এত দিন জেনে এসেছি, জেলাপর্যায়ে সরকারি কাজের তদারকি ও সমন্বয় করেন ডেপুটি কমিশনাররা। এই প্রজাতন্ত্রে গণতন্ত্র আছে। তারপরও ডিসি সাহেবরা হলেন ‘জেলা প্রশাসক’। তাঁদের পদবির বাংলা তরজমা কে করেছিলেন জানি না।
এ দেশে জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু আসনে আছেন এমপি সাহেবরা। হেন জায়গা নেই যেখানে তাঁরা নাক গলান না। আইন করেই সব জায়গায় তাঁদের অবাধ প্রবেশের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্কুল-কলেজের গভর্নিং বডি, উপজেলা-জেলা পরিষদের উপদেষ্টা, মসজিদ কমিটি—কোথায় নেই তাঁরা। তাঁরা সবকিছু দেখভাল না করলে গণতন্ত্রের মাজেজা থাকে না।
দেশে উন্নয়ন হচ্ছে প্রচুর। সেখানেও এমপি সাহেবরা মহাসমারোহে হাজির। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে আছে সরকারের নানা প্রতিষ্ঠান। তাদের জন্য আলাদা বরাদ্দ। এমপি সাহেবরা বাদ যাবেন কেন? তাই তঁাদের জন্য তৈরি হলো বিশেষ ব্যবস্থা—থোক বরাদ্দ। এই বরাদ্দের টাকা কোথায় কীভাবে খরচ হবে, তার সিদ্ধান্ত দেবেন তঁারা। নির্বাচনী কনস্টিটিউয়েন্সি ঠিক রাখার জন্য এটা একটা কার্যকর ‘মৃতসঞ্জীবনী সুরা’। শুনতে পাই তাঁদের অনুরোধের ঠেলায় অনেক জেলা প্রশাসক বা প্রতিষ্ঠানের ডিজির আরাম হারাম হয়ে যাচ্ছে।
করোনাকাণ্ডে দেশ এখন জেরবার। মাস পেরিয়ে গেছে। সব জায়গা থেকে অনিয়ম আর সমন্বয়হীনতার খবর আসছে। প্রধানমন্ত্রীর টেলিকনফারেন্সে মন্ত্রী, সাংসদ, জেলা প্রশাসক সবাইকে বলতে শুনি—সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় পান থেকে চুন খসার সুযোগ নেই, সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। কিন্তু আড়ালে-আবডালে শোনা যায় ভিন্ন কথা। কোনো কিছুই ঠিক চলছে না। বিদূষকদের কথায় মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না। ফেসবুকে অনেক কথা বেরিয়ে আসে। বিদূষকেরা এসব কথা গুজব বলে ঢোল পেটালেও সব যে গুজব নয়, সত্যও আছে কিছু কিছু, তা শেষ পর্যন্ত ঢেকে রাখা যায় না।
একটা কথা না বলে পারছি না। নারায়ণগঞ্জ এখন সম্পূর্ণ লকডাউনে। এটা করোনার একটা বড় হটস্পট। লকডাউন ঘোষণার কয়েক দিন আগে থেকেই নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র কারফিউ জারির জন্য সরকারকে বারবার অনুরোধ করেছিলেন। সরকার কানে নেয়নি, কয়েক দিনের ব্যবধানে পরিস্থিতি চলে গেছে নিয়ন্ত্রণের বাইরে। এ দায় কার?
জিয়াউর রহমানের জমানায় দেখেছি একজন মন্ত্রী বা সাংসদ একটি জেলার দায়িত্বে থাকতেন। এটা নিয়ে অনেকেই মশকরা করতেন। স্থানীয় প্রশাসনকে চাপে রাখতে কিংবা তার ওপর আস্থা হারালেই এ রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তো সেই ধারাবাহিকতা পরে সংক্রমিত হয়েছে। জিয়ার পথ ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা নানা জেলার দায়িত্ব পান। বলা হয় ‘সাংগঠনিক দায়িত্ব’। জিয়াবিরোধী দলও এই ব্যবস্থা মেনে নিয়েছে।
এখন অবস্থা অন্য রকম। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মতো। শত্রু কে তা জানি, কিন্তু তাকে দেখা যাচ্ছে না। শত্রুকে এখন আক্রমণের সুযোগ নেই। আক্রমণের জন্য যে প্রতিরোধব্যবস্থা তৈরি করা দরকার, অর্থাৎ প্রতিষেধক তৈরি—তা হবে বিদেশের গবেষণাগারে। বাজারে এলে আমরা তা আমদানি করব। এখন শুধু আত্মরক্ষার পালা। আত্মরক্ষার কৌশল নির্ধারণ নিয়ে আমরা গলদঘর্ম হচ্ছি।
কোটি টাকার প্রশ্ন হলো এমপি সাহেবরা সব জায়গায় ঢুঁ মারার জন্য যে খ্যাতি অর্জন করেছেন, আজ তঁারা কোথায়? দু-একটি জায়গায় দেখা যাচ্ছে তাঁরা ত্রাণ বিতরণ করছেন। সে ছবি নানা মাধ্যমে আসছে। ত্রাণ বিতরণের চেয়েও বড় হচ্ছে তার প্রচার। মুখে একটা মাস্ক পরে তঁারা পোজ দিচ্ছেন, দাতা হাতেম তাইকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।
এর মধ্যে ঘটে গেল অ্যান্টি-ক্লাইমেক্স। প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি জেলার জন্য একজন সচিবকে দায়িত্ব দিয়েছেন। মন্ত্রী-এমপি থাকতে সচিব কেন?
