কিউবার পর এ মুহূর্তে কেরালাকে নিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় মাতামাতি হচ্ছে। কিন্তু কেন? সেটা কি কেবল ভাইরাস–যুদ্ধে নতুন ধারার প্রশাসনিক পদক্ষেপের কারণে? নাকি ‘কেরালা মডেল’ আরও বেশি কিছু? বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য সেখানে শিক্ষণীয় কিছু আছে কি না? আলাপের শুরুতে করোনাকালে কেরালা কী করেছে, সেটাই জানা যাক।
১০০ দিনে মাত্র তিনজনের মৃত্যু
কেরালা ভারতের ঘনবসতিপূর্ণ রাজ্য। এখানকার প্রচুর মানুষ বিদেশে থাকে। জনসংখ্যায় বয়স্কদের সংখ্যা বেশি। চীনে প্রচুর ছাত্রছাত্রী ছিল তাদের। আবার বছরে প্রায় ১০ লাখ পর্যটক আসে এখানে। করোনার অত্যধিক সংক্রমণের সব বড় শর্তই ছিল কেরালায়।
কিন্তু কেরালার রাজ্য সরকার প্রথম থেকে অত্যধিক সতর্ক ছিল। বিমানবন্দরগুলোয় কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়। নয়টি দেশ থেকে আগত ব্যক্তিদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে যেতে হতো। ভারতের অন্যত্র এই নিয়ম করা হয় কেরালার দুই সপ্তাহ পরে।
কেরালার সরকার জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার কাজটি আমলাতান্ত্রিকভাবে করেনি। মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করা হয়। ‘সামাজিক দূরত্ব’ কথাটাও এড়িয়ে যায় তারা। সেখানে এটাকে বলা হয় ‘শারীরিক দূরত্ব, কিন্তু সামাজিক সংহতি’। স্লোগানের মধ্যেই তাদের আবেদনটা লুকানো ছিল। অনেকে বিস্মিত হবেন জেনে, করোনা নিয়ে কেরালায় সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে ২৬ জানুয়ারি। বহু দেশের বহু আগে।
কেরালায় প্রথম সংক্রমণের ১০০ দিন পেরিয়ে গেছে ইতিমধ্যে। সর্বশেষ ১২ এপ্রিল সেখানে করোনায় চিকিৎসাধীন ছিলেন ৩৪৬ জন। চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে চলে গেছেন ১২৩ জন। আর মারা গেছেন মাত্র তিনজন।
৫ এপ্রিল থেকে হিসাব করে দেখা গেছে, সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা সেখানে সব সময় চার শর নিচেই থাকছে। অথচ বাকি ভারতে সংখ্যাটা ক্রমেই বাড়ছে এবং ১০ হাজার ছুঁই–ছুঁই করছে। সর্বশেষ তিন দিনে কেরালায় মাত্র ২৮টি কেস শনাক্ত হয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয়, ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষকে তারা আইসোলেশনে রাখতে পেরেছে এবং সেটা যার যার বাড়িতে। ইতিমধ্যে ১০ হাজারের বেশি করোনা টেস্ট করেছে কেরালা। এই সংখ্যা প্রতি ১০ লাখে প্রায় ৩০০। ভারতে এই হার সর্বোচ্চ।
কেরালা তিনটি পদক্ষেপ নিয়েছিল একই সঙ্গে। আগ্রাসী হারে পরীক্ষা, অসুস্থ ব্যক্তিদের সংস্পর্শে যারা এসেছে, তাদের পুরো চেইন চিহ্নিত করা এবং রান্না করা খাবার সরবরাহ করা। এই তিনটি কাজ তারা একই সঙ্গে পরিচালনা করেছিল। প্রায় সব দল সেখানে মানুষকে খাওয়ানোর কাজে প্রতিযোগিতা করে নেমে পড়েছে। কোভিড-১৯-এ কেরালায় সংক্রমিত ব্যক্তিদের মৃত্যুর হার এক ভাগের কম। এটা বৈশ্বিকভাবে সবচেয়ে নিচু হার। এটা সম্ভব হয়েছে আসলে আগে থেকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় রাজ্যটির অগ্রগতির কারণে।
