সব ধরনের মানুষের ওপর প্রভাব ফেলেছে করোনা। এতে নষ্ট হচ্ছে ঘুম। তবে শুধু ওষুধে কাজ হবে না।
রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার গৃহিণী মাহবুবা হকের ঘুমের সমস্যা চলছে। রাতে ঘুম আসতে দেরি হয়, এক-দেড় ঘণ্টা পরপর ঘুম ভেঙে যায়। আবার ঘুমাতে অনেক সময় চলে যায়। ওষুধেও কাজ হচ্ছে না। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর এই সমস্যা শুরু হয় এবং সুস্থ হওয়ার পরও সমস্যা রয়ে গেছে।
মাহবুবা হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আগে বিছানায় যাওয়ার ১০-১২ মিনিট পরই ঘুমিয়ে পড়তাম। এক ঘুমে রাত কেটে যেত। এখন সহজে ঘুম আসে না। বারবার ঘুম ভেঙে যায়।’ তিনি রাতে ভালো ঘুমের আশায় দিনে শারীরিক পরিশ্রম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
করোনার কারণে ঘুমের সমস্যার কথা বহু মানুষের মুখে শোনা যাচ্ছে। করোনায় আক্রান্ত একাধিক ব্যক্তি একত্র হলে যেসব শারীরিক সমস্যার কথা তুলে ধরেন, তার মধ্যে ঘুমের সমস্যার কথা থাকেই। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরাও বলছেন, করোনা ঘুমের সমস্যা তৈরি করে। তবে করোনায় আক্রান্ত নন, তাঁদেরও ঘুমের সমস্যার কথা শোনা যাচ্ছে।
স্লিপ সার্জারি অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব অধ্যাপক মনিলাল আইচ ২০০৪ সাল থেকে ঘুম নিয়ে গবেষণা ও লেখালিখি করছেন। গতকাল শুক্রবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির শ্বাসতন্ত্র ও মস্তিষ্কের মধ্যে কিছু পরিবর্তন হতে দেখা গেছে, যা ঘুমের ওপর প্রভাব ফেলে। এ ছাড়া ভয়, মানসিক চাপ ঘুমের সমস্যা বাড়িয়ে দিয়েছে।
গত এক বছরে করোনার বহুমাত্রিক প্রভাবের কথা জানা গেছে। করোনার সময় মানসিক চাপ বেড়েছে। মানসিক চাপ বাড়লে ঘুম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। করোনা মোকাবিলা করার জন্য অনেক মানুষের দৈনন্দিন জীবনে আকস্মিক পরিবর্তন এসেছে। এর প্রভাব পড়েছে ঘুমে। সুতরাং, শুধু করোনায় আক্রান্তদের ঘুমের ক্ষতি হয়েছে তা নয়, আক্রান্ত না হয়েও অনেকে ঘুমের সমস্যায় ভুগছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানীরাও ঘুমের ওপর করোনার প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছেন। ইতিমধ্যে বেশ কিছু গবেষণা ফলাফল চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য ও বিজ্ঞান সাময়িকীতে প্রকাশিতও হয়েছে। গবেষকেরা বলছেন, ঘুম নষ্ট হওয়ার শারীরিক ও মানসিক প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।
ঘুম অভ্যাসের ব্যাপার, অভ্যাসে পরিবর্তন এলে তার প্রভাব পড়ে ঘুমে। করোনার কারণে স্কুল-কলেজসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা ঘরে আবদ্ধ ছিল। শিক্ষার্থীদের মা–বাবা বা অভিভাবকদের ঘরে থাকার সময় বেড়ে যাওয়ায় বিছানায় থাকার সময়ও বেড়েছে। কিন্তু ঘুম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সম্প্রতি ইউরোপিয়ান স্লিপ রিসার্চ সোসাইটির ঘুমবিষয়ক সাময়িকী জার্নাল অব স্লিপ রিসার্চ–এ কানাডার ৫ হাজার ৫২৫ জনকে নিয়ে এক জরিপ ফলাফল প্রবন্ধ আকারে ছাপা হয়েছে। তাঁদের বয়স ছিল ১৬ থেকে ৯৫ বছর, ৬৭ শতাংশ নারী। ফলাফল বলছে, উত্তরদাতাদের ৩৬ শতাংশের মহামারির আগেই নানা ধরনের ঘুমের সমস্যা ছিল। তবে মহামারির সময় সেই হার বেড়ে ৫০ দশমিক ৫ শতাংশ হয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, উল্লেখযোগ্য মাত্রায় মানুষ ঘুম থেকে দেরিতে উঠছে। দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা, কাজ থাকা-না থাকা, পারিবারিক দায়দায়িত্ব, মানসিক চাপ, বেশি পরিমাণে মদ্যপান এবং বেশি সময় ধরে টেলিভিশন দেখা—এগুলো ঘুমের সমস্যা তৈরির কারণ হিসেবে কাজ করেছে।
গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, করোনা ঘুমের ওপর নানাভাবে প্রভাব ফেলেছে। যেমন পরিমাণগত দিক দিয়ে দেখা যাচ্ছে, মানুষ আগের চেয়ে বেশি সময় ঘুমাচ্ছে, তবে ঘুমের গুণগত মান কমেছে। অর্থাৎ, গভীর ঘুম কম হচ্ছে।
মাহবুবা হককে তাঁর চিকিৎসক নিয়মিত ঘুমের ওষুধ সেবন করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ওষুধেও ঠিকমতো ঘুম হচ্ছে না। করোনাজয়ী বেশ কয়েকজনের সঙ্গে গতকাল এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই ঘুমের ওষুধ সেবন করছেন বলে জানিয়েছেন। তবে অধ্যাপক মনিলাল আইচ বলেছেন, ঘুম কেন হচ্ছে না, তার কারণ সঠিকভাবে জানা দরকার। কারণ দূর না হলে শুধু ওষুধে ঘুম আসবে না।