করোনাকালে দেশে ফেরা প্রবাসীদের কথা

বুধবার দুপুরে গিয়েছিলাম দোহার আর নবাবগঞ্জে। উদ্দেশ্য, করোনাকালে দেশে ফিরে আসা প্রবাসীদের খোঁজখবর করা। তাঁদের কথাগুলো শোনা।

ঢাকার রাস্তা আর মহাসড়ক, দুই–ই ফাঁকা। বছিলা হয়ে, কেরানীগঞ্জ থেকে প্রথম আলোর প্রতিনিধি ইকবাল হোসেনকে তুলে নিলাম। চললাম মূল সড়ক ছেড়ে, কখনো গ্রামের ভেতরের পথ ধরে।

যবে থেকে আতঙ্কের পারা চড়ছে, নানা আলোচনায় শুনছি, গত দুই মাসে প্রবাসফেরতা মানুষজন বাইরে ঘোরাঘুরি করে ভাইরাসটি ছড়িয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে সরকারের অদায়িত্বশীলতার কথাও ওঠে বটে, তবে ঝাঁজটা যেন প্রবাসফেরতাদের ওপরই বেশি। সেটা কখনো বিদ্বেষের চেহারাও ধরছে। বিশেষ করে ইতালিফেরতাদের বেলায়।

দোহারে শ্বশুরের বিধানে ঘরবন্ধ এক হাসিখুশি জামাইকে দেখে আনন্দ হলো। আর নবাবগঞ্জে জানাবোঝায় নানা রকম ফাঁকের কথা বুঝতে পারলাম। দুটি গ্রামে চারজনের সঙ্গে কথা বলেছি। তাঁরা এসেছেন দোহা, আবুধাবি ও মিসর থেকে।

ইতালিফেরত পাঁচজনের সঙ্গে লম্বা সময় ধরে কথা বলেছি, তবে ফোনে। তাঁরা শরীয়তপুরের নড়িয়া আর মাদারীপুরের অবরুদ্ধ শিবচর উপজেলায় আছেন। দুজনের গল্প শুনে মনটা খারাপ হলো।

ঘুরে দেখে আর কথা বলে বুঝলাম যে ঘরবন্ধ বা হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার অর্থটা অনেকের কাছেই স্পষ্ট নয়। গত সপ্তাহ দুয়েকেও যাঁরা এসেছেন, বিমানবন্দরে পরিষ্কার পরামর্শ পাননি।

তাঁরা সেখানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যকার্ড পেয়েছেন। তবে একটি কার্ডের তথ্যে গুরুতর অস্পষ্টতা আছে। আরও আগে যাঁরা এসেছেন, তাঁরা অবশ্য এটুকুও পাননি।

বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য পরীক্ষা হয়েছে নামকাওয়াস্তে বা একেবারেই না। অন্যদিকে, এলাকায় বিদেশফেরতাদের সম্পর্কে ভীতি আছে, কখনো টিটকারি এমনকি বিদ্বেষের কথা শুনতে হয়।

এখন বরুণ ফুলের সময়। ছবি: লেখক

নবাবগঞ্জ আর দোহারের পথটা এত সুন্দর যে নভেলা করোনাভাইরাসের কথা মনে থাকতে চায় না। দুই পাশে সাদা ফুলে ভরা বরুণ অর্থাৎ বৈন্যাগাছ। গাঢ় সবুজ ধানখেত। নানা নকশার নানা রঙের বাড়িগুলোতে প্রবাসী আয়ের চিহ্ন।

রাস্তায় সেনা-পুলিশের কড়া নজরদারি। বাজারগুলোর বেশির ভাগ দোকান বন্ধ। গালিমপুর বাজারে মুদিদোকান খুলে সামনে ফলের পসরা সাজিয়ে বসেছিলেন হারুন অর রশীদ। বললেন, ‘পরিবার’ তাঁকে ‘বিদেশি’দের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে বা চলাফেরা করতে নিষেধ করেছে।

তবে তিনি বললেন, নানা দিক থেকে চাপ আছে। এখন বিদেশিরা বেরোচ্ছে কম। অটোরিকশাচালক মো. মাজেদ মোল্লা বললেন, চাপটা অবশ্য আসছে দিন দশেক হলো।

দোহারে শিলাকোঠা গ্রামে লাল নিশান পোঁতা একটা বাড়ির সামনে থামি। বাড়িটা কুসুমহাটি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হারুন অর রশীদের। তাঁর ছোট জামাই মো. শামিম ১১ মার্চ দুবাই থেকে এসে ঘরবন্দী আছেন। নিশানটা সে জন্য।

জামাই–শ্বশুর একযোগে। ছবি: লেখক

টিনের ঘরটা রাস্তা থেকে দেখা যায়। জানালা খুলে গ্রিলের ওপাশ থেকে কথা বলেন শামিম। বলেন, বিমানবন্দরে তাঁকে কেউ ঘরবন্ধের কথা বলেনি। পরীক্ষা বলতে, ‘কপালে থার্মোমিটার ধরসে।’

তবে শ্বশুরের বিধানে তিনি ঘরটিতে একেবারে একা থাকছেন। খাওয়াদাওয়াও সেখানেই। শামিম বলেন, ‘জনস্বার্থে ১৪ দিন নিজের ইচ্ছায় এখানে রইসি।’

স্থানীয় ব্যবসায়ী আবু নাইম বললেন, সবাই যে ঘরবন্ধ পুরোপুরি মানে তা কিন্তু না। অনেকে বাজারে এসে কেনাকাটা করে, বলে ‘আমি তো রোগী না, ১০ মিনিটে চলে যাব।’

নবাবগঞ্জের যন্ত্রাইল ইউনিয়নে ‘খ্রিষ্টানপাড়া’ নামে পরিচিত এলাকার ঘরে ঘরে প্রবাসী। বালিডিওর গ্রামের বিরেশ গাব্রিয়েল গমেজ ছিলেন আবুধাবিতে নামী হোটেলের শেফ। এগারো বছর আগে অবসর নিয়েছেন।

ধর্মীয় একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিনি আর তাঁর স্ত্রী এনি লাবনী গমেজ ৫ মার্চ কায়রো গিয়েছিলেন। ১০ তারিখে তাঁরা ফেরেন। স্বামী-স্ত্রী দুজনই বললেন, বিমানবন্দরে তথ্যকার্ড দিয়ে বলা হয়েছে, তাঁদের কোনো সমস্যা নেই।

নামকরা শেফ বিরেশ এখন অবসরে। ছবি: লেখক

কার্ডটিতে দেখি লেখা, চীন, সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি, ইরানসহ পৃথিবীর ‘কয়েকটি দেশে’ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। সেই দেশগুলোতে ভ্রমণ করলে ১৪ দিন পরিবারের অন্য সদস্যদের থেকে কমপক্ষে তিন ফুট দূরত্ব রেখে নিজের বাসায় থাকতে হবে।

কার্ডে ‘কয়েকটি দেশ’-এর ব্যাখ্যা বা মিসরের নাম লেখা ছিল না। অথচ মিসরে প্রথম সংক্রমণ দেখা যায় ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। ২৫ মার্চ নাগাদ দেশটিতে ৪০০ জনের বেশি সংক্রমিত হয়েছে।

বিরেশ ও লাবনী বলছেন, তাঁরা ফিরে এসে বাসাতেই থেকেছেন। এদিকে একই উঠানে পাশের বাড়িতে বিরেশের ভাস্তে-বউ ১৮ মার্চ আবুধাবি থেকে ফিরে অব্দি ঘরবন্দী আছেন।

দোতলায় ঘরের জানালায় তাঁকে দেখি। তাঁর তথ্যকার্ডটিতে সাধারণভাবে ‘সংক্রমিত দেশের’ কথা বলা আছে, কোনো নাম নেই। ২১ মার্চ তিনিসহ বিদেশ প্রত্যাগত ব্যক্তিদের তালিকা নিয়ে উপজেলা প্রশাসনের একটি দল পাড়ায় আসে।

স্বেচ্ছায় ঘরবন্দী জীবন। ছবি: লেখক

প্রশাসন ঘরবন্ধের নিয়ম ভাঙায় প্রবাসফেরতা দুটি ছেলেকে ৫ হাজার টাকা করে জরিমানা করে। মিসরযাত্রার কথা জানতে পেরে তালিকায় নাম-না-থাকা বিরেশ দম্পতিকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করে আবার ১৪ দিন ঘরবন্ধের বিধান দেয়।

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার বাচ্চু শেখ ইতালির তুরিন শহরে একটি যন্ত্রপ্রকৌশল কারখানায় কাজ করেন। প্রায় ১৯ বছর আগে কাগজপত্র ছাড়া দেশটিতে গিয়েছিলেন। ২০০৩ সালে সরকার সুযোগ দিলে বৈধ হয়েছেন।

বাচ্চু ছুটিতে দেশে ফিরেছেন ২৯ ফেব্রুয়ারি। রাত্রি দুইটায় শাহজালাল বিমানবন্দরে নেমে ভোর পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন বাচ্চু। কেউ নাকি তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেনি বা তাঁকে ঘরবন্ধের কথা বলেনি। তিনি ফোনে বলেন, ইতালিতে শোনামতো কয়েক দিন বাসায় ছিলেন।

