কোভিড-১৯ সংকট এবং ব্রিটিশ ব্যতিক্রমীবাদ

করোনাভাইরাস। প্রতীকী ছবি
করোনাভাইরাস। প্রতীকী ছবি

এই মুহূর্তে এটা পরিষ্কার যে যুক্তরাজ্য সারা পৃথিবীর মধ্যে কোভিড–১৯ সংক্রান্ত মৃত্যুর হারে একেবারে ওপরের দিকে। যদিও সরকার এখন এই সংকট সামাল দিতে ব্যস্ত এবং পরিকল্পনা করছে কী করে লকডাউন আস্তে আস্তে খোলা যায় দ্বিতীয় শিখর এড়িয়ে। লেবার পার্টির নেতা কিয়ের স্টারমারের মতো আপামর ব্রিটেনবাসীরও মনে প্রশ্ন, ব্রিটেন এই অবস্থায় পৌঁছাল কী করে?

গত বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে চীনের ‌উহান শহরে প্রথম চিকিৎসকেরা কিছু রোগীর মধ্যে এক অস্বাভাবিক ধরনের ফুসফুসে সংক্রমণ লক্ষ করেন। এই সংক্রমণ মানুষ থেকে মানুষে খুব দ্রুত ছড়াতে থাকে এবং তা আটকাতে চীন সরকার উহান এবং সন্নিহিত এলাকায় এক অভূতপূর্ব লকডাউন করে ২৩ জানুয়ারি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই নতুন অসুখের এর ওপর প্রথম থেকেই কড়া নজর রাখছিল এবং ৩০ জানুয়ারি এক বিপৎসংকেত জারি করে বলে যে সারা পৃথিবী এক উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে চলেছে। ২৯ জানুয়ারি ব্রিটেনে প্রথম দুজন কোভিড–১৯–এ আক্রান্ত রোগী দেখা মেলে। দেশের মধ্যে একজন ব্রিটেনবাসীর থেকে আরেকজনের সংক্রমণ প্রথম দেখা গেল ২৮ ফেব্রুয়ারি। ৫ মার্চ এক সত্তরোর্ধ্ব নারী প্রথম ব্রিটেনে করোনাভাইরাসে মারা গেলেন। ৯ মার্চ ইতালিতে লকডাউন ঘোষণা হলো, ১০ মার্চ ব্রিটেনে ৬ জন মারা গেলেন। ১৪ মার্চ স্পেনে লকডাউন হলো আর তিন দিন বাদে ফ্রান্সে। ১৮ মার্চ ইংল্যান্ডে স্কুল বন্ধের ঘোষণা হলো, ২০ মার্চ পাব, জিম, রেস্তোরাঁ বন্ধ হলো আর ২৩ মার্চ লকডাউন। কিন্তু তত দিনে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়ে গেল। আর তা বাড়তে বাড়তে আজ (১৪ জুন) পর্যন্ত ব্রিটেনে কোভিডে আক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যা ৪১ হাজার ৬৯৮।

পৃথিবীতে সব না হলেও অনেক দেশ–জাতিই নিজেদের ব্যতিক্রমী বা অন্যদের থেকে উন্নততর ভাবে। ব্রিটিশ ব্যতিক্রমীবাদ (British exceptionalism) তার কোনো ব্যতিক্রম নয়। ব্রিটিশরা ভাবতেই পারে তারা বুদ্ধিমান, সাহসী এবং নম্র, সুতরাং ভাগ্য তাদের সহায় হবে। সেই ১০৬৬ সাল থেকে তারা বাইরের শত্রুর হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করেছে, ক্রমে পার্লামেন্ট, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা এবং সাধারণ আইন প্রবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে। নেপোলিয়ন ও হিটলার এই ভূখণ্ড দখল করতে পারেননি। শিল্পবিপ্লবের সূচনা এখানেই হয়েছিল এবং দুর্ধর্ষ নৌশক্তিকে কাজে লাগিয়ে একসময় তারা পৃথিবীব্যাপী সাম্রাজ্য তৈরি করেছিল। দুটি বিশ্বযুদ্ধেই বিজয়ী পক্ষে ছিল। ইংরেজি ভাষা, যা কিনা একসময় কেবল টেমস উপত্যকায় বলা হতো, পরিণত হয়েছে সারা পৃথিবীর ভাষায়। সুতরাং ব্রিটেনবাসী যদি নিজেদের অন্যদের থেকে আলাদা ভাবে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই।