ইতিমধ্যে ‘চালচোর’ শব্দটি আমাদের শব্দভান্ডারে ঢুকে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের পরের কয়েকটি বছর ছিল অন্য রকম। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। চারদিকে অনটন। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। চারদিকে চলছে রিলিফ অপারেশন। টিসিবি, রেশন দোকান, রিলিফ কমিটি, লঙ্গরখানা—কোনো কিছু দিয়েই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। ওই সময় এসব নিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে, নানা স্লোগান শোনা গেছে। এখন লকডাউনের কারণে সভা-সমাবেশ বন্ধ। তাই স্লোগান নেই। কিন্তু অভিযোগের অন্ত নেই। প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত গতানুগতিক সিস্টেমের ওপর ভরসা রাখতে পারছেন না। ত্রাণ নিয়ে দুর্নীতি হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি। তারপরও তিনি কোনো মন্ত্রী বা এমপিকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো জেলার দায়িত্ব দেননি। দায়িত্ব দিয়েছেন সচিবদের।
সচিবেরা কী করবেন জানি না। ধারণা করা যায়, জেলা প্রশাসনে বা তারও নিচু স্তরে যাঁরা কাজ করেন, একজন সচিবের পক্ষে তাঁদের জবাবদিহি আদায় করা এবং তঁাদের দিয়ে কাজ করানো সহজ এবং সম্ভব। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক মই বেয়ে ওঠানামা করার চেয়ে প্রশাসনিক সিঁড়ি দিয়ে চলাফেরা করা হবে বেশি কার্যকর।
প্রধানমন্ত্রী কী ভেবে তাঁর দলের এমপিদের বদলে আমলাদের ওপর আস্থা রাখলেন, এটা ভেবে দেখার বিষয়। সততা, দক্ষতা, দ্রুততার সঙ্গে কাজ করা, জবাবদিহি—সবকিছুই হয়তো বিবেচনায় এসেছে। হয়তো এটি একটি আপৎকালীন ব্যবস্থা। কিন্তু আপৎকালে মহান জাতীয় সংসদের মাননীয় সদস্যরা কোথায়? তাঁরা কি বেমালুম গায়েব হয়ে গেলেন?
পরিস্থিতি বোঝার জন্য আমরা ফিরে যেতে পারি ৪৫ বছর আগে। কী ছিল তখনকার অবস্থা? ১৯ জুন ১৯৭৫ ঢাকায় বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম সভায় চেয়ারম্যান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যায়:
‘আমি সার দিতে পারি নাই। যা সার দিয়েছি তার থার্টি পারসেন্ট চুরি হয়ে গেছে। স্বীকার করেন? আমি স্বীকার করি। আমি মিথ্যা কথা বলতে পারব না। মিথ্যা বলে একদিনও হারাম এ দেশের প্রেসিডেন্ট থাকব না। আমার যে সার আমি দিয়েছি তার কমপক্ষে থার্টি পারসেন্ট ব্ল্যাক মার্কেটিংয়ে চুরি হয়ে গেছে। আমি যে ফুড দেই তার কুড়ি পারসেন্ট চুরি হয়ে যায়। আমি যে মাল পাঠাই গ্রামে গ্রামে তার ২০-২৫ পারসেন্ট চুরি হয়ে যায়। সব চুরি হয়ে যায়। হুইট—আমি তো হুইট পয়দা করি না, খুব কমই করি। কোন বাজারে হুইট পাওয়া যায় না? গভর্নমেন্ট গোডাউনের হুইট। সার তো আমি ওপেন মার্কেটে বিক্রি করি না। কোন বাজারে সার পাওয়া যায় না? লেট আস ডিসকাস দিস ম্যাটার। দেয়ার শ্যাল বি ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার ডিসকাশন।...এই যে পলিটিক্যাল পার্টি—একটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট জিনিস। এর মেম্বারশিপ ইচ্ছা করলেই পাওয়া যায় না। মেম্বার বেছে বেছে নিতে হবে। গলায় সাইনবোর্ড লাগিয়ে আমি মেম্বার, আমাকে একটা পারমিট দাও, সেটি হবে না।...’
সাড়ে চার দশক পেরিয়ে গেছে। আমরা কি বদলেছি? দলবাজি করে দেশটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছি। সমাজের ক্ষতগুলো এখন আর ঢেকে রাখা যাচ্ছে না। ষড়যন্ত্রতত্ত্ব দিয়ে কাজ হচ্ছে না। দেশটা যঁারা চালান, ভালো কাজের স্বীকৃতি তাঁদের দেওয়া দরকার। মন্দ কাজের দায়ও তঁাদের নিতে হবে। দেখা যাক সচিব মহোদয়রা আমাদের মুশকিল আসান করতে পারেন কি না। ‘পচা আমলাতন্ত্র’ দিয়ে কিসসু হবে না—এ কথা আগাম বলতে চাই না।
তবে একই সঙ্গে এই প্রশ্ন আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের জনপ্রতিনিধিরা কোথায়? এমপি সাহেবরা কোথায়? বিপদের দিনে তাঁরা সবাই কি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছেন? অন্য বেলায় তঁারা ছিলেন দোর্দণ্ড প্রতাপে। অবেলায় তাঁদের চাঁদমুখ কেন দেখতে পাই না?
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক