বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বেশ অভিজ্ঞ হলেও করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলার অভিজ্ঞতা তেমন নেই। কারণ, নিকট অতীতে বাংলাদেশ এ ধরনের ভয়াবহ মহামারির মুখোমুখি হয়নি। মার্স, সার্স ও ইবোলার মতো মহামারির আঁচ বাংলাদেশে তেমন লাগেনি। তাই বাংলাদেশ করোনার মতো মানুষবাহিত মহামারির মুখোমুখি গুটিবসন্ত ও কলেরার পর আর হয়নি। ফলে এ ধরনের মহামারি মোকাবিলায় ভুল হওয়াটাই স্বাভাবিক। শুধু বাংলাদেশ নয়, যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কিছু দেশও করোনা মোকাবিলায় শুরু থেকেই ভুল পথে হেঁটেছে বলে ধারণা করা হয়।
এ ধরনের বৈশ্বিক মহামারি মোকাবিলায় সুনির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসাপদ্ধতি না থাকায় বিশ্ব ট্রায়াল অ্যান্ড এরর মেথডের পথে হাঁটছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, শুরু থেকে এ মহামারি মোকাবিলায় আমরা কতগুলো ভুল করে ফেলেছি। এখন আর ভুলের পুনরাবৃত্তি করার সুযোগ নেই। আবার ভুল করলে খেসারতের অঙ্কটা কিন্তু অনেক বড় হবে।
৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের পর দুই মাস অতিবাহিত হয়েছে। ওই সময়ে টেস্টের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগী শনাক্তের সংখ্যাও আনুপাতিক হারে বেড়েছে। ৯ মে পর্যন্ত ১ লাখ ১৬ হাজার ৯১৯ জনকে পরীক্ষা করে ১৩ হাজার ৭৭০ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। তবে যাদের পরীক্ষা করা দরকার, তাদের সবাইকে পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। আর তাদের সংখ্যাও আমাদের জানা নেই। ফলে প্রকৃত রোগীর সংখ্যা কত, তা আমরা জানি না। তাই আগামী দিনগুলোতে করোনার ভয়াবহতা কী রূপ হবে, তার প্রকৃত চিত্র পাওয়া সম্ভব নয়। কেননা, করোনা রোগী কত হতে পারে, তা নিয়ে যে প্রজেকশন করা হয়েছে, তা শুধু শনাক্ত রোগীর সংখ্যার ভিত্তিতে করা।
যে সংখ্যক মানুষ বর্তমানে পরীক্ষার আওতায় এসেছে, আর যাদের পরীক্ষা করার প্রয়োজন আছে কিন্তু করা সম্ভব হয়নি বা পরীক্ষা করতে আসেনি, তা বিবেচনা করলে প্রকৃত রোগীর সংখ্যা প্রজেক্টেড সংখ্যার তুলনায় অনেক বেশি হতে পারে। তাই করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতকে এই অনিশ্চিত পরিস্থিতির জন্য তৈরি রাখতে হবে। সাধারণত কোনো দুর্যোগ বা মহামারির ভয়াবহতা কী রকম হতে পারে, তার প্রকৃত অনুমান যে করা সম্ভব নয়, তা আমরা বুলবুলসহ বিগত কয়েকটা ঘূর্ণিঝড় থেকে দেখেছি। করোনার ক্ষেত্রেও এটা সত্য। তাই মহামারি বা দুর্যোগ মোকাবিলায় দরকার হোক বা না হোক, প্রস্তুতিটা কঠোর হওয়া প্রয়োজন।
প্রজেকশন অনুযায়ী মে মাসের শেষে কোভিড-১৯ রোগীর সংখ্যা যদি ৫০ হাজারে দাঁড়ায়, তাহলে বর্তমান সুস্থতার হার বিদ্যমান থাকলে একসঙ্গে প্রায় ৪০ হাজার রোগীর চিকিৎসার দরকার হবে। কিন্তু রোগীর সংখ্যা ১ লাখে দাঁড়ালে একসঙ্গে প্রায় ৮০ হাজার মানুষের চিকিৎসার দরকার হবে। আর যদি রোগীর সংখ্যা ২ লাখে দাঁড়ায়, তাহলে একসঙ্গে প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার জনের চিকিৎসার দরকার হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রায় ৮০ শতাংশ করোনা রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হয় না। বাড়িতে বা অন্য কোথাও আইসোলেশন থেকে চিকিৎসা নিলেই সুস্থ হয়ে ওঠে। বাকি ২০ শতাংশ রোগীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হয়। সেই হিসাবে মে মাস শেষে প্রায় ৮ হাজার বা ১৬ হাজার বা ৩২ হাজার বা তার বেশি করোনা রোগীর একসঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। আবার যারা হাসপাতালে ভর্তি হবে, তাদের ৫-১০ শতাংশের ভেন্টিলেশন বা আইসিইউ সেবার প্রয়োজন হবে। এই হিসাবে ন্যূনতম ৪০০ বা ৮০০ বা ১ হাজার ৬০০ রোগীর একসঙ্গে ভেন্টিলেশন বা আইসিইউ সেবার প্রয়োজন হতে পারে। তাই প্রয়োজন হোক আর না হোক, এই সংখ্যক করোনা রোগীর ব্যবস্থাপনার জন্য স্বাস্থ্য খাতকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের মতো উচ্চ সংক্রমণশীল এলাকায় কমিউনিটি সংক্রমণ শুরু হয়েছে। জনগণ একদিকে যেমন লকডাউন মানছে না, অন্যদিকে দোকানপাট এবং শপিং মল খুলে দেওয়ায় কমিউনিটি সংক্রমণ আরও অনেক এলাকায় ছড়িয়ে পড়তে পারে। উল্লেখ্য, প্রায় দেড় মাস ধরে অর্থনীতি টানা অবরুদ্ধ থাকার ফলে একদিকে যেমন অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের হিসাবমতে, দৈনিক অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা), অন্যদিকে কার্যকরভাবে লকডাউন না মেনে চলার প্রবণতাও বেড়েছে।
