সমাজের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতার (আইসোলেশন) দশম দিন পূর্ণ হয় ২৯ মার্চ। ব্যাপারটা যে খুব অপ্রত্যাশিত ছিল, তা নয়। সবার সঙ্গ ত্যাগ (কোয়ারেন্টিন) করে ১৪ দিন থাকার সরকারি নির্দেশ সিডনি পৌঁছানোর দুই দিন আগেই আমরা জানতাম। কিন্তু ঠিক দুই মাস আগেও পৃথিবীজুড়ে বর্তমানে যা ঘটছে, সবকিছুই ছিল অপ্রত্যাশিত।
স্ত্রী আর এক বছরের একমাত্র শিশুপুত্র নিয়ে প্রিয়জনদের বিদায় জানানোর কথা ছিল ২২ মার্চ। কিন্তু সব ধরনের বিমান যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার আশঙ্কায় এক সপ্তাহ আগেই সবাইকে বিদায় শুভেচ্ছা বলতে বাধ্য হই। এর জন্য গুনতে হয় কড়া জরিমানা। পৌঁছানোর ঠিক দুই দিন পরই বন্ধ হয়ে যায় ঢাকা-সিডনি সব ধরনের বিমান যোগাযোগ। বড় বাঁচা বেঁচে গেছি বলার কোনো সুযোগ নেই। যখন দেশ ছাড়ি, তখন দেশে করোনায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩। আর সিডনিতে তত দিনে ৫ জন এ রোগের কারণে না–ফেরার দেশে চলে গেছেন। যত দিন যাচ্ছে, আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা শুধু বাড়ছে। আসন্ন পরিস্থিতি আর প্রিয়জনদের নিয়ে দুশ্চিন্তা নিয়ে দেশ ছাড়ি।
১০ দিন হলো আমরা কেউই বাসার বাইরে একটি পাও ফেলিনি। লম্বা ছুটির কারণে বাসায় ন্যূনতম বাজারটুকুও ছিল না। প্রবাসে পরিবার হয়ে যাওয়া কাছের মানুষগুলো আবারও তাদের পরম মমতার হাত বাড়াল। বাসায় পৌঁছানোর আগেই বাজার বাসায় পৌঁছে গেল। তার পরের কয়েক দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় যা কিছু লাগছে, এই পরিবারের কেউ না কেউ বাড়ির বাইরের গেটে রেখে দূর থেকে হ্যালো বলে চলে যাচ্ছে। বাজারে সবকিছুর সংকট তাও ম্যাজিকের মতো আমরা সবকিছু পেয়ে যাচ্ছি। বাজারে ডিমের সংকট জেনে আমার প্রতিবেশী তার বাবার মুরগির খামার থেকে আমার শিশুপুত্রের জন্য এক ডজন ডিম এনে রাতের আঁধারে বাসার গেটে রেখে গেলেন। মায়া বড় অদ্ভুত জিনিস। কাকে কখন কোথায় বাঁধে বোঝা দায়।
কর্মক্ষেত্রে ছুটি বাড়াতে হয়েছে বাধ্যতামূলক সেলফ আইসোলেশনের কারণে। সরকারের নির্দেশ, বিদেশফেরত মানেই ১৪ দিন ঘরবন্দী। সরকার আরও বলছে সামাজিক দূরত্ব (সোশ্যাল ডিস্ট্যানসিং) বজায় রাখতে, জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের না হতে, আর বারবার হাত ধুতে। প্রধানমন্ত্রী প্রতিদিন জাতির উদ্দেশ্যে দীর্ঘ ভাষণ দিচ্ছেন। কেমন যেন যুদ্ধাবস্থা চারদিকে।
ইতিমধ্যে আমার কাজের জায়গা থেকে জানানো হয়েছে যে আমাদের সবার ডেস্ক আলাদা আলাদা রুমে সরানো হয়েছে। একই রুমে দুজনের বেশি বসা যাবে না। কাজের জায়গাটাকে বিভিন্ন জোন এ ভাগ করা হয়েছে। এক জোনের কর্মচারী আরেক জোনের কর্মচারীর সঙ্গে দেখা করতে পারবে না। ক্যানটিনে যাওয়ার জন্য সবাইকে আলাদা সময় নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এই সবকিছুই করা হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য। একেকটা মহামূল্যবান জীবন বাঁচানোর জন্য, সরকারকে এই দুর্যোগ মোকাবিলায় সাহায্য করার জন্য।
এসব হচ্ছে শুধু যুদ্ধের প্রস্তুতি। কোয়ারেন্টিন শব্দের বাংলা আভিধানিক অর্থ কয় দিন আগেও সবাই জানতাম না। আগে না জানা থাকলেও এখন জানতে হবে। কোয়ারেন্টিন হচ্ছে এমন একটা প্রক্রিয়া, যখন আমাকে সবার সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে। আইসোলেশন মানে আমাকে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হবে। বাঁচতে হলে জানতে হবে। এও জানতে হবে, এখন আমার শরীরে এ রোগের কোনো লক্ষণ দেখা না গেলেও আগামী ১৪ দিনের ভেতর দেখা দিতে পারে। তাই আমাকে যখন জনবিচ্ছিন্ন থাকতে বলা হচ্ছে, তখন দাঁত কেলানো একটা হাসি দিয়ে ‘আমি তো ভাই সুস্থ’ বলে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তেমন জটিল কোনো লক্ষণ জানান না দিয়ে কিংবা খুব সাধারণ ঠান্ডা–কাশির আভাস দিয়েও এ রোগ ভালো হয়ে যেতে পারে। তাই আপনি এ রোগে না মারা গেলেও যেহেতু ভাইরাসটি প্রবলভাবে ছোঁয়াচে, তাই আপনি আইসোলেশনে না থাকার কারণে এবং অন্য সবার সঙ্গে সামাজিক দূরত্ব বজায় না রাখার কারণে আপনার কাছ থেকে আরও অগণিত মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হবেন। তারপর আপনার চেয়ে যারা দুর্বল, তাদের নিয়ে শুরু হবে মৃত্যুর মিছিল।
এত কিছু জানার পরও যে হত্যাযজ্ঞ আপনি ঘটাতে যাচ্ছেন, তার জন্য হয়তো আপনার মৃত্যুদণ্ড হবে না, কিন্তু চড়া মূল্য যে দিতে হবে, তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই। হত্যার দায় নিয়ে, সাক্ষী হয়ে বেঁচে থাকতে হবে পুরো একটা জীবন।
ঘরবন্দী খেলা প্রথম দিকে খুব স্বস্তিদায়ক কিছু ছিল না। কিন্তু সময়টা দেহকে খাঁচায় বন্দী করার, আত্মাকে নয়। আত্মাকে তার রসদ দিলে পৃথিবীর যেকোনো কোনাই আরামদায়ক হতে বাধ্য। প্রিয় সিনেমা দেখুন, প্রিয় গান শুনুন, প্রিয়জনের সঙ্গে গল্প করুন, প্রিয় বইটি আবার পড়ুন।
এই যুদ্ধাবস্থায় ভুল হওয়াটাই খুব স্বাভাবিক। ভুল হতে পারে আমার, ভুল হতে পারে আপনার, ভুল হতে পারে সরকারের। ভুল কেন হলো, সেদিকে আমরা অবশ্যই আঙুল তুলব, কিন্তু আঙুল তোলার আগে আসুন আমরা নিজের জায়গা থেকে যতটুকু সম্ভব শুদ্ধ কাজটুকু করি। সেটা হচ্ছে ঘরে থাকি আর সাবান দিয়ে বারবার হাত ধুই। নিজে সচেতন হই, সচেতনতা সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিই। আর গুজবে কান না দিই।