করোনাভাইরাস সারা বিশ্বের জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতি, দুইয়ের জন্যই এক মহাবিপদ হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। অভূতপূর্ব ও অভাবিত এই জনস্বাস্থ্যসংকট এখন দেশে দেশে যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, তাতে এই অনুমান করা যায় যে এর প্রভাব এমনকি এই ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে আনার পরও অব্যাহত থাকবে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারে বড় রকমের ধস নেমেছে, বিমান কোম্পানিগুলোর ক্ষতির পরিমাণ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, উৎপাদন ও বাণিজ্যে হ্রাস ঘটেছে, পর্যটন খাতের অবস্থা ভয়াবহ। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদের আশঙ্কা, এই ভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিতে পারে। জনস্বাস্থ্যের দিক থেকে এই ভাইরাস যে কতটা প্রসারিত হয়েছে, তার পরিমাপ করা দুরূহ হয়ে পড়েছে; কেননা, অনেক দেশেই কারা আসলে অসুস্থ, তা এখনো জানাই যাচ্ছে না। অপ্রস্তুত সরকারগুলো বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে, যেগুলো আদৌ কোনো ফল দেবে কি না, তা নিশ্চিত নয়; প্রতিরোধের ও প্রতিষেধকের ব্যবস্থা নেই বলে কন্টেইনমেন্ট হয়ে উঠছে প্রথম পদক্ষেপ।
চীনে প্রথম এই ভাইরাসের প্রকোপের মুখে উহানকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার পরে অনেকেই সেই পথে এগোচ্ছেন। চীন দাবি করছে যে উহান ও গোটা হুবেই প্রদেশের অবস্থা এখন পুরো নিয়ন্ত্রণে। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ওই এলাকা সফর করে তা–ই দেখাতে চেয়েছেন। কিন্তু এই ভাইরাস এখন আর চীনের সীমানার ভেতরে নেই। ছয় শতাধিক মানুষ মারা যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ইতালি সারা দেশেই কোয়ারেন্টাইন চালু করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের কাছে একটি এলাকায় এই রকম কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা জারি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, তাতে বৈশ্বিকভাবেই একধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, যদিও বারবার এটা বলা হচ্ছে যে দরকার হচ্ছে সচেতনতা ও সাবধানতা, কিন্তু তা সত্ত্বেও অনিশ্চয়তার কারণে সাধারণের প্রতিক্রিয়া হয়েছে ভীতির।
এই ভাইরাসের ব্যাপ্তি ও প্রভাব এতটাই যে, কেউ কেউ এই পরিস্থিতি বোঝার জন্য ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ তত্ত্বের আশ্রয় নিচ্ছেন, প্রশ্ন উঠেছে করোনাভাইরাসকে আমরা ‘ব্ল্যাক সোয়ান ইভেন্ট’ কালো রাজহাঁসের ঘটনা বলে বর্ণনা করতে পারি কি না। ফরাসি-লেবানিজ-মার্কিন গবেষক নাসিম নিকোলাস তালেব ২০০৭ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ দ্য ব্ল্যাক সোয়ান: দ্য ইম্প্যাক্ট অব দ্য হাইলি ইমপ্রোবেবল–এ এমন সব ঘটনার কথা বলেছিলেন, যেগুলো বিরল ও অনিশ্চিত; যেগুলো সাধারণত মূলধারা বিবেচনার বাইরে থাকে, কিন্তু তার প্রভাব হয় ব্যাপক। ব্ল্যাক সোয়ানের ধারণা এবং এই বিষয়ে একধরনের তত্ত্ব দর্শনশাস্ত্রে আগে থাকলেও তালেব তাঁর বইয়ে নতুনভাবে একে বিবেচনা করেন এবং একে সমসাময়িক রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক, এমনকি ব্যক্তিজীবনে, তার প্রাসঙ্গিকতা ও ব্যবহারের দিক উন্মোচন করেন।
তালেব তাঁর বইয়ে ব্ল্যাক সোয়ান তত্ত্বের মাধ্যমে যেসব ঘটনার ব্যাখ্যা করেছেন, সেগুলো হচ্ছে প্রথমত আর্থিক, প্রযুক্তির মতো খাতগুলোতে আমরা যা স্বাভাবিকভাবে আশা করি, তাঁর বাইরে অত্যন্ত বড় ধরনের, পূর্বানুমান করা দুরূহ বিরল ঘটনা; দ্বিতীয়ত, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এই ধরনের ঘটনার সম্ভাব্যতার হিসাব করতে না পারা, কেননা, এগুলোর সম্ভাবনা অত্যন্ত কম; তৃতীয়ত, সাধারণ মানুষের ব্যক্তি হিসেবে ও গোষ্ঠীগতভাবে অনিশ্চয়তা এবং বিরল ঘটনার বিরুদ্ধে মানসিক পক্ষপাত রয়েছে। সহজ করে বললে, আমরা এটা ভাবতে অভ্যস্ত নই যে বিরল ঘটনা, যা অনুমান করা যাচ্ছে না, তা এত বড় আকারে ঘটবে।
