করোনাভাইরাসের মহামারিতে পর্যুদস্ত বিশ্ব। তবে এ সংকটে আশার আলো হয়ে এসেছে টিকা। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশেই টিকা প্রয়োগও শুরু হয়ে গেছে। তবে এ পরিস্থিতিতে টিকার কার্যকারিতা নিয়ে মানুষের মনে নানা ধরনের প্রশ্ন জেগেছে। টিকা নেওয়া, না নেওয়া নিয়েও অনেকে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, সবচেয়ে কম কার্যকর টিকাও অত্যন্ত কাজের।
দরিদ্র দেশগুলোয় টিকা কর্মসূচি জোরদারে সরকারি–বেসরকারি অংশীদারত্বের বৈশ্বিক জোট গ্যাভি, দ্য ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্সের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ মন্তব্য করা হয়। শুক্রবার প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। এতে বলা হয়, করোনার টিকাগুলোর মানবদেহে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষার প্রথম ফলাফল আসার আগেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, কোনো টিকার কার্যকারিতা ৫০ শতাংশের বেশি হলেই তা অনুমোদন পাওয়ার যোগ্য।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন করোনার বেশ কয়েকটি টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছে। দেশে দেশে অনুমোদনপ্রাপ্তির তালিকায় এখন শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার ও জার্মানির বায়োএনটেক উদ্ভাবিত করোনার টিকাটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এখন পর্যন্ত এ টিকার অনুমোদন দিয়েছে। মানবদেহে পরীক্ষায় টিকাটির ৯৫ শতাংশ কার্যকারিতা পাওয়া গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের মডার্নার টিকাও ৯০ শতাংশের বেশি কার্যকারিতা দেখিয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রায় ৭০ কার্যকর বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
তবে যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশে করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের (স্ট্রেইন) আবির্ভাবে টিকার কার্যকারিতা নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের নোভাভ্যাক্স এবং জনসন অ্যান্ড জনসনের টিকার পরীক্ষার ফলাফলে এ সংশয় আরও জোরালো হয়েছে। যদিও টিকা উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠানগুলো বলেছে, করোনার নতুন ধরনের বিরুদ্ধেও এসব টিকা সুরক্ষা দিতে সক্ষম।
গবেষকেরা অবশ্য বলছেন, টিকায় পরিবর্তন আনা সম্ভব, যেমনটা ইনফ্লুয়েঞ্জা ফ্লুর টিকায় প্রতিবছর আনা হয়। তবে করোনাভাইরাসের টিকায় এমন পরিবর্তনের প্রয়োজন না–ও পড়তে পারে। বিশেষ করে, যদি বিপুলসংখ্যক মানুষকে টিকা দেওয়া যায় এবং এসব টিকা যদি মাঝারি মানের সুরক্ষাও দিতে পারে। এমনকি কম কার্যকর টিকাও সংক্রমণ প্রতিরোধ, স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপর চাপ কমাতে এবং করোনায় মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। সেদিক থেকে যেসব টিকা প্রয়োগ করা হচ্ছে, তা তুলনামূলক অনেক বেশি কার্যকর।
একটি টিকার কার্যকারিতা বলতে মূলত টিকাটি কতটা সুরক্ষা দিতে পারে, তাই বোঝায়। এ ক্ষেত্রে মানবদেহে টিকার পরীক্ষার ফলাফলের তুলনায় প্রকৃত সুরক্ষা হয়তো কিছুটা কম পাওয়া যেতে পারে। এর অন্যতম কারণ, পরীক্ষার সময় এ কর্মসূচিতে দুর্বল রোগ প্রতিরোধক্ষমতার মানুষ যেমন কোনো রোগাক্রান্ত ব্যক্তি, প্রবীণ অথবা গর্ভবতী নারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।
গ্যাভির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, অক্সফোর্ড–অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাটি মানবদেহে পরীক্ষায় প্রায় ৭০ শতাংশ কার্যকর বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপটে এটি আরও বেশি কার্যকর হতে পারে। কারণ, এ টিকা নেওয়ার পর টিকাগ্রহীতা কারও করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার বা মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়নি। আর তা ছাড়া টিকাটি ৭০ শতাংশ কার্যকর মানে এই নয় যে টিকাটি গ্রহণ করলে ৭০ শতাংশ মানুষ সুরক্ষা পাবে, আর ৩০ শতাংশ মানুষ করোনা সংক্রমিত হবেন। এ টিকার পরীক্ষায় অংশ নেওয়া ৫ হাজার ৮০৭ জন স্বেচ্ছাসেবীর মধ্যে মাত্র ৩০ জন টিকা নেওয়ার পর করোনা সংক্রমিত হয়েছিলেন। একই পরীক্ষায় প্লাসিবো (প্রতিক্রিয়াহীন তরল) নেওয়া ৫ হাজার ৮২৯ জনের মধ্যে ১০১ জন করোনা সংক্রমিত হয়েছেন।
