‘তালতলা কবরস্থানে প্রবেশ করে দুটি অ্যাম্বুলেন্স। অ্যাম্বুলেন্স দুটি কবরস্থানের শেষ মাথায় ঝিলপাড়ের প্রান্তে এসে থামে। একটি অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামেন পাঁচ ব্যক্তি। তাঁদের প্রত্যেকের পরনে ছিল ব্যক্তিগত সুরক্ষার সরঞ্জাম (পিপিই)। তাঁরা প্রথম অ্যাম্বুলেন্স থেকে একটি স্ট্রেচারে করে সাদা কাফনে মোড়ানো লাশ নামান। এরপর কবরস্থানের ইমাম ও উপস্থিত আটজন মিলে জানাজা পড়েন। জানাজা শেষে স্ট্রেচারে করে তাঁরা মৃতদেহটি কবরের কাছে আনেন। এরপর পিপিই পরা তিনজন মিলে মৃতদেহটি কবরে নামান। কবরে দেহ নামানোর পর মাটি দেওয়া হয়। সব শেষে দাফনে অংশ নেওয়া ওই পাঁচজন কবরস্থানের ঝিলের পাড়ে এসে পিপিই খুলে ফেলেন। পিপিইগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে তা নষ্ট করেন তাঁরা। দাফন করা ওই নারীর বয়স ৫০ বছর। তিনি রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা। ওই নারী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কি না, তা এখনো জানা যায়নি।...তিনি কয়েক দিন ধরেই সর্দি, জ্বর, শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন। অল্প অল্প অসুস্থ ছিলেন। তবে তাঁরা হাসপাতালে যাননি। ‘ (দৈনিক প্রথম আলো অনলাইন ২৯ মার্চ, ২০২০)
সরকার বলছে বাংলাদেশে বর্তমানে করোনা রোগীর সংখ্যা ৭০ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৫৫৩টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিদিনই করোনার লক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন জেলা, উপজেলা, গ্রামে বেশ কিছু মানুষ মারা যাচ্ছেন। ঢাকা শহরেও এই সংখ্যা নেহাতই কম নয়। এর কারণ অনেক। উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও লোকজন হাসপাতালে যাচ্ছেন না, কারণ তাঁরা জানেন সেখানে গিয়ে হয়তো লাভ হবে না। কারণ উপসর্গ শুনলেই কেউ তাঁদের দেখবেন না। মিডিয়া থেকে তাঁরা এই ধরনের চিত্রই বেশি পাচ্ছেন। সরকার থেকে দেওয়া হটলাইনে যোগাযোগ করতে পারছেন না। আত্মীয়স্বজন কিংবা পাড়া-প্রতিবেশীকেও ডাকতে পারছেন না, কারণ লক্ষণ শুনলেই কেউ আসবেন না সহায়তা করতে। তাই বেশির ভাগ মানুষ বাড়িতেই থাকছেন। এমনকি বাড়িতে কেউ মারা গেলেও কাউকে জানাচ্ছেন না। কারণ, তখন জানাজা কিংবা সৎকারের জন্য লোক পাবেন না এবং এটি নিয়ে সারা জীবন তাদের মানুষের কথা শুনতে হবে।
করোনা এখন আর শুধু রোগ নয়, দেহ থেকে বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে নেতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি। সামাজিকভাবে করোনা পেয়েছে ‘খারাপ’ রোগের তকমা। এটি এখন সামাজিক ফিসফাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এখন যেকোনোভাবেই মারা গেলেও সবাই ধারণা করছে করোনায় মারা গেছে। যার ফলে চলছে ফোনে ফিসফিসানি। কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে ফোনে জানাচ্ছেন কর্তৃপক্ষকে। তারা এসে করোনার নিয়মে দাফন করছে। এখন কথা হলো, যাঁর করোনা টেস্টই করা হয়নি এবং মৃত্যুর আগে যিনি করোনা রোগী হিসেবে শনাক্তই হননি, তাহলে করোনা রোগীর মতো দাফন সামাজিকভাবে তিনি করোনায় মারা গেছেন বলেই জানান দেয়। তখন কাউকে কোনোভাবেই বিশ্বাস করানো যায় না যে তিনি হয়তো করোনায় মারা যাননি। তাহলে করোনা নিয়ে এই হযবরল আচরণের কারণ কী?
করোনা রোগ বিষয়ে ধারণার চেয়ে এই রোগ নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করছি আমরা। সামাজিক দূরত্বকে আমরা ‘অচ্ছুত’ হিসেবে দেখছি। ‘ছেলে বিদেশে থাকে’ এই বাক্য এত দিন সমাজে যে মর্যাদার ছিল, গত দুই সপ্তাহে কেমন করে এই বাক্যের অর্থই পাল্টে গেল। এখন খুব কম পরিবারই পাওয়া যাবে যারা বলছে তাদের কেউ বিদেশ থাকে কিংবা বিদেশ থেকে আসছে। এখন ‘করোনা আর বিদেশফেরত’ অনেকটাই সমার্থক শব্দ। কোনো কোনো এলাকায় লাল পতাকা টাঙিয়ে দিয়ে বিদেশফেরত লোকদের বাড়ি আলাদা করা হয়েছে। এই আলাদা করা একভাবে ‘আমরা-তারা’ বোধ তৈরি করছে। যার ফলে বিদেশফেরত লোকজনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বা পরিচয় লুকিয়ে রাখার প্রবণতা বেশি।
এর পাশাপাশি আছে সামাজিক নাজেহালের ভয়। লক্ষণ শুনলেই পুরো এলাকা লকডাউন করা হচ্ছে এবং সেই পরিবারকে সামাজিকভাবে ‘হেয়’ করার বন্দোবস্ত হয়ে যায়। শুরু হয়ে যায় বিশ্বাস-অবিশ্বাস আর সন্দেহবাতিকতা। আর সে সময় কেউ মারা গেলে তাঁকে করোনার রেওয়াজ অনুযায়ী দাফন এটিকে আরও বাড়িয়ে তোলে। তাই সব জায়গায় চলছে এই ধরনের লুকোচুরি।
তাই করোনা লক্ষণ দেখা দিলে তার করোনা কি না, সেটি টেস্ট করাই প্রথম প্রয়োজন। সরকারের শনাক্তকৃত করোনা রোগী কম কিংবা গত ৪৮ ঘণ্টায় ‘নেই’, এ ধরনের ঘোষণার পাশাপাশি সন্দেহ নিয়ে দাফন অনেককেই সামাজিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের জায়গা থেকে বেকায়দায় ফেলে। করোনা বিষয়ে সতর্কতা আমাদের কখনো কখনো করে তুলেছে অমানবিক। সরকারের যেমন করোনা টেস্টের যারপরনাই ঘাটতি রয়েছে, তেমনি খামতি আছে এই করোনাকেন্দ্রিক সামাজিক ট্যাবু থেকে মানুষকে দূরে রাখার চেষ্টার।
এগুলোকে যদি আমরা ঠিকভাবে মোকাবিলা করতে পারি, তাহলে আমরা জানতে পারব করোনা রোগীর সংখ্যা এবং আস্থা আনতে পারব সরকারের সুরক্ষা কর্মসূচির ওপর। অন্যথায় এই হযবরল চলতেই থাকবে। বিপদও সমান তালে বাড়বে।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
zobaidanasreen@gmail. com