তালেবের ভাষ্য অনুযায়ী যেকোনো ব্ল্যাক সোয়ান ঘটনার তিনটি বৈশিষ্ট্য—১. এই ঘটনা হচ্ছে বিস্ময়কর; ২. এই ঘটনার বিরাট প্রভাব পড়ে; ৩. প্রথম ঘটনার পরে একে পেছনের ঘটনাবলি দিয়ে যৌক্তিক বলে দাঁড় করানোর চেষ্টা হয়; যেন এটি আশা করা যেতেই পারত। বলা হয় যে সংশ্লিষ্ট উপাত্ত আসলে ছিল, কিন্তু ঝুঁকি হ্রাসের বা প্রশমনের ক্ষেত্রে এগুলো যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয়নি। তালেব বলেছেন যে এই ধরনের ঘটনা কেবল রাজনীতি বা ইতিহাসের বিষয় নয়, অর্থনীতি বা প্রযুক্তির উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও তা–ই ঘটেছে।
অবশ্যই করোনাই প্রথম ‘ব্ল্যাক সোয়ান ইভেন্ট’ হিসেবে বিবেচিত নয়। তালেব তাঁর বইয়ে ৯/১১-এর সন্ত্রাসী হামলাকেও এই ধরনের ঘটনা বলেই উল্লেখ করেছেন। আরও উদাহরণ আছে। কিন্তু করোনার বিস্তৃতি ও ব্যাপকতা থেকেই একে আরও বেশি করে এই বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে। গত কয়েক সপ্তাহের আলোচনায় দেখা যাচ্ছে অনেকেই বলছেন যে এই ধরনের একটি ভাইরাসের আশঙ্কা আগেই করা হয়েছিল, কিন্তু সেই বিষয়ে আগে থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ফলে ঘটনার পরে যৌক্তিকতা তৈরির যে কথা তালেব বলেছিলেন, তার লক্ষণ সুস্পষ্ট।
কিন্তু সবাই এই করোনাকে ব্ল্যাক সোয়ান বলতে রাজি নন। দ্য উইক পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে জেমস পেথোকোউকিস (মার্চ ৮, ২০২০) এই ধারণার বিরুদ্ধে যুক্তি দিয়েছেন। তাঁর যুক্তিটি যতটা না, এই ঘটনা আদৌ ব্ল্যাক সোয়ান কি না, তা নিয়ে তার চেয়ে বেশি হচ্ছে এই যুক্তি দেখিয়ে সরকারগুলো তাদের প্রস্তুতির ঘাটতির দায়িত্ব যেন অস্বীকার করতে না পারে। কেননা, পৃথিবীজুড়ে প্যানডেমিকের আশঙ্কার কথা আগে বহুবার বলা হয়েছে। ২০১৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আডহানোন হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, যেকোনো সময় একটা প্যানডেমিক শুরু হতে পারে এবং তাতে ১০০ মিলিয়ন লোক মারা যেতে পারে। দুবাইতে ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮-তে অনুষ্ঠিত শীর্ষ বৈঠকে স্প্যানিশ ফ্লুর উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, এটা কোনো দুঃস্বপ্নের চিত্রকল্প বা নাইটমেয়ার সিনারিও নয়, আগেও ঘটেছে।
সরকারের অবহেলার এক বড় উদাহরণ হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন। ২০১৮ সালে দেশের সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল বা সিডিসির মহামারি প্রতিরোধক গবেষণা ও কাজের বাজেট হ্রাস করা হয় প্রায় ৮০ শতাংশ। যে কারণে এখন দেখা যাচ্ছে যে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করার যে কিট বা উপকরণ, তা পেতেই সময় চলে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসনের এই আচরণ তাঁর অন্য আচরণ থেকে ভিন্ন নয়, বিজ্ঞানকে অস্বীকার করে জলবায়ু পরিবর্তনকে কিংবা করোনাকে ‘হোক্স’ বা ধাপ্পাবাজি বলার মধ্যেই তার প্রমাণ। মার্কিন প্রশাসন এই ব্যাপারে যেমন ভূমিকা পালন করেছে, ঠিক তেমনি এই ধরনের মহামারির প্রস্তুতির অভাব এমনকি চীনেও দেখা গেছে।
এখন এক মহামারির মুখে বিভিন্ন দেশে যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, সেগুলোর সাফল্য দরকার মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই। জনস্বাস্থ্যবিষয়ক এই বৈশ্বিক সংকটের মুখে আর যা দরকার, তা হচ্ছে স্বচ্ছতা। এই অভিযোগকে একেবারে নাকচ করে দেওয়া যাবে না যে ডিসেম্বরের শেষ দিকে যখন এই ভাইরাস প্রথম ধরা পড়ে, তখন চীনের প্রতিক্রিয়া ছিল অস্বচ্ছ ও শিথিল। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মাত্রা ছোট করে দেখানোর মধ্যে যে বিপদ তা ভয়াবহ, চীন, ইরান বা যেকোনো দেশেই তা সমভাবে প্রযোজ্য।
প্রস্তুতির অভাব একধরনের দায়িত্বহীনতার প্রমাণ, কিন্তু দেশে এই ধরনের ভাইরাসে আক্রান্তদের সংখ্যা কমিয়ে দেখানো কিংবা দ্রুততার সঙ্গে তা মোকাবিলায় পদক্ষেপ না নেওয়া বিপদের মাত্রাকে কমানোর বদলে বাড়াবেই।
আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো