করোনা চিকিৎসায় অ্যান্টিবায়োটিকের ভূমিকা কম। তবে দেশে করোনাকালে ব্যাপকভাবে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার দেখা গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ৮০ শতাংশ অ্যান্টিবায়োটিক অপ্রয়োজনে ব্যবহার করা হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) আয়োজিত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারবিষয়ক সেমিনারে এই তথ্য দেওয়া হয়। অ্যান্টিবায়োটিক সপ্তাহ উপলক্ষে এই সেমিনারের আয়োজন করে আইইডিসিআর। ১৮ নভেম্বর এই সপ্তাহ শুরু হয়ে আজ বুধবার তা শেষ হচ্ছে। গতকালের অনুষ্ঠানে তিনটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়।
প্রথম প্রবন্ধে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের প্রধান রুবিনা ইয়াসমিন বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করোনা রোগীর ৭০ শতাংশকে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে। আর আইসিইউতে ভর্তি রোগীর ৮০ থেকে ১০০ শতাংশকে এই ওষুধ দেওয়া হয়েছে। ভর্তি হওয়ার আগেই ৩৩ শতাংশ রোগী নিজেই অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে হাসপাতালে এসেছেন। হাসপাতালে ভর্তি না হলেও মৃদু বা মাঝারি উপসর্গ থাকা অনেকেই অ্যান্টিবায়োটিক খেয়েছেন।
মহামারিকালে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিয়ে বৈশ্বিক গবেষণার তথ্য তুলে ধরে রুবিনা ইয়াসমিন বলেন, ৬ দশমিক ৯ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন ছিল। কারণ, তাঁদের ক্ষেত্রে কিছু ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ দেখা গিয়েছিল বা তাঁদের অন্য সংক্রমণ ছিল। অথচ মহামারির শুরুর দিকে হাসপাতালে ভর্তি থাকা ৮৭ দশমিক ৭ শতাংশ রোগীকে একটি বা দুটি অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে। অনুষ্ঠান শেষে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব গবেষণা এখনো শেষ হয়নি। তবে বৈশ্বিক প্রবণতার সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতির মিল আমরা দেখতে পেয়েছি।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, কোভিড-১৯ ভাইরাসজনিত রোগ। এই রোগ নিরাময়ে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো ভূমিকা নেই, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরামর্শও কেউ দেয়নি। তারপরও দেখা যাচ্ছে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৮০ শতাংশ রোগীকে অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয়েছে।
মীরজাদী সেব্রিনা আরও বলেন, মহামারির সময় একজনের ব্যবস্থাপত্র অন্যে ব্যবহার করেছেন। চিকিৎসক হয়তো একজনকে ব্যবস্থাপত্র দিয়েছেন। সেই ব্যবস্থাপত্র মুঠোফোনে এসএমএস বা হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে আদান-প্রদান হয়েছে। সামান্য উপসর্গে একজনের ব্যবস্থাপত্রের ওষুধ অন্যে খেয়েছেন।
আইইডিসিআর দেশের বেশ কয়েকটি হাসপাতালে ২০১৭ সাল থেকে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার পর্যবেক্ষণ ও কার্যকারিতা নিয়ে পরীক্ষা করে আসছে। ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার ফলাফল তুলে ধরে আইইডিসিআরের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হওয়ার প্রবণতা দৃশ্যমান। অ্যামিকাসিন নামের অ্যান্টিবায়োটিক ২০১৭ সালে ২৬ শতাংশ ক্ষেত্রে অকার্যকর ছিল, ২০২১ সালে সেই হার বেড়ে ৩৩ শতাংশ হয়েছে। অ্যাম্পিসিলিন ২০১৭ সালে ৭৩ শতাংশ ক্ষেত্রে অকার্যকর ছিল, এখন তা ৮৬ শতাংশ। এভাবে তিনি ১২টি অ্যান্টিবায়োটিকের উদাহরণ তুলে ধরেন। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি রোগে কোন কোন অ্যান্টিবায়োটিক কী হারে অকার্যকর হয়েছে, সেই পরিসংখ্যানও তিনি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দেশে এমন কিছু ওষুধপ্রতিরোধী জীবাণু পাওয়া গেছে, যা কোনো অ্যান্টিবায়োটিকে মরবে না।
তৃতীয় ও শেষ প্রবন্ধে আমেরিকান সোসাইটি অব মেডিসিনের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক মোহাম্মদ মোরশেদ বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের যৌক্তিক ও নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অ্যান্টিবায়োটিকের শ্রেণি বিভাগ করেছে। হাসপাতালগুলোতে তা মানা হচ্ছে না।
আলোচনায় অংশ নিয়ে চট্টগ্রামের ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নীতিশ দেবনাথ বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, নাগরিক সমাজ, রাজনীতিক ও নীতিনির্ধারক—সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে বিপদ সামলানো যাবে না। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরীন।