স্কুলে পড়ার সময় আমরা একবার আমাদের পণ্ডিত স্যারকে এপ্রিল ফুল করেছিলাম। স্যার ক্লাসে ঢোকার আগেই আমরা আমাদের হোমওয়ার্কের খাতাগুলো উল্টো করে টেবিলে সাজিয়ে রেখেছি। স্যার এসে একটা একটা করে খাতা তুললেন এবং দেখলেন সবগুলো খাতা ফাঁকা। কোনো হোমওয়ার্ক নেই। স্যার অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকালেন। পেছনের বেঞ্চ থেকে আমাদের বন্ধু রশীদ, পণ্ডিত স্যার যাকে আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ বলে ডাকেন, সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার আজ এপ্রিল ফুল। পণ্ডিত স্যার হেসে বললেন, তাহলে আজ তোমরা আমাকে এপ্রিল ফুল করলে। আজ আমরা আর কোনো পড়াশোনা করব না। শুনে তো আমরা মহাখুশি। স্যার বললেন, তোমাদের খাতাগুলো নিয়ে যাও এবং সবাই তোমাদের খাতার সাদাপাতাতে এপ্রিল ফুল কী, তা লিখে আবার জমা দাও। বুঝলাম এপ্রিল ফুল করে মহা ভুল করে ফেলেছি। তখন ফুল মানে যে বোকা, তা–ও জানতাম না। যাহোক, আমরা যে যার মতো লিখে জমা দেওয়ার পর স্যার সবারটা পড়ে পড়ে শোনালেন এবং সে পর্বটি ছিল খুবই মজার। একজন লিখেছিল, এপ্রিল ফুল মানে, এপ্রিল মাসে যে ফুল ফোটে, তার নাম এপ্রিল ফুল। আরেকজন লিখেছিল, গোলাপ ফুল।
এখনকার মতো তখন এসব ইন্টারনেট–গুগল ছিল না। তাই পণ্ডিত স্যার যা বলতেন, তা–ই ঠিক। স্যার বলেছিলেন, প্রতিবছর এপ্রিল মাসের প্রথম দিন কাউকে বোকা বানিয়ে আনন্দ করা হয় এবং একে সবাই নাম দিয়েছে এপ্রিল ফুল।
এপ্রিল ফুলে কাউকে বোকা বানিয়ে আনন্দ করার প্রথা বহুযুগ আগে থেকেই চলে আসছে। আর পুরাতন প্রথা হিসেবে দেশে দেশে কালে কালে নানান ইতিহাস আর গল্পগাথা এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটানিকা থেকে জানা যায়, এপ্রিল ফুলের উৎপত্তি মূলত রোমান উৎসব হিলারিয়া থেকে, যা চলত ২৫ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত। তবে দিনটি পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন জাতির মধ্যে বিভিন্নভাবে উৎসবের দিন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে।
ইরানে পার্সি ক্যালেন্ডার অনুসারে নববর্ষের ১৩তম দিনে আনন্দ–মজা করা হয়। এই দিন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১ এপ্রিল বা ২ এপ্রিল।
এপ্রিল ফুলের সবচেয়ে প্রচলিত কাহিনি, ১৫৬৪ সালে ফ্রান্সে নতুন ক্যালেন্ডার চালু করাকে কেন্দ্র করে এপ্রিল ফুল ডের সূচনা হয়। ওই ক্যালেন্ডারে ১ এপ্রিলের পরিবর্তে ১ জানুয়ারিকে নতুন বছরের প্রথম দিন হিসেবে গণনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে কিছু লোক তার বিরোধিতা করেন। তাঁরা এই সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন, ২৫ মার্চ থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত তাঁরা আগের মতোই নববর্ষ উদ্যাপন করবেন। কিন্তু যাঁরা পরিবর্তন গ্রহণ করেছিলেন, তাঁরা তাঁদের সঙ্গে মজা করতে শুরু করলেন। যাঁরা পুরোনো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ১ এপ্রিলকেই নববর্ষের প্রথম দিন ধরে দিন গণনা করে আসছিলেন, তাঁদের প্রতিবছর ১ এপ্রিল নববর্ষ উপলক্ষে উপহারের ফাঁকা প্যাকেট পাঠিয়ে বোকা বানিয়ে মজা করা হতো।
অন্য একটি মতে, ফ্রান্সে পয়সন দ্য আভ্রিল (poisson d'avril) উদ্যাপিত হয় এবং এটা মাছের সঙ্গে সম্পর্কিত। এপ্রিলের শুরুর দিকে ডিম ফুটে মাছের পোনা বের হয়। এই মাছের পোনাগুলোকে সহজে বোকা বানিয়ে ধরা যায়। সে জন্য তারা ১ এপ্রিল উদ্যাপন করে পয়সন দ্য এভ্রিল, অর্থাৎ এপ্রিলের মাছ। সেদিন বাচ্চারা অন্য বাচ্চাদের পিঠে কাগজের মাছ (Paper Fish) ঝুলিয়ে দেয় তাদের অজান্তে। যখন অন্যরা দেখে, তখন পয়সন দ্য আভ্রিল (Poisson d’Avril) বা এপ্রিল ফিশ বলে চিৎকার করে। এমনকি এখন পর্যন্ত ফ্রান্সে এ নামেই তাদের ডাকা হয়, যারা এই দিনে বোকা বনে যায়। কবি চসারের ‘ক্যান্টারবারি টেইলস’ (১৩৯২) বইয়ের ‘নানস প্রিস্টস টেইল’–এ এই দিনের কথা খুঁজে পাওয়া যায়।
হল্যান্ডের ইতিহাস অনুযায়ী, ১৫৭২ সালের ১ এপ্রিল হল্যান্ডের ডেন ব্রিএল শহরটাকে লর্ড আল্ভার স্প্যানিশ শাসন থেকে মুক্ত করে ডাচ বিদ্রোহীরা। এইদিন তাঁরা লর্ড আল্ভাকে পুরো বোকা বানিয়ে ছাড়েন। পয়লা এপ্রিলে আল্ভার বোকামিকে স্মরণ করে এপ্রিল ফুল উদ্যাপন করা হয়। এই এপ্রিল ফুল ঘটনার পর অনেক জায়গায় বিদ্রোহীরা সোচ্চার হয় আর স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা পায় হল্যান্ড।
এপ্রিল ফুল শুরুর ইতিহাস নিয়ে এ রকম অনেক কাহিনি প্রচলিত আছে। ইতিহাসের দীর্ঘ সময় পরিক্রমায় এই সব কাহিনি দেশে দেশে কালে কালে এপ্রিল ফুলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো কাহিনি আছে, যেখানে এক পক্ষের আনন্দের সঙ্গে অন্য পক্ষের দুঃখের কাহিনিও আছে। তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায়, এখন দেশে দেশে যে এপ্রিল ফুল উদ্যাপন করা হয়, তা শুধুই মজা করার জন্য। কাউকে একটু বোকা বানিয়ে ধোঁকা দিয়ে নির্মল আনন্দ করার জন্য। যদিও ২০২০ সালের এপ্রিল ফুলে করোনাভাইরাস বিশ্ববাসীর সঙ্গে যে মজা করছে, তা বড়ই নির্মম, বড়ই নিষ্ঠুর আর প্রাণঘাতী। তবু আমাদের বেঁচে থাকার চেষ্টা চলছে নিরন্তর। লকডাউন বা গৃহবন্দী জীবনেও বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন একটু মজা, একটু আনন্দ। তাই সবাই সাবধানে থাকুন। ভালো থাকুন। এপ্রিল ফুলে ঘরে বসে আনন্দ করুন। তবে করোনাবিষয়ক কোনো ভুল তথ্য দিয়ে মজা করবেন না।
আপনার এপ্রিল ফুল দিনটি আনন্দময় হোক।