২৫ শতাংশ পরিবারের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের প্যাকেট
আগেই বলেছি, রাজ্যটি করোনা মোকাবিলায় একই সঙ্গে মেডিকেল এবং নন-মেডিকেল ব্যবস্থা নিয়েছিল। গত ১৯ মার্চ ওই রাজ্যে দুর্যোগকালীন অর্থনৈতিক সহায়তার নানান প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। এর আকার ছিল মাত্র সাড়ে তিন কোটি নাগরিকের রাজ্যে ২০ হাজার কোটি রুপি। ইতিমধ্যে রাজ্য সরকার ৮৭ লাখ পরিবারকে (জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ) বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের একটা প্যাকেট পৌঁছে দিয়েছে। এ রকম প্যাকেট দেওয়া হচ্ছে ১৪ দিনে একবার। এক হাজার রুপিতে তৈরি এ প্যাকেটে চিনি থেকে রান্নার তেল পর্যন্ত ১৭ ধরনের জিনিস থাকছে। এর ফলে মানুষ ঘরে থাকছে এবং না খেয়ে মারা যাচ্ছে না।
এর বাইরেও অনেক সহায়ক কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে ঘরবন্দী মানুষের জীবনকে সহজ করতে। ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের বাধ্য করা হয়েছে যার যার হিসাবের বিপরীতে ৩০ ভাগ বেশি ব্যান্ডউইথ দেওয়ার জন্য। আইসোলেশনে থাকা ব্যক্তিদের সাহস দিতে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তবে করোনাকালে এসব পদক্ষেপের কারণেই ‘কেরালা মডেল’ শব্দযুগল চালু হয়েছে, এমন নয়; বহুদিন থেকেই কেরালা উন্নয়নের বিকল্প একটা মডেল। দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে ‘গুজরাট মডেল’–এর পক্ষে এত বুদ্ধিজীবী সারাক্ষণ প্রচারে লিপ্ত থাকে যে কেরালার কথা বাংলাদেশ-পাকিস্তান-নেপাল তো দূরের কথা, খোদ ভারতেও আড়ালে পড়ে যায়।
উন্নয়নের ক্ষেত্রে কেরালার নেতৃবৃন্দ ‘প্রবৃদ্ধি’, ‘মাথাপিছু আয়’ ইত্যাদি সূচকের দিকে ছোটেননি। নাগরিকদের ছলনায় মুগ্ধ করার চিন্তাতাড়িত ছিলেন না তাঁরা; বরং চেষ্টা করা হয়েছে জীবনযাত্রার মান বাড়ানোর। এই চেষ্টাটা এমনভাবে করা হয়েছে যেন পুরো জনপদে সবার জীবনযাত্রার মান বাড়ে। আশপাশের রাজ্য ও দেশগুলোতে যেমন কিছু ঝলমলে শহর, শপিং মল বা ইট-সিমেন্টের বড় অবকাঠামোকে উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে তুলে ধরা হয়, কেরালা তা করেনি। তারা জোর দিয়েছে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বিশেষভাবে রাজনৈতিক সচেতনতার ওপর।
ভারতে মানব উন্নয়ন সূচকে কেরালা প্রথম
স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় মূল বিনিয়োগটা রাজ্য সরকারই করেছে কেরালায় বরাবর। এ দুটোর জন্য বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়নি মানুষকে। অর্থাৎ রাজ্যের সম্পদ সেখানে কিছু মানুষের কাছে ক্রমে পুঞ্জীভূত হতে না দিয়ে ক্রমাগত বণ্টন ও পুনর্বণ্টনের চেষ্টা করা হয়েছে (বিদ্যমান পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেই যতটা পারা যায়)। এতে ফল হয়েছে এই, ভারতে ৩১টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে কেরালা মানব উন্নয়ন সূচকে ২০১৮ সালে যখন প্রথম স্থানে ছিল, গুজরাট তখন ছিল ২১তম।