নড়িয়ারই জাহাঙ্গীর আলম অবৈধভাবে ইতালি গিয়েছিলেন ১৯৯৯ সালে। এখন তিনি ভেনিসের কাছে একটি কৃষি খামার, এক গেস্টহাউস আর একটি অনলাইন টিভি কোম্পানি চালাচ্ছেন। সেখানকার নাগরিক হয়েছেন।

মালা বিক্রেতা থেকে ভেনিসের হোটেলমালিক জাহাঙ্গীর আলম। ছবি: সংগৃহীত

জাহাঙ্গীর ছেলের মুসলমানি করাতে ১২ ফেব্রুয়ারি সপরিবার দেশে ফিরেছেন। তিনি বলছেন, প্রথম দিকে ঘরবন্দী থাকার কথা সেভাবে কেউ বলেনি। সরকার ১৪ মার্চ ইতালিফেরত একটি দলকে ঢাকায় হজ ক্যাম্পে রাখে। সেখানকার অবস্থা দেখে মানুষের আস্থা চলে যায়।

তবে পরে যাঁরা এসেছেন, তাঁদের ওপর প্রবাসীসহ সমাজের মানুষজন চাপ দিয়েছে। জাহাঙ্গীরের মতে, কয়েকজন বাদে বাকিরা এখন নিয়ম মানছেন।

একই এলাকার মনির ছৈয়ালও ভেনিসে ব্যবসা করেন। গত ৩ ফেব্রুয়ারি ছুটিতে ফিরেছেন। তিনি বলছেন, বিমানবন্দরেই সঠিক নির্দেশনা দেওয়া দরকার ছিল। সেটা এখনো হচ্ছে না।

সবাই কিন্তু যথাসাধ্য সতর্ক থাকতে চান। তবে সুস্থ মানুষজন বুঝতে পারে না, কেন ঘরবন্দী থাকতে হবে। কারণগুলো খুলে বোঝানো দরকার ছিল। এখনো দরকার, যত্ন নিয়ে সহৃদয়ভাবে।

এদিকে করোনার ধাক্কায় মাদারীপুরের অবরুদ্ধ উপজেলা শিবচরের আব্দুল হালিম আর নড়িয়ার নেপাল মণ্ডলের খুঁটি নড়ে গেছে।

আব্দুল হালিম কাজ করেন ইতালির মিলানের একটি রেস্তোরাঁয়। দুমাস আগে বউ-বাচ্চা নিয়ে দেশে বেড়াতে এসেছিলেন। গত মাসের শেষ সপ্তাহে কাজে ফিরে যান একা। কিন্তু টালমাটাল ইতালিতে রেস্তোরাঁটি বন্ধ হয়ে যায়। তিনি ১১ মার্চ আবার দেশে আসেন।

নড়িয়ার নেপাল মণ্ডল ইতালির জেনোয়ায় জাহাজের কর্মচারী ছিলেন। কাজটা হারিয়ে ৩ মার্চ দেশে ফেরেন। ২০০৭ সালে ১২ লাখ টাকা দিয়ে কাগজপত্র জোগাড় করে দেশটিতে গিয়েছিলেন।

প্রবাসীদের অনেকেই ভয় করছেন: হারুন অর রশীদ। ছবি: লেখক

যাওয়ার খরচ ওঠাতে পারেননি নেপাল। হাতে করে ৬০০ ইউরো আনতে পেরেছেন। বউ-ছেলেমেয়েসহ বাড়িতে থাকছেন, দূরত্ব রাখার চেষ্টা করে।

কিছু মানুষের কথা কিন্তু তাঁদের সবাইকে দুঃখ দেয়। মনির বলছিলেন, এমনও বলে, ‘১০০ গজ দূরে থাক।’ এখন সময় খারাপ, ‘তাই হাইস্যা উড়ায়া দিই। কিন্তু ভিতরে ভিতরে ঠিকই কষ্ট লাগে।’

আমি ভাবি, দূরত্ব কিসে হয়? নিরাপত্তার জন্য তিন ফুট বা ছয় ফুট দূরত্বে থাকায় দূরত্ব তৈরি হয় না। দূরত্ব হয় কেউ কাউকে দূর দূর করলে। আর মানুষে–মানুষে অবজ্ঞা আর আতঙ্কের দূরত্ব তৈরি হলে করোনাকাল পার করা আরও কঠিন হবে।

কুররাতুল-আইন-তাহ্‌মিনা: সাংবাদিক
qurratul.tahmina@prothomalo.com