করোনাভাইরাসে না-জানার বিপদ, স্বভাবের আপদ

দেশে নতুন করোনাভাইরাসটি ঢোকার খবর জানা গেল গত রোববার। তারপর ঢাকার দোকানগুলো থেকে সাবানের বিকল্প বলে পরিচিতি পাওয়া স্যানিটাইজার নিমেষে উধাও। সেই ইস্তক রাস্তাঘাটে মানুষের মুখে মাস্কও যেন বেশি চোখে পড়ছে।

ফেসবুকে আতঙ্ক, পরামর্শ আর গুজবের ছড়াছড়ি। কিন্তু সতর্কতার সঠিক পরামর্শগুলো মানুষজন জানছে বা মানছে কি? এই কৌতূহল থেকে গত সোম-মঙ্গলবার ঢাকা আর কেরানীগঞ্জের বেশ কয়েকটা জায়গায় গেলাম। কম করে ৫০ জনের সঙ্গে কথা বললাম।

সারকথা যা বুঝলাম, আতঙ্ক যতটা ছড়িয়েছে, ঠিকঠাক তথ্য ততটা নয়। আবার আতঙ্কও সবার মধ্যে ছড়ায়নি। তবে এই যাত্রায় আমি আতঙ্কিত হয়েছি। সেটা অবশ্য পথেঘাটে-বাজারে ময়লা-আবর্জনা নতুন চোখে দেখে।

সোমবার বিকেলে গিয়েছিলাম কারওয়ান বাজারে। কাঁচাবাজারের পেছনের গলিতে দেশি মুরগি বেচাকেনা-কাটাকুটি হচ্ছে। রক্তমাখা পালক আর নাড়িভুঁড়ির পাশে প্লাস্টিকের চেয়ার পেতে বসে ছিলেন কাঁচামালের আড়তদার আমির হোসেন।

করোনাভাইরাসের কথা জিজ্ঞাসা করতে বললেন, ‘আমি মুসলমান। আমাকে মরতে হবে, করুণা আর ফরুনা যা-ই কিছু হোক। ‍মৃত্যু যেদিন আসবে, সেদিন কেউ রাখতে পারবে না। অতএব করোনাকে ভয় করি না, আল্লাহকে ভয় করি।’

কিন্তু সতর্কতা? আমির বললেন, সতর্ক হচ্ছেন। তবে ভয়ডর নেই। পাশেই মুরগি বিক্রি করছিলেন নান্নু মিয়া। তাঁর কথা বলারই গরজ নেই। সাফ বললেন, করোনার কথা শোনেননি।

আমির হোসেনের ভয়ডর নেই। ছবি: লেখক

কাঁচাপাকা দাড়ি, দাঁত ফোকলা মো. নূর নবী সবজির খুচরা বিক্রেতা। তিনি ‘করোনা’ শব্দটা জানেন। বললেন, ভালোভাবে হাত–মুখ ধুতে হবে। হাঁচি-কাশিওয়ালা মানুষজনের থেকে ‘৯ ফুট’ দূরে থাকতে হবে।

তবে ‘বাজারে তো এগুলা মানা যায় না। সবার সাথে ওঠাবসা করতেই হবে।’ নূর নবীরও ভয়ডর নেই—‘আল্লার ওপরে ভরসা, দিল খোলাসা।’

বেচাবিক্রির ফাঁকে ছুরি দিয়ে টমেটো কেটে খাচ্ছিলেন সাবের হোসেন। নীল ড্রামের ঘোলাটে পানি দেখিয়ে বললেন, ধুয়ে নিয়েছেন। আর নিজে সকালে বাসা থেকে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে এসেছেন।

সাবের ‘করলা’ভাইরাসের কথা শুনেছেন, তবে তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় নেই—‘বড় লোকের সময় আছে, তারা ভাবুক’।

বিকেলে আবছা আলোয় কাঁচাবাজারের চালার ভেতরে সবজির সবুজ, বেগুনি আর কমলা রং চোখকে টানে। দূর থেকে মনে হয় যেন ছবি আঁকা।

