করোনায় চায়ের কাপে ঝড়

১.
গল্পটা অনেকেরই জানা। এক চিকিৎসকের গল্প।

গ্রামের হাটে বসে চিকিৎসা করতেন। একদিন তিনি ডাক্তারি বইয়ে পেলেন,...একটা অসুখের জন্য মহৌষধ। এমন অসুখ যেটা মানুষ ও প্রাণী উভয়ের হতে পারে।

পরদিন ঘটনাক্রমে সেই অসুখ নিয়েই এক লোক হাজির। চিকিৎসক তো মহাখুশি। সদ্য শেখা বিদ্যা গরম-গরম প্রয়োগ করে ভালো একটা খবরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

এর পরদিন খবর এল। তবে সেটা সুসংবাদ নয়, দুঃসংবাদ। রোগী মারা গেছেন। এক কান, দুই কান করে ঘটনা রটে গেল চারদিক—... ভুল চিকিৎসা!!

চারদিকে হইচই পড়ে গেল। গ্রামবাসী চিকিৎসককে পালিয়ে যেতে বললেন। ভয় পেলেন, কিন্তু পালালেন না। পালাবেন কেন? তাঁর তো কোনো দোষ নেই। তিনি যা করেছেন, ডাক্তারি বই অনুসারেই করেছেন। সুতরাং পালানোর প্রশ্নই আসে না।

পুলিশ এল। চিকিৎসক সাহেব পুলিশকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, নিয়ম অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়েছে। পুলিশ প্রমাণ দেখাতে বললে বইখানা খুলে দেখালেন। লেখা আছে, ...অমুক অসুখের জন্য মহৌষধ।

বেচারা চিকিৎসক হাঁপ ছাড়লেন। ফ্যাকাশে মুখে মুহূর্তেই খুশির পরিষ্কার ছাপ দেখা দিল। এদিকে, পুলিশের মন বেজায় খারাপ। হাতের মুঠোয় পেয়েও আসামি ধরা হলো না।

চিকিৎসকের বাড়িতে পুলিশ এসেছে শুনে উৎসুক জনতায় বাড়ি ভর্তি। সবাই দেখতে এসেছেন কী হয়। কী আর হবে? সবাই নিজের চোখে প্রমাণ পেল, চিকিৎসক সঠিক চিকিৎসাই করেছেন।

পুলিশ যাবে যাবে করছে কিন্তু যাচ্ছে না। চিকিৎসক অপেক্ষা করছেন, তারা বিদায় হলেই নিজের বিজয় জনতার কাছে তুলে ধরবেন। উপস্থিত সবাই অপেক্ষায়, পুলিশ গেলেই বিরাট একটা হই হই শুরু হবে।

শেষমেশ উঠল পুলিশ। মোটরসাইকেলের কাছে গিয়ে কি যে হলো, একটু দাঁড়াল। ফিরে এসে চিকিৎসককে বলল, ‘বইটা দেন দেখি।’ আবার পড়া হলো, ...অমুক অসুখের জন্য মহৌষধ। সবই ঠিক আছে। কিন্তু পুলিশ এবার দেখল লেখার শেষে দাঁড়ি নেই। বাক্যটি শেষ হয়নি। অপর পাতায় দেখলেন লেখা আছে, যদি সে রোগটা প্রাণীর হয়। ঘটনা উলটে গেল। এবার পুরো লেখাটি দাঁড়াল, ... অমুক অসুখের জন্য মহৌষধ, যদি সে রোগটা প্রাণীর হয়।

চিকিৎসক কাঁদতে শুরু করলেন। একটা অসমাপ্ত লেখা পড়ে চিকিৎসা করার কারণে তার আজ জেলে যাওয়া। পুলিশ চিকিৎসককে নিয়ে থানায় চলে গেলেন।

