ভ্যাকসিন দেওয়ার পর তিনি বলেছেন, ‘আমরা সবাই অসহায় অনুভব করছি এ মহামারির জীবাণুর কাছে। তবে এই পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার মাধ্যমে আমি আমার জীবনে অত্যন্ত ভালো কিছু করার সুযোগ পেয়েছি বলে মনে করি।’ তাঁর সন্তানেরা বলেছে তাদের মা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
নিল ব্রাউনিং নামের ৪৬ বছর বয়সের ওয়াশিংটন নিবাসী মাইক্রোসফট নেটওয়ার্ক ইঞ্জিনিয়ার। তিনিও স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ১৬ মার্চ তাঁর দেহে পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন নিয়েছেন। তাঁর তিন মেয়ের বয়স ৮, ৯ ও ১১ বছর। তিনি বলেছেন, প্রত্যেক মা–বাবাই চান তাঁদের সন্তানেরা তাঁদের দেখভাল করবেন কিন্তু এটি কেবল মা–বাবার মধ্যেই সীমিত নয়, আরও মানুষ রয়েছে সেবা পাওয়ার জন্য।
দেখুন কী মানবীয় গুণের মহামূল্যবান উক্তি এই স্বেচ্ছাসেবক নিল ব্রাউনিংয়ের কণ্ঠে। তাঁদের মহৎ ত্যাগের বিনিময়ে হাজারো মানুষের প্রাণ রক্ষা পাবে কোভিড-১৯–এর মৃত্যুর হাতছানি থেকে, এ কামনা রইল নিরন্তর।