কাছে গেলে ময়লা-আবর্জনা চোখে পড়ে। তারই মধ্যে টুলে বসে চা খাচ্ছিল বালক রিটন। বলল, কাপে করে খাচ্ছে, হাত ধোয়ার দরকার নেই।

হাজী আবদুস সোবহানের গায়ে ফকফকে সাদা ফতুয়া, মাথায় সাদা টুপি। সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, টিস্যু বা কনুই দিয়ে ঢেকে হাঁচি-কাশি দেওয়ার নিয়মগুলো তিনি জানেন।

বাবু ফল বিক্রি করেন। ছবি: লেখক

সামনের রাস্তায় ফলওয়ালা বাবু একটা কমলা খুলে খাচ্ছিলেন। আমাকেও দুই কোয়া সাধলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, করোনাভাইরাস সম্পর্কে তিনি কী জানেন।

বাবু বললেন, শুনেছেন এই ভাইরাস থেকে জ্বর হয়, সর্দি-ঠান্ডা লাগে। এটার থেকে দূরত্বে থাকতে হবে। কোনো কিছু খাওয়ার আগে সুন্দর করে হাত ধুতে হবে।

সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার বার্তা অনেকের কাছেই পৌঁছেছে। কিন্তু বিক্রেতারা বললেন, বাজারে বসে বারবার তা করার সুযোগ নেই।

ফল কিনতে এসেছিলেন গৃহিণী সুমি। বললেন, এটা ছোঁয়াচে রোগ। বাচ্চাদের বলছেন কারও হাঁচি-কাশি হলে তার থেকে দূরে থাকতে। মাস্ক পরতে, বাইরে থেকে ফিরে হাত-মুখ ধুতে।

সুমির সঙ্গে ছিল ছেলে। হলুদ মাস্ক পরা বালক, ডাকনাম দোয়া। সে গড়গড়িয়ে হাত-পা ধোয়া আর মাস্ক পরার গুরুত্বের কথা বলে গেল। বলল, করোনাভাইরাস একটা ‘আতঙ্কিত রোগ’

‘আমি কী ডরামু?’—আমেনা। ছবি: লেখক

কারওয়ানবাজারের ঝাঁকা মুটে মনসুর আলী রীতিমতো দার্শনিক। বললেন, ‘বিদেশে হইছে। বিদেশে থে আমার দ্যাশে তো আইসা সারে নাই, দেহিও নাই। ভয়? আল্লাহ্‌পাক সৃষ্টি করসে, আল্লা নিব, ভয় কিসের?’

শীর্ণ কালো হাতে বঁটিতে কেটে ঝড়তিপড়তি আদার পচা অংশ বাদ দিচ্ছিলেন আমেনা। সস্তায় বেচবেন। বললেন, ‘ভাইরাসের রুগি বলে বিদেশ থেইকা পাঠাইসে!’

আমেনা রাস্তায় থাকেন। পান খাওয়া মুখে হেসে বলেন, ‘আমি কী ডরামু? আমারে নিলে গা বেশি ভালা।’

কোভিড-১৯ নামের এই রোগের তথ্য আর সতর্কতার নিয়মগুলো জানিয়ে সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিচ্ছে। তবে পত্রপত্রিকা বা টিভি-ফেসবুক মনসুর-আমেনাদের নাগালের বাইরে। সাধারণ সাবানও তাঁদের জন্য দুষ্প্রাপ্য।

টাকার ঝুঁকি বড় ঝুঁকি। ছবি: লেখক

এই দেশে, এই শহরে আমরা ঘেঁষাঘেঁষি থাকি, গায়ে গায়ে চলি। ভাড়ার মোটরসাইকেলের বারোয়ারি হেলমেট পরি। কষ্টের রোজগারের নোংরা টাকা আঙুলে ঘষে ঘষে গুনে হাতবদল করি। পথেঘাটে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার সুযোগ হয় না, মনেও থাকে না।

মঙ্গলবার সকালে যাত্রা করলাম কেরানীগঞ্জের আঁটিবাজারের দিকে। রাস্তা ধুলায় ধূসর, জায়গায় জায়গায় নোংরা-নর্দমা। তবে মধ্যের চরে দীন মোহাম্মদের মুদি কাম চা-নাশতার দোকানটি ছিমছাম।