গল্পটি বলার উদ্দেশ্য দুইটি—প্রথমত, চলমান করোনা পরিস্থিতির এ অবস্থায় বাংলাদেশে আমরা যেন মনে না করি, করোনা শেষ, যা করার তা তো করলামই!! দ্বিতীয়ত, লেখাটি অর্ধেক পড়ে এমনি কোনো ভুল ধারণা নিয়ে চলে যেন না যাই।

২.
এবার করোনাকালের একটা গল্প বলি।

লোকটার নাম নফেল। নফেল উদ্দিন। বাংলাদেশে তাঁর নিজ গ্রামে নিজের বাড়িতে সে নিজেই বন্দী। করোনাভাইরাসের কারণে বের হচ্ছেন না। বের হলে সমস্যা। করোনায় ধরার ভয়, ধরা পড়ে মরার ভয়। বের হবে কেন, মরতে? কেউ কি নিজে নিজে মরতে চায় নাকি?

নফেলের খটকা লাগে। ধুর, মরার ভয় লাগবে কেন? বের হলে সঙ্গে সঙ্গে তো আর মরতে হবে না। করোনা হলে তবেই না মরার ঝুঁকি! না হলে আবার কিসের ঝুঁকি? হাস্যকর সব কথা। আর বের হলে যে করোনায় ধরবে, সেটা বলেছে কোন পণ্ডিত? সারা দুনিয়ায় যত লোককে এ সুখে ধরেছে, তাদের বেশির ভাগেই মরেনি। এ বিশ্বের সবকিছুই চলে কপালের জোরে। কপালে যা লেখা থাকে, তা-ই হয়। কপালে করোনা লেখা থাকলে হবে, কারও বাপে ঠেকাতে পারবে না। কপালে না থাকলে হবে না। মরণ আজ হোক কাল হোক, হবেই তো। সেটা করোনায় লেখা থাকলে হবে, না থাকলে হবে না। পানির মতো সহজ।

নফেলের ভাবনার শেষ নেই, যুক্তিরও অন্ত নেই। সে শুনেছে ব্রিটেন, জার্মানি, কানাডায় দেশের মাথা যাঁরা, তাঁদের করোনায় ধরেছে। তাঁরা যত নিরাপত্তার মধ্যে থাকেন তার সিকিভাগ নিরাপত্তায় আমরা থাকি না। তবুও যদি তাঁদের করোনা হয়, আমরা কোন ছাতা! করোনার কাছে তারা মাত্র হলে আমরা তাহলে কী? কিছুই না। কাজেই ঘরে থাকা না-থাকা, করোনা হওয়া না-হওয়া, মরা না-মরা। এসব কিছু না। সবই ভাগ্য। ওপরওয়ালা যা করবেন, তা-ই হবে।

নফেল পরের দিন থেকে নিজেকে নিজেই মুক্ত ঘোষণা করেন। যুক্তি দিয়ে গ্রামের বাজারের চা-দোকান গরম করে ফেলেন। লোকজন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ভাষণ শুনতে থাকেন। চায়ের কাপে এক চুমুক, সঙ্গে একেকটা যুক্তি গিলতে কী যে মজা। আহা! সবাই সমর্থন দিয়ে যান। উৎসাহে আরও যুক্তি বের হতে থাকে। তিনি বলতে থাকেন, ‘করোনা শীতের দেশের অসুখ, আমাদের দেশের তাপমাত্রায় এসব ভাইরাস টিকতেই পাররে না।’

বিজ্ঞ নফেল আরও কয়েকটা বড় যুক্তি তুলে ধরেন—

এক.
মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ফল, সবজি, পানি, বাতাস এ দেশের মানুষ যা খায়, তাতে নানা রকম বিষ, কেমিক্যাল, অ্যান্টিবায়োটিক থাকে কমবেশি। এসব সহ্য করতে করতে এ দেশের মানুষের পেটে আগুন গেলে আগুন হজম হয়, লোহা খেলে লোহাও হজম হয়। করোনা-ফরনা কোনো ঘটনা!!