কেরালা ভূমি সংস্কার দিয়ে শুরু করে। আমার মনে হয়, বাংলাদেশে বনেদি গবেষক ও নীতিনির্ধারকেরা এ রকম কিছু করার কথা এখন আর ভাবেনও না। কেরালা কেবল এই একটা কাজ করে গ্রামীণ কৃষিতে আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসে। কৃষিশ্রমিকদের জন্য পেনশন পর্যন্ত চালু করে তারা। ভর্তুকি মূল্যে খাদ্য সরবরাহ সেখানকার একটা পুরোনো কর্মসূচি। ভারতে যেসব রাজ্যে ক্ষুধার সমস্যা কম, তার মধ্যে পাঞ্জাবের পরই কেরালার অবস্থান। পাঞ্জাব খাদ্য ফলিয়ে এক নম্বরে। আর কেরালা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দুই নম্বরে।
কেরালার শিক্ষা মডেল বলা যায় বিশ্বের অন্যতম সেরা। ১৯৫১ সালে রাজ্যটিতে সাক্ষরতার হার ছিল ৪৭ শতাংশের মতো। এখন তা ৯৪ থেকে ৯৫ শতাংশ। অথচ সর্বভারতীয় গড় ৭০–এর কাছাকাছি।
কেরালার মানুষের রাজনৈতিক সচেতনতা সম্পর্কে উল্লেখ করেছিলাম শুরুতে। কেবল একটি তথ্য দিয়ে এর গভীরতা বোঝা যাবে। ভারতজুড়ে মোদি-অমিত শাহ জুটির যখন জয়জয়কার, তখন কেরালার ১৪০ সদস্যের বিধানসভায় বিজেপি জিতেছে মাত্র একটি আসনে। লোকসভায় এখনো বিজেপি কিছু পায়নি এখানে।
কেরালায় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে বামপন্থীদের সঙ্গে মধ্যপন্থীদের। এখন পিনারাই বিজয়নের নেতৃত্বে বামপন্থীরা ক্ষমতায় থাকলেও সেখানে বিরোধী কংগ্রেসও অনেক বছর ক্ষমতায় ছিল।
আরএসএসের মতো শক্তি এখনো সেখানে যে সুবিধা করতে পারেনি, তার বড় এক যোগসূত্র রয়েছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় রাজ্যটির ভালো অবস্থার মধ্যে।
৫৫ শতাংশ হিন্দুর পাশাপাশি প্রায় ৪৫ শতাংশ মুসলমান ও খ্রিষ্টান রয়েছে কেরালায়। কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ঘটনা অতি বিরল। এর কারণ খুব সহজ। শাসকদের তরফ থেকে সে ধরনের উসকানি দেওয়া হয় না। কেরালার লোকেরা তাই গর্ব করে বলে, এটা ‘ঈশ্বরের নিজের দেশ’!
দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পুরোনো চার্চ, সেনেগগ, মসজিদগুলোর অক্ষত অবস্থা রাজ্যটির বিকল্প উন্নয়ন মডেলের আরেক প্রতীক। যদি এসব সৌহার্দ্যকে ‘উন্নয়ন’ বলতে মানুষ আদৌ শেখে কোনো দিন।
‘কেরালা মডেল’ নিখুঁত নয় অবশ্যই
হ্যাঁ, কেরালা মডেল নিখুঁত নয়। এখনো সেখানে পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থাই কায়েম রয়েছে। আবার ‘গুজরাট মডেল’–এর মতো ঔজ্জ্বল্যও নেই তাতে। মাথাপিছু আয়ের হিসাবে কেরালার মানুষকে ধনীও বলা যায় না। কিন্তু উন্নয়নকে মাথাপিছু গড় আয় আর প্রবৃদ্ধি দিয়ে বিচার করার চলতি মডেলটি বদলের শক্ত বার্তা দিচ্ছেন পিনারাই বিজয়ন ও তাঁর সহযোগীরা। করোনা মোকাবিলায় সফলতা তাঁদের সব চেষ্টাকে নতুন করে বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীর মনোযোগে নিয়ে এল আবার।
আলতাফ পারভেজ: গবেষক