এখন প্রশ্ন হলো, এই ভয়াবহ কোভিড সংকটের পেছনে কেবলই সরকারি অদক্ষতা আর মারণ ভাইরাস নয়, ব্রিটিশ ব্যতিক্রমীবাদ ধারণারও অবদান আছে। কোভিড সংকট নিরসনে ব্রিটেন অবশ্যই অন্য দেশের থেকে আলাদা রাস্তায় হেঁটেছে, অন্তত শুরুতে...খুব তাড়াতাড়ি test and trace বন্ধ করে, অন্য দেশ থেকে মানুষের আসা না বন্ধ করে, herd immunity–এর কথা বলে এবং ব্রিটেনবাসী ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করা বেশি দিন সহ্য করবে না, এই ভেবে দেরি করে লকডাউন করে।

জানুয়ারির শেষে এবং ফেব্রুয়ারির শুরুতে, কোভিড-১৯–এর বিপদের সংকেত যখন তীব্র এবং নিশ্চিততর হচ্ছে, বরিস জনসনের রক্ষণশীল সরকার তখনো তাদের নির্বাচনী সাফল্যে মাতোয়ারা এবং ব্রেক্সিট নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। সাড়ে তিন বছর ধরে অনেক আলাপ–আলোচনা, ভোটাভুটি এবং সরকার পরিবর্তনের পর ব্রিটেন পরিশেষে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যেতে তৈরি। উদযাপনের জন্য আতশবাজি প্রস্তুত হচ্ছে আর টাঁকশালে স্মারক মুদ্রা। সরকারের নজর তখন দূরদেশের এক ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য সমস্যা থেকে অনেক দূরে। লেবার পার্টি তাদের পরপর চারবার হারের পর কার্যত নেতৃত্বহীন। সরকারকে প্রশ্ন করার মতো কোনো বিরোধী পক্ষ নেই।

৩ ফেব্রুয়ারি উহান লকডাউন প্রসঙ্গে এক বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী জনসন বললেন, ‘আমরা এক অদ্ভুত স্বয়ংসম্পূর্ণতার বাগাড়ম্বর শুনছি, বিচ্ছিন্নতার দেয়াল তোলা হচ্ছে, করোনাভাইরাস আতঙ্কে পৃথিবীব্যাপী বাজার ভেঙে টুকরো করা হচ্ছে, যতটা না দরকার, তার থেকে বেশি অযৌক্তিকভাবে, অর্থনীতির প্রকৃত এবং অপ্রয়োজনীয় ক্ষতি করে...এই সময় মানবজাতির দরকার এমন একটি সরকারের যে অর্থনৈতিক বিনিময়ের সপক্ষ গলা ফাটাবে, এমন একটি দেশের যে প্রস্তুত আছে ক্লার্ক কেন্টের চশমা খুলে ফোন বুথে ঢুকবে আর বেরিয়ে আসবে সুপারম্যানের পোশাক পরে জগৎবাসীর বেচা এবং কেনার মুক্ত অধিকারের জয়ধ্বজা ওড়াতে ওড়াতে।’