দুই.
মানুষ সামাজিক জীব। সে একা থাকতে পারে না। দলবদ্ধভাবে বাস করে। মানুষ মানুষের জন্য। এ বিপদে সবাইকে একসঙ্গে থাকতে হবে, একসঙ্গে বাঁচতে হবে। বেহায়ার মতো ঘরে লুকিয়ে থাকলে হবে? বাইরে থাকতে হবে, কার কী দরকার, কী সমস্যা দেখতে হবে। নারীদের মতো ঘরে থাকা লজ্জার বিষয়। পুলিশ-সেনাবাহিনী দিয়ে আমাদের ঘরে আটকানোর কোনো মানে নাই।

তিন.
এ দেশের ওপর ওপরওয়ালার বিশেষ নজর আছে, তাই কিছুই হবে না। নিশ্চিত। দেখাই তো যাচ্ছে, ইউরোপ-আমেরিকাতে মরতেই আছে, এ দেশে সে হিসেবে কিছুই হচ্ছে না। হবেও না।

চার.
মসজিদ আল্লাহর ঘর, সেখানে এ সময় আরও বেশি বেশি যাওয়া দরকার। বিপদে একসঙ্গে তারে ডাকা দরকার। ৫ বার অজু মানে ৫ বার হাত-মুখ ধুলে নিজে ভালো থাকা যাবে, সবাইকে ভালো রাখার প্রার্থনাও করা যাবে। সৌদি আরব, মক্কা-মদিনা বন্ধ করে দিয়েছে তো কী হয়েছে, তাদের ইমানে সমস্যা থাকতে পারে, আমাদের ইমান তাদের চেয়ে মজবুত। একসঙ্গে মসজিদে যাওয়া দরকার, এতে যদি তিনি নিয়ে যান যাবেন। সবাই ঠিক ঠিক বলতেই হই করে চায়ের দোকান।

গ্রামের মেম্বার দুজন লোকসহ ভেতরে ঢোকেন। চায়ের দোকান বন্ধ করার নির্দেশ না মেনে খোলা কেন? জটলা কেন? এসব বলে সবাইকে সেখান থেকে বের হয়ে বাড়িতে যেতে বলেন। সবাই নড়েচড়ে বসেন।

এবার নফেলের চোখ মেম্বারের দিকে। ‘কী মেম্বার খুব একখান ক্ষমতা পাইছ হাতে মনে হয়! এভাবে মানুষ চটাইলে পরেরবার মেম্বার হইতে পারবা!!’

মেম্বার বলে ‘ভাই যা করা হচ্ছে সবার ভালোর জন্যই করা হচ্ছে।’

‘ও! তাই না!!’

এবার আর একটা প্রশ্নবাণ মেরে দেন মেম্বারকে, ‘বলো দেখি মেম্বার, জোর করে কি মানুষকে ঘরে আটকানো যায়?’

মেম্বার কিছু বলেন না।

ঠিকই তো বলেছে, মানুষ নিজের থেকে না বুঝলে হবে কী করে। তিনি চৌকিদারকে দোকান বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে বলে সুরসুর করে চলে যান।

৩.
বাংলাদেশ থেকে প্রায় আট হাজার কিলোমিটার দূরে স্কটল্যান্ডের এবারডিন শহর যার দূরত্ব লন্ডন থেকে ৬৫০ কিলোমিটার। যুক্তরাজ্যের উত্তর-পশ্চিমের শেষ প্রান্তে স্কটল্যান্ডের তৃতীয় বড় কিন্তু আকারে মাঝারি এ শহরটিতে বাস করে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ। এদের শতকরা ৯০ ভাগই স্কটিশ। শহর ও শহরতলি মিলে বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় হাজার চারেক। যুক্তরাজ্যে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৪০ হাজারের বেশি মানুষের, মারা গেছে ৫ হাজারের কাছাকাছি। পুরো স্কটল্যান্ডের পরিস্থিতি সে তুলনায় ভালো। করোনা শনাক্ত হয়েছে সাড়ে তিন হাজার মানুষের, মারা গেছে দুই শর কাছাকাছি। এ শহরে বাংলাদেশের কেউ আক্রান্ত, এমন খবর পাওয়া যায়নি। তবে, ঘরে বসে আছে সবাই। সবাই মেনে চলছে সব নিয়ম।