করোনাভাইরাসের আগেও টিকার কার্যকারিতা আলোচনায় ছিল। এর মধ্যে কোনো টিকা প্রায় শতভাগ কার্যকর, আবার কোনোটা ৫০ শতাংশের কম কার্যকর। যেমন হাম–রুবেলার টিকা প্রথম ডোজ নিলে ৯৩ শতাংশ ও দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পর ৯৭ শতাংশ কার্যকর বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। পোলিওর টিকাও দুই ডোজে ৯০ শতাংশ এবং তিন ডোজে ৯৯ শতাংশ থেকে শতভাগ কার্যকর। তবে মসকুইরিক্স আরটিএস,এস ম্যালেরিয়া টিকা চার ডোজ নেওয়ার পর ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ সুরক্ষা পাওয়া যায়। এ টিকা কেবল মালাউই, কেনিয়া ও ঘানার সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকায় অনুমোদন পেয়েছে। অন্যান্য অনুমোদনপ্রাপ্ত টিকার তুলনায় এ টিকার সাফল্যের হার মাঝারি। এখনো বিশ্বজুড়ে দিনে প্রায় ১ হাজার ২০০ শিশুর মৃত্যু হয়। সে ক্ষেত্রে এ সাফল্যের হারও অনেক বড় পার্থক্য গড়ে দিতে পারে।
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসগুলো প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে। এ কারণে প্রতিবছর এসব ভাইরাসের টিকা হালনাগাদ করতে হয়। যুক্তরাষ্ট্রের রোগনিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থা (সিডিসি) প্রতিবছরই এসব টিকার সাফল্যের হার নির্ণয় করার চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রে দেশটিতে সংক্রমিত রোগী শনাক্তের সংখ্যা এবং এ রোগে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার হার বিবেচনা করা হয়। সে বিবেচনায় ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকার কার্যকারিতা গত দশকে ৪৫ শতাংশ দেখা গেছে। আর ২০১৪–১৫ মৌসুমে এসব টিকার কার্যকারিতা দেখা গেছে মাত্র ১৯ শতাংশ। এ হার হয়তো অনেক কম। তারপরও টিকাগুলো এসব ভাইরাসের সংক্রমণে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর সংখ্যা বড় সংখ্যায় কমিয়ে আনতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।
বিজ্ঞানীদের প্রাক্কলিত হিসাব বলছে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই প্রতিবছর প্রায় ৭ কোটি ৭০ লাখ মানুষ ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারেন। এর মধ্যে ৪ লাখ ৭০ হাজার মানুষকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হতে পারে। মৃত্যু হতে পারে ১ লাখ ৩০ হাজার মানুষের।
গবেষকেরা হিসাব করে দেখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ৪৩ শতাংশ মানুষও যদি ফ্লুর বিরুদ্ধে ২০ শতাংশ কার্যকর টিকা নেন, তারপরও বছরে ১ লাখ ২৯ হাজার ৭০১ জনের সংক্রমিত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি প্রতিরোধ সম্ভব। আর মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব ৬১ হাজার ৮১২ জনের। এতে যে কেবল ফ্লুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়া যাবে, তাই নয়।
স্থ্যব্যবস্থার ওপরও চাপ কমবে। ফলে অন্য রোগে আক্রান্ত রোগীরাও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ পাবেন।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণে সৃষ্ট কোভিড–১৯ রোগ মৌসুমি ইনফ্লুয়েঞ্জার চেয়েও প্রাণঘাতী। এ ক্ষেত্রেও লক্ষ্য হলো টিকা প্রয়োগের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ এবং মানুষের সুরক্ষা। তবে করোনার টিকা যদি কেবল রোগটিকে সাময়িক সময়ের জন্যও প্রতিরোধ করতে পারে, তাহলেও প্রতিবছর এতে আক্রান্ত হয়ে মানুষের অসুস্থ হওয়া ও মৃত্যু অনেক কমে আসবে।