ঢাকা মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতালে করোনা ইউনিটে অনেক চিকিৎসকের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন তন্ময় দে, আজিজুল হক, শরীয়তুল্লাহ খান ও শুভ্র সৈকত বিশ্বাস। তাঁদের মধ্যে দুজনই করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক তন্ময় দে নিজেসহ পরিবারের ৬ জন আক্রান্ত হয়েছেন কোভিড-১৯–এ। সুস্থ হয়ে আবারও শুরু করেছেন দায়িত্ব পালন। তন্ময় প্রথমেই বলছিলেন, রোগীদের তীব্র শ্বাসকষ্টের অসহায় অবস্থার কথা। বললেন মেডিকেল সায়েন্সে একটা কথা আছে ‘There is no hunger in the world that can be compared with the Severity of air hunger’ আর আমরা প্রতিনিয়ত সেই কষ্টটাই দেখছি রোগীদের। এই দৃশ্য যখন আপনজনেরা দেখছেন, তাঁদের মানসিক অবস্থাটা ভাবুন।
পরিবারের অনেকেই সংক্রমিত হওয়ায় রয়েছে একপ্রকার মানসিক চাপ। নিজের অসুস্থতার সময় তন্ময় পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ঢাকায় ছিলেন। ঝালকাঠিতে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক স্ত্রীকে সতর্কতাবশত আসতে দেননি ঢাকায়। প্রতিদিন হাসপাতালের ডিউটি থেকে কোয়ারেন্টিন জীবনে প্রবেশ করে নিজেও অনেকটা সময় থাকেন রোগীদের সেই অসহায় অবস্থার স্মৃতির ভেতর। বারবার করে সবাইকে বলছেন, পথে বের হলে অনেককেই দেখি মাস্কটা তাবিজের মতো ঝুলিয়ে রেখেছেন কিন্তু ঠিক করে নাক–মুখ ঢাকা নেই। সতর্ক থাকার অনুরোধ জানিয়েছেন করোনা বিজয়ী এ চিকিৎসক। তন্ময় দের ৯২ বছর বয়স্ক নানি এখন হাসপাতালে লড়াই করছেন করোনাভাইরাসের সঙ্গে। গত ১৬ মে করোনা নেগেটিভ আসার পর ২৩ মে থেকে তন্ময় দে করোনা ইউনিটে আবারও নিয়মিত দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন।
মেডিসিন বিভাগের আজিজুল হক করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ১৬ জুন। এর এক দিন আগে তিনি বলেছিলেন নিজের অভিজ্ঞতার কথা। কখনো এমন ঘটেছে যে রোগীকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে জরুরি বিভাগে নিয়ে আসার পথে রোগী মারা গেছেন। ইমার্জেন্সির দায়িত্বে এমন অনেক রোগীর ডেথ সার্টিফিকেট লিখতে হয়েছে তাঁকে। এ পরিস্থিতিতে রোগীর সঙ্গের আত্মীয়রা অনেক সময় ভুল বোঝেন চিকিৎসককে।
আজিজুল হক জানান, উপসর্গহীন করোনা আক্রান্ত রোগীর ক্ষেত্রে বেশি সমস্যা হয়। দেখা যায় স্বাভাবিক সুস্থ শরীরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর রোগটা ধরা পড়ছে অনেক দেরিতে। তাঁদের পরিস্থিতির অবনতি হয় দ্রুত। অনেক জায়গায় রোগীরা বলেন যে তাঁরা ঘুরে ঘুরেও চিকিৎসা পাচ্ছেন না। হাসপাতাল থেকে রোগী ফেরত আসছে ভর্তি হতে না পেরে কিন্তু সংক্রমণযোগ্য রোগীর ক্ষেত্রে যদি হাসপাতালে বেড না থাকে, সে ক্ষেত্রে করণীয় কী?
অসংক্রমিত রোগে যেমন সিট না থাকলে মেঝেতে রেখেও চিকিৎসা দেওয়া যায়, করোনায় তা অসম্ভব। করোনার অধিকাংশ রোগী আসেন শ্বাসকষ্ট নিয়ে। যেহেতু বেড ও অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়, তাই সিট হিসেবেই ভর্তি হন এবং চিকিৎসক হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আমি বলতে পারি যে ঢাকা মেডিকেলে যথেষ্ট উন্নত সেবা দেওয়া হচ্ছে।
এই চিকিৎসকের স্ত্রীও ঢাকার বাইরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক। ঢাকায় তাঁর ৭২ বছরের মায়ের কাছে আছে সাড়ে পাঁচ বছরের সন্তান। আজিজুল হক বলেন, ‘আমি যখন কোভিড-১৯–এর সেবা দিচ্ছি, তখন কিন্তু তারাও ঝুঁকির মধ্যে থাকে।’
এই চিকিৎসক বলেন, ‘আমরা সেবা দিই শুধু চাকরি বাঁচানোর জন্য না, দায়িত্বই সেবা দেওয়া। এমবিবিএস শেষ করার সময় আমাদের শপথ নিতে হয়, ইউ হ্যাভ টু সার্ভ। সরকারি চাকরিতে জয়েন করেছি, তখনো কিন্তু সেবার শপথই নিতে হয়েছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার আমরা একটা অংশ মাত্র। হাসপাতালে গেলে আপনি যে নার্স, আয়া, ট্রলিম্যানকে পাবেন, তাঁরাও এই সেবার অংশ। আমরা সবাই এখন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছি।’