আমরা বাংলাদেশের মানুষ যারা বিদেশে আছি, আমাদের প্রত্যেকের মন পড়ে আছে দেশে। আমরা খুব উদ্বিগ্ন, চিন্তিত। দেশে কেউ কারও কথা শুনতে চাইছে না। নফেলদের মতো বিশৃঙ্খল যুক্তিবাদী ছড়িয়ে ছিটিয়ে সারা দেশে। এর মধ্যে গরিব, মধ্যবিত্ত, ধনী, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, ডিগ্রিধারী সবই আছে। তাঁদের নিয়ে বড় জ্বালায় আমরা। এঁরা সুযোগ পেলেই চায়ের কাপে ঝড় তুলছেন। মানুষকে কুপথে চালানোর বিষ কানেও ঢালছেন, বাতাসেও ছড়াচ্ছেন। এঁরা একেকটা জ্যান্ত হিউম্যান করোনা।

পৃথিবীর ১২ লাখ মানুষের শরীরে এ ভাইরাস পাওয়া গেছে, এর মধ্যে ৬৫ হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। দিনে দিনে সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে। বড় অর্থনীতি, কম ঘনত্বের সচেতন জনগণ, আধুনিক স্বাস্থ্যসেবার সবকিছু থাকা সত্ত্বেও বেসামাল অবস্থা বড় দেশগুলোর। আমরা তো সবদিক থেকে পিছিয়ে। তাই ছড়িয়ে পড়ার আগেই নিয়ন্ত্রণই আমাদের মুক্তির নিরাপদ পথ।

সীমিত সম্পদ দিয়েই এতগুলো মানুষ আমরা যদি এ মহাপ্রলয় থেকে নিজেদের যদি রক্ষা করতে চাই, দেশের সরকার যা বলছে, গণমাধ্যম যা প্রচার করছে, তা পালন করতে হবে। সরকার ও জনগণ সবার সম্মিলিত চেষ্টায় এ বিপদ থেকে মুক্ত হওয়ার সংগ্রাম করতে হবে। নিজে সচেতন ও নিরাপদ থেকে অন্যদের জন্য তা করার চেষ্টাই একমাত্র বাঁচার রাস্তা।

নিয়ম সবার জন্য। সবাইকে মানতে হবে। সবার জন্য যা পালনীয়, সেটা কেবলই পালনীয়। নিয়ম না মানাতে কোনো বীরত্ব নেই। হুজুগে চলার সময় এটা নয়। অযৌক্তিক আত্মবিশ্বাসে ভর করা হঠকারী উল্লম্ফন, যুক্তি-কুযুক্তি, আবেগ, জেদ, অগ্রাহ্যপরায়না বা অবাধ্যতা সবকিছুই এখনকার বাস্তবতার কাছে পরাজিত। আমরা যারা বুঝছি ও মানছি, তাদের কাছে ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’ এ তত্ত্বও এখন অসাড়। হতাশা আর সমালোচনার কাসুন্দি ঘাঁটা এখন নিছক পাগলামি। করোনার বাড়ি শীতের দেশে, আমাদের ফরমালিন খাওয়া লোহার শরীর, ওপরওয়ালা আমাদের মাথার ওপর ছাতা ধরে ঠেকিয়ে রাখতেই থাকবেন, ঘরে বসে সৃষ্টিকর্তাকে ডাকলে তিনি শুনবেন না, এসব যুক্তি দিয়ে যারা বিপথে পা বাড়াচ্ছেন, নিজে থামুন, অন্যদের থামান।

*লেখক: স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, এবারডিন ইউনিভার্সিটি, স্কটল্যান্ড