করোনা প্রতিরোধে এ কেমন আচরণ

পুলিশ মানুষকে পিটুনি দিচ্ছে। প্রতীকী ছবি
পুলিশ মানুষকে পিটুনি দিচ্ছে। প্রতীকী ছবি

করোনাভাইরাসের এমন ভয়ংকর থাবায় থমকে গেছে গোটা পৃথিবী। থমকে গেছে প্রিয় মাতৃভূমি। এত সহজেই মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের চিত্র ভিন্নরূপ নেবে, যা আমরা কখনো কল্পনাই করতে পারিনি। কোভিড-১৯ প্রতিরোধ করার জন্য বিশ্বের অনেক দেশে সচেতনতার পাশাপাশি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও আমাদের দেশে কিছু ব্যতিক্রম নিয়ম বরাবরই চালু থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা একমত ভয়াবহ ছোঁয়াচে এই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচার এখন পর্যন্ত একমাত্র উপায় হোম বা সেলফ কোয়ারেন্টিন।

দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, জাপান, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মতো আমাদের দেশ প্রযুক্তি কিংবা অর্থনৈতিকভাবে ততটা উন্নতির শিখরে পৌঁছতে পারেনি। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা যায়, উন্নয়নশীল বিশ্বের একটি বড় অংশ মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উন্নীত হলেও বৈশ্বিক আর্থিক মন্দার কারণে তারা এখন চাপে আছে। মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশই আগের চেয়ে দরিদ্র হয়েছে। আজ এই করোনাভাইরাসের ভয়ের চেয়ে ক্ষুধার জ্বালা অনেক বেশি। আর এ জ্বালাটা উচ্চবিত্তদের বুঝতে অনেকটাই কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে। এই পরিস্থিতিতে দিনমজুররা পড়েছেন বিপাকে। দিন এনে দিন খাওয়া লোকদের সংসার চলছে টেনেটুনে; অজানা আতঙ্কে। দীর্ঘদিন এমন সংকট চলার শঙ্কাও রয়েছে তাদের মনে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার চেয়ে তাদের কাছে তিনবেলা খাবার খেতে পাওয়াটা বড় চিন্তা। কোয়ারেন্টিন করলে ক্ষুধার জ্বালায় পরিবার-সন্তানদের আর্তনাদ ছাড়া ঘরে বসে আর কিছুই শুনতে পাবে না। যারা দিনমজুর রিকশা–ভ্যান চালিয়ে সংসার চালায়, তারা এটাও জানে রাস্তা জনমানবশূন্য। তবুও চালের টাকার জন্য কিছু পয়সা জুটলে আলহামদুলিল্লাহ।

তবে দেখা গেছে, কিছু কিছু সামাজিক সংগঠন করোনাভাইরাসের কারণে যাদের জীবন চালাতে কষ্ট হচ্ছে, তাদের জন্য এগিয়ে এসেছে। যাদের এখন কোনো আয় নেই এমন পরিবারের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য বিনা মূল্যে সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে তারা। তাদের সাধ্যের মধ্যে অসহায়দের জন্য চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, আলু এবং লবণ পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় যতটুকু পেরেছে ততটুকু করছে। তবে দেশের বড় বড় সব প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলে হয়তো কিছুটা কষ্ট মোচন হতো দিনমজুরদের।

দরিদ্র মানুষকে অবশ্যই নিশ্চয়তা দিতে হবে। সামর্থ্য যাদের নেই প্রয়োজনের সময় তাদের তিন বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে সংশ্লিষ্টদের। এই নিশ্চয়তা যদি তারা না পায়, তাহলে হোম কোয়ারেন্টিন কখনো সম্ভব না। তারা জীবিকার তাগিদে ঘরের বাইরে আসবেই, যা এখনকার সময়ের জন্য বিপজ্জনক। তাই নিজেদের সুরক্ষায় এসব মানুষের দায়িত্ব নিতেই হবে সরকারসহ দেশের বড় প্রতিষ্ঠানের মালিকদের।

এক কথায় খাল কেটে কুমির এনেছে যশোর মনিরামপুরে সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসান। দুজন বয়স্ক ব্যক্তিকে কানে ধরানো হলো। তাদের দিকে ক্যামেরা তাক করা হলো। সেই ক্যামেরা চালু করলেন ছবি ওঠালেন। একজন সরকারি কর্মকর্তার এমন অমানবিক কর্মকাণ্ডে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন নেটিজেনরা। বাবার বয়সীদের সঙ্গে এমন ঘটনা আমাদের জন্য সত্যিই লজ্জাজনক। ঘটনাটি মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়ে নিন্দার ঝড় উঠলে তাঁকে দায়িত্ব থেকে সরিয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আসলে সবকিছুতে নিজেকে পণ্ডিত মনে করাটাও বিপদ বটে।

পৃথিবীর বুকে তাণ্ডব চালানো করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা ঠেকাতে সরকার স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত বন্ধ করে দিয়ে সবাইকে নিজ নিজ বাসা থেকে বের না হওয়ার জন্য তাগিদ দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে এটি সরকারের একটি খুবই ভালো উদ্যোগ। কিন্তু কিছু মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে ঘর থেকে বের হতেই পারে। বিভিন্ন টেলিভিশন ক্যামেরায় ধারণ করা দৃশ্য দেখা যায় প্রশাসনের লোকজন যাকে সমানে পাচ্ছে তাকেই লাঠি দিয়ে বেধড়ক পিটুনি দিচ্ছে। সেই পিটুনি থেকে বাদ পড়েনি সাধারণ মানুষসহ সাংবাদিকও।