আজিজুল বললেন, ‘যখন একটা ক্রাইসিস আসে, তখন আলোচনা হয়। যে দেশে এখন পর্যন্ত ইউনিয়ন লেভেলেও চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই হাই লেভেলের অ্যান্টিবায়োটিক কিনে খেতে পারে, সে দেশে চিকিৎসকেরা কী করবেন বলেন? জেলা-উপজেলা পর্যায় থেকে অনেক রোগী আসেন, যাঁরা পলি ফার্মেসি মানে মাল্টি ড্রাগ ওষুধ খেয়ে ফেলছেন। তাঁদের অবস্থা আগে থেকেই অনেক বেশি খারাপ থাকে। চিকিৎসকেরা চেষ্টা করেও অনেক সময় ব্যর্থ হন। সে দায় তখন চিকিৎসকদের কাঁধে আসে। সিম্পটম সিভিয়ার হয়ে গেলে আমরা সার্ভাইব করাতে পারি না। এই পরিস্থিতি শুধু কোভিড নয়, সব সময়ের জন্যই।’
তিনি বলেন, কিছু জায়গায় আউটডোর বেসিসে টেস্টিং হচ্ছে যেমন বিএসএমএমইউ, মিটফোর্ডে। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল, কুর্মিটোলা বা মুগদা মেডিকেলে অ্যাডমিশন নিতে হয়। ধরুন, দূর থেকে ঢাকা মেডিকেলে এসে শুনল যে অ্যাডমিশন নিতে হবে, তখনই তাঁরা কিন্তু বিরক্ত হচ্ছেন, অসহায় হয়ে উঠছেন। কোন কোন হাসপাতালে সরাসির পরীক্ষা করানো যায় আর কোথায় আগে অ্যাডমিশন নিতে হয়, এই তথ্যগুলো আরও বেশি প্রচার হওয়া দরকার।
শুভ্র সৈকত বিশ্বাস প্রথম থেকেই কাজ করছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইনডোরে। বলছিলেন, ‘এমনও ঘটেছে যে অ্যাম্বুলেন্সে করে শ্বাসকষ্টের রোগী নিয়ে এসেছে পরিবার। আমরা দেখেই বললাম, করোনা পরীক্ষা করাতে হবে, তখন দুই মিনিটের মধ্যে পরিবারের কাউকে খুঁজে পেলাম না। এই রোগীরা যখন সুস্থ হন, তখন আরেকটা অসহায় অবস্থা হয়। তাঁদের কেউ নিতে আসেন না। এমনিতেই করোনা বিজয়ী অনেক রোগী শারীরিকভাবে থাকেন ভীষণ দুর্বল। আরেকটি বিষয় চিকিৎসকদের সম্পর্কে মানুষের অভিযোগ, করোনার শুরুতে আমরা শুনেছি যে চিকিৎসকেরা রোগীর কাছে গিয়ে সেবা দিচ্ছেন না। আপনারা হয়তো জানেন যে প্রথমেই আমাদের নিজেদের সুরক্ষার যথেষ্ট ব্যবস্থা ছিল না। চিকিৎসক অরক্ষিত অবস্থায় থাকলে তাঁর কি উচিত খুব কাছে গিয়ে দেখা? এখন কিন্তু সে সংকটটি নেই।’
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, করোনা রোগীর ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা। দেখা যায় আমার কাছে এমন রোগী আছেন সাতজন, যাঁদের ভেন্টিলেশন প্রয়োজন অথচ ব্যবস্থা আছে একটা। সে ক্ষেত্রে কী করতে পারি! তখন আমাদের দেখতে হয় কার অবস্থা সবচেয়ে বেশি সংকটাপন্ন। কখনো কখনো আগে এলে আগে পাবেন সেই ফর্মুলাতেও তো যেতে হয় চিকিৎসকদের।
আমরাও তো একজন সাধারণ মানুষ, যাঁর পরিবার আছে। তাঁরা দুশ্চিন্তা করেন আমাদের নিয়ে আবার এই সংকটের সময় আমাদেরও ভাবনা থাকে তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে। আমার কাছ থেকে স্বজনদের সংক্রমণের ভয় আছে। শ্বাসকষ্টে প্রতিদিন মানুষ মারা যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে ঘুমাতে যাই। সেটারও একটা ট্রমা থাকে। এসব বিষয়ই মানবিক দিক থেকে বিবেচনা করা উচিত।
শরীয়তুল্লাহ খান এক সপ্তাহ ডিউিটির পর এখন আছেন ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে। করোনা নেগেটিভ হলে এক সপ্তাহ পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়ে আবার শুরু করবেন দায়িত্ব পালন। তিন সপ্তাহ ধরে পরিবার বিচ্ছিন্ন এই চিকিৎসকের একমাত্র সন্তানের বয়স এক বছর। ব্যক্তিগত আবেগের জায়গা থেকে বললেন, ‘প্রতিদিন ভোরে আমার মেয়ে ঘুম থেকে জাগে। আমার বালিশটি দেখিয়ে ওর মাকে বলে, বাবা? তারপর ভিডিও কল দেওয়া হলে সে মোবাইলের স্ক্রিনে বাবাকে দেখে ফোকলা মুখে একটা হাসি দেয়। করোনার কারণে এখন আমি আমার সন্তানের ভিডিও কলের বাবা। আমার মা থাকেন ফরিদপুরের সদরপুরে। তিনি ফোন করে আমার কোয়ারেন্টিন জীবনের খোঁজ নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, খাঁচাবন্দী জীবন। সুস্থ শরীরে সন্তানের কাছে ফিরে যাব, এটাই সবচেয়ে বেশি চাওয়া এখন। যে রোগীদের জন্য আমরা ফ্রন্টলাইনার হয়ে লড়াই করছি, সেই প্রত্যেক করোনা রোগীও যেন সুস্থ হয়ে আপনজনের কাছে ফিরতে পারেন।’