দীন টিভি দেখেন না। নতুন ভাইরাসের কথা শুনেছেন, কিন্তু বিশেষ কিছু জানেন না।

দোকানের সামনে বেঞ্চিতে বসে চায়ে চুমুক দিই। মুখোমুখি বেঞ্চিতে বসে নাশতা সারলেন মো. আবুল কালাম। কালিন্দী এলাকায় তাঁর ফুলের দোকান আছে।

কালাম সকাল থেকে রাত অবধি পরিশ্রম করেন, খুব একটা খবর রাখতে পারেন না। বললেন, করোনাভাইরাস ঠেকানোর জন্য মাস্ক পরা ও ঘন ঘন সাবান দিয়ে হাত ধোয়া উচিত। তিনি নিজে অবশ্য দিনে দু-চারবার, কখনোবা একবারই সেভাবে হাত ধুয়ে থাকেন।

আবর্জনা আর কচুরিপানায় আঁটিবাজারে বুড়িগঙ্গার খালটার অবস্থা খারাপ। সেটা পেরিয়ে ডানে মোড় নিলে সামনেই দোকানটা। উঁচু বেদিতে বসে দুই কিশোর ময়দা মাখছে, দুই তরুণ বাখরখানি বেলছেন।

বাখরখানির ওস্তাদ প্রবীণ ইউনুস আলী (ডানে)। ছবি: লেখক

তন্দুরে সেগুলো সেঁকছেন স্যান্ডো গেঞ্জি পরা প্রবীণ ইউনুস আলী। তিনি করোনাভাইরাসের নাম শুনেছেন, কিন্তু করণীয় জানেন না। কর্মচারী মো. কাদির মাস্ক পরা আর পরিষ্কার থাকার কথা ভাসা-ভাসা শুনেছেন।

পাশের মুদিদোকানি মো. জামাল বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের তিনজন রোগী শনাক্ত হওয়ার কথা জানেন। হ্যান্ডওয়াশ দিয়ে হাত ধোয়ার কথাও জানেন।

জায়গাটা কাঁচাবাজারের কাছাকাছি। মাছি ভনভন করছে। কয়েকটা কামালের মুখে-গায়েও বসে।

নর্দমা পেরিয়ে যে গলি দিয়ে কাঁচাবাজারে ঢুকলাম, তার এক দিকে মুরগির দোকান। রক্ত, নাড়িভুঁড়ি আর পালকে জায়গাটা সয়লাব। বড় ছুরি দিয়ে মুরগি টুকরো করছে এক কিশোর। ছাঁট ছিটকে এসে গায়ে লাগে।

পাশেই সবজি বিক্রি করছেন আকাশ। সতর্কতার সাধারণ নিয়মগুলো তিনি জানেন, তবে সারা দিনে বাজারে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অবস্থা নেই।

সবজি বিক্রেতা আকাশ মোটামুটি খবর রাখেন। ছবি: লেখক

বাজার করতে এসেছিলেন অ্যালুমিনিয়াম-সামগ্রীর ব্যবসাদার সিরাজ। পেপার-পত্রিকা পড়েন, টিভি দেখেন। সতর্কতার নিয়মগুলো বেশ গুছিয়ে বললেন। আরও বললেন, নিজে নিরাপদ না থাকলে সেটা অন্যদের জন্য ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াবে।

যত জায়গায় গেলাম, কোথাও সতর্কবার্তার বিলবোর্ড-পোস্টার বা প্রচার দেখিনি। তবে পথে পথে সর্দি-কফ ফেলার চিহ্ন দেখলাম। আমরা রাস্তাঘাটে পিচ করে পানের পিক-কফ-থুতু ফেলি, হাঁচি এলে হেঁচে দিই। এ আপদ স্বভাবের, যা নাকি মরলেও যায় না!

কুররাতুল-আইন-তাহ্‌মিনা: সাংবাদিক
qurratul.tahmina@prothomalo.com

আরও পড়ুন:

হঠাৎ তুফানের এক সকালে ঢাকার মানুষেরা
সরকারি প্রাথমিক স্কুলে, সাম্মিরের বালিশের খোঁজে