আমরা যদি শুরু থেকে অধিক হারে পরীক্ষা করে দ্রুত হটস্পটগুলো চিহ্নিত করতে পারতাম এবং হটস্পটভিত্তিক ছোট ছোট এলাকায় কার্যকরভাবে লকডাউন করে অন্যত্র অর্থনীতি অবমুক্ত করে দিতে পারতাম, তাহলে সংক্রমণ এবং অর্থনৈতিক ক্ষতি উভয়ই কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। কিন্তু আমরা সেই সুযোগ গ্রহণ করতে পারিনি। তাই বর্তমান অবস্থায় স্বাস্থ্যসেবার পরিসর বাড়ানো ছাড়া আমাদের সামনে আর তেমন কোনো পথ খোলা নেই।
আমাদের দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সরকারি খাতের একটা শক্তিশালী নেটওয়ার্ক থাকলেও আইসিইউসহ শয্যাসংখ্যার ভিত্তিতে বেসরকারি খাতের আকার অনেক বড়। উল্লেখ্য, দেশে হাসপাতালের মোট শয্যাসংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার। যার মধ্যে মাত্র ৩৬ শতাংশ সরকারি হাসপাতালে এবং বাকি ৬৪ শতাংশ বেসরকারি হাসপাতালে। দেশের আইসিইউ শয্যার বেশির ভাগ অংশ বেসরকারি খাতে। প্রতিবছর মাত্র ১৫ শতাংশ রোগী সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে। বাকি ৮৫ শতাংশের ২৫ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক বেসরকারি খাত থেকে এবং ৬০ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক বেসরকারি খাত থেকে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করে। তাই বলা চলে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা অনেকাংশেই বেসরকারি খাতের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু করোনার মতো ভয়াবহ মহামারি মোকাবিলায় বেসরকারি খাতের সক্রিয় অংশগ্রহণ এখন পর্যন্ত চোখে পড়ার মতো নয়।
করোনা মোকাবিলায় বাড়তি প্রস্তুতি হিসেবে সরকার ভেন্টিলেশন সুবিধাসংবলিত বসুন্ধরা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারসহ দুটি হাসপাতাল প্রস্তুত করেছে। সরকার ইতিমধ্যে ২ হাজার চিকিৎসক এবং ৫ হাজার নার্স নিয়োগের প্রক্রিয়াও শেষ করেছে। যেহেতু চিকিৎসক এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের ১৪ দিন পরপর কোয়ারেন্টিনে যেতে হচ্ছে এবং এখন পর্যন্ত চিকিৎসক এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যে প্রায় ১ হাজার জন কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন, তাই এই বাড়তি জনবল নিয়োগ খুব সময়োচিত পদক্ষেপ। কিন্তু ভেন্টিলেশন এবং আইসিইউসহ কোভিড-১৯ চিকিৎসায় যে ধরনের দক্ষতা দরকার, তা তাঁদের হয়তো নেই। আবার প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্বল্প সময়ে এ দক্ষতা অর্জন করাও সম্ভব নয়। অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালে ভেন্টিলেশন ও আইসিইউ সেবা প্রদানের জন্য যথেষ্ট দক্ষ জনশক্তি থাকার কথা।
তাই কোভিড-১৯ রোগীর চিকিৎসার পরিসর দ্রুত বাড়ানোর জন্য প্রতি এলাকায় জুতসই কিছু বেসরকারি হাসপাতালকে আপাতত তিন-চার মাসের জন্য সরকারি ব্যবস্থাপনায় আনা যেতে পারে। ইতিমধ্যে নতুন তিনটিসহ ছয়টি বেসরকারি হাসপাতালকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা হয়েছে। আরও হাসপাতালকে যুক্ত করে এসব হাসপাতালের পরিচালনার দায়িত্ব আর্মি মেডিকেল কোরের ওপর ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে।
তা ছাড়া করোনার কার্যকর ভ্যাকসিন ও প্রতিষেধক উদ্ভাবন না হওয়া পর্যন্ত এবং বাংলাদেশে এর ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত রাস্তাঘাট, বাজার, কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব পাবলিক প্লেসে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে মাস্ক ব্যবহারসহ করোনাসংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর জোর দিতে হবে।
এসব ব্যবস্থা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে পারলে জুন মাসের শুরুতে ঢাকা মহানগরী, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদীর মতো অতিসংক্রমিত এলাকা এবং হটস্পটভিত্তিক ছোট ছোট এলাকায় লকডাউন কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করে অন্যত্র অর্থনীতি পর্যায়ক্রমে উন্মুক্ত করে দেওয়া যেতে পারে।
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক
s.a.hamid73@gmail.com