করোনাভাইরাস আটকাতে প্রথমে ব্রিটেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য দেশের প্রদর্শিত পথ থেকে সরে এসে সম্পূর্ণ নিজের পথে চলার স্বিদ্ধান্ত নেয়। এক অবান্তর herd immunity-এর তত্ত্ব খাড়া করে। মনে করা হয়, এই ভাইরাসকে থামানো যাবে না। সুতরাং একমাত্র রাস্তা অন্তত ৬০ শতাংশ জনগণকে আক্রান্ত হতে দেওয়া এবং herd immunity তৈরি হতে দেওয়া। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি তারা বুঝতে পারে যে এতে অন্তত আড়াই লাখ লোক মারা যাবে (ইম্পিরিয়াল কলেজের মডেল অনুযায়ী) এবং পুরো ইউটার্ন করে লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেয়।

লকডাউনের ব্যাপারেও প্রথম দিকে সরকার দোটানায় ছিল। সরকারের বিজ্ঞানী মহল এবং আচরণগত বিজ্ঞান বিশেষজ্ঞরা সাবধান করছিল এই বলে যে জনগণ এই ড্রেকনিয়ান পদক্ষেপ বেশি দিন সহ্য করবে না। প্রধানমন্ত্রী জনসন পাব বন্ধ ঘোষণা করার সময় এ–ও বলেন যে এই সিদ্ধান্ত ব্রিটিশ জাতীয় চরিত্রের ওপর আঘাত। পাবে যাওয়ার প্রাচীন এবং অবিসংবাদিত অধিকার থেকে জন্মস্বাধীন ব্রিটিশদের বঞ্চিত করতে হচ্ছে।

যে সময় সামাজিক দূরত্ববিধি বীজমন্ত্র হওয়ার কথা, তখন ৭ মার্চ ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস রাগবি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় আর ১৩ মার্চ পর্যন্ত চেলটেনহ্যাম ফেস্টিভ্যাল চলতে দেওয়া হয়, যেখানে প্রায় আড়াই লাখ দর্শক উপস্থিত হয়।

কোভিড-১৯ সংকট মোকাবিলায় ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনার পুঙ্খানপুঙ্খ বিশ্লেষণ এবং ব্যর্থতার কারণগুলো খোঁজার মতো অবকাশ হয়তো এখনো আসেনি, ভবিষ্যতে তা নিশ্চয়ই হবে। তবু যে কারণগুলো মানুষের মাথার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে তা হলো, গোড়ার দিকের সতর্কবাতা অগ্রাহ্য করা, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, যথাযথ প্রস্তুতি না নেওয়া, খুব তাড়াতাড়ি test and trace বন্ধ করা, লকডাউন ঘোষণা করতে অযথা দেরি করা, স্বাস্থ্যকর্মীদের ভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে এবং পিপিই সরবরাহ করতে সক্ষম না হওয়া, কেয়ার হোমের দুর্বল এবং অক্ষম আবাসিকদের রক্ষা করার দ্রুত পরিকল্পনার অভাব তার মধ্যে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে ব্রিটিশ ব্যতিক্রমীবাদ কতটা ইন্ধন জুগিয়েছে, বিশেষত প্রথমদিকে, অন্যান্য দেশের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এক অভিনব পদক্ষেপ নিতে তা এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। তবে এই পৃথিবীব্যাপী সংকটের যে একটা আলাদা ব্রিটিশ উত্তর থাকবে এবং ব্রিটিশদের যে কঠোর বিধিনিষেধ মান্য করতে বলা যে সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক, এই ধারণা কম হলেও কিছু মাত্রায় অন্তত ব্রিটিশ রণকৌশল তৈরি করতে সাহায্য করেছে, সে কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এবং ব্রিটিশ ব্যতিক্রমীবাদ এবং পরিকল্পনা যে এ ক্ষেত্রে কাজ করেনি, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

*কনসালট্যান্ট এবং স্পেস্যালিটি লিড, কার্ডিওলজি, মেডওয়ে ম্যারিটাইম হসপিটাল, জিলিংহ্যাম, কেন্ট, যুক্তরাজ্য। debjit.chatterjee@hotmail.com