গত শুক্রবার সন্ধ্যায় পেশাগত দায়িত্ব পালন শেষে ফেরার পথে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে দুই সাংবাদিক পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন। এই দুই ফটোসাংবাদিক হলেন, বরিশালের আঞ্চলিক দৈনিক দেশ জনপদের সাফিন আহমেদ ও দৈনিক দক্ষিণের মুখের নাসির উদ্দিন।

এ ঘটনার বিচার দাবি করেছেন আহত দুই ফটোসাংবাদিকও। নগর পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত পুলিশ সদস্যদের চিহ্নিত করে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে।

সাংবাদিক সাফিন আহমেদের ভাষ্য, পুলিশের পিটুনিতে তাঁরা হতভম্ব হয়ে পড়েন। লোকলজ্জায় প্রথমে বিষয়টি তারা প্রকাশ করেননি। কিন্তু বিষয়টি জানাজানি হলে পরের দিন সন্ধ্যায় সহকর্মীদের বিষয়টি খুলে বলেন তারা। তিনি দাবি করেন, বরিশাল সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোশারেফ হোসেন গত শুক্রবার বিকেলে কর্ষকাঠী ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় করোনা নিয়ে প্রচার চালাতে যান।

সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসান বয়স্ক দুই ব্যক্তিকে কান ধরে ওঠবস করাচ্ছেন। ছবি: ফাইল ছবি

তারা দুজন এর খবর ও ছবি সংগ্রহ করতে যান। কিন্তু দেরি হয়ে যাওয়ায় তারা সেই প্রচার কার্যক্রম না পেয়ে শহরের দিকে ফিরছিলেন। ফেরার পথে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ইউএনওর গাড়ির পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাদের মোটরসাইকেলের গতিরোধ করেন। এরপর তাদের লাঠি দিয়ে পেটাতে শুরু করেন। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পরও তাঁরা লাঠিপেটা করতে থাকেন। ঘটনার সময় তারা নিয়মানুযায়ী মাস্ক পরা ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে ক্যামেরাও ছিল। যে পুলিশ সদস্যরা তাঁদের পেটান, তাঁদের মুখে মাস্ক ছিল। এ কারণে তারা কাউকে চিনতে পারেননি। পিটুনিতে তাদের শরীরের বিভিন্ন স্থান ফুলে গেছে এবং ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। শহরে এসে তারা প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। এভাবে ধরে ধরে কান ধরালে আর পেটালেই কি করোনা প্রতিরোধ সম্ভব? নাকি জনগণের প্রতিনিধি হিসেব এ সময়ে তাঁদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া।

শুরুতে করোনা যখন চীনের উহান শহর থেকে পর্যায়ক্রমে প্রতিটি দেশে ছড়িয়ে গেছে, পরিশেষে যখন বিশ্বময় মহামারি আকার ধারণ করছে, তখন অনেকেই বলেছে আমাদের দেশের মানুষের কিছুই হবে না।

কোভিড-১৯ একটি অদৃশ্য ভাইরাস। তবে ভাইরাসের চোখ-কান থাকলে আসলে ভয়ই পেত। বগুড়ার শিবগঞ্জে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে একজন ব্যক্তিকে কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন না। শুক্রবার রাতে ওই ব্যক্তির অবস্থার অবনতি হয়। অসুস্থ স্বামীকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য স্ত্রী পাড়া-প্রতিবেশীদের সহযোগিতা চান। ওই ব্যক্তি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে কেউ এগিয়ে আসেননি। এরপর স্ত্রী অ্যাম্বুলেন্সের জন্য মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেন জেলা ও উপজেলার হাসপাতাল, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশে। কিন্তু কেউ কোনো সাড়া দেয়নি। সারা রাত এভাবেই কাটে। শনিবার দুপুরে ওই ব্যক্তি মারা গেছেন।

আশপাশের সবাই মিলে লোকটাকে মরতে দিল। খুব জানতে ইচ্ছা করছে, একজনকে বিনা চিকিৎসায় মরতে দিয়ে বাকি সবার কেমন লাগছে? স্বস্তি পাচ্ছেন? একটি বিষয় বুঝতে পারছি। জীবন বাঁচানোর কোনো আকুতিই তাতে আঁচড় কাটতে পারছে না। ঠিক কিছুদিন আগেও মিরপুরে করোনাভাইরাসে বাবার মৃত্যু নিয়ে তাঁর ছেলে নিজের ফেসবুকে একটি পোস্টে বলে দেয় দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা এখন প্রশ্নবিদ্ধ।

আমরা প্রার্থনা করি, আল্লাহ যেন এমন ভয়াবহ মহামারি থেকে আমাদের মাতৃভূমির সবাইকে রক্ষা করে। বাংলাদেশ আবার আগের মতোই কর্মব্যস্ত সচল দেশে পরিণত হোক, আবার ফিরে আসুক সুন্দর পৃথিবীর।