এক বছরেও করোনা পরীক্ষাকেন্দ্র হয়নি ৩৬ জেলায়

করোনাভাইরাসের নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে।
ফাইল ছবি

দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের শুরুর দিকে শনাক্তকরণ পরীক্ষার সংখ্যা ছিল কম। গত বছরের মে মাসে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে গড়ে ৮০ জনের পরীক্ষা হয়েছিল। এখন প্রতি ১০ লাখে ২৫ হাজার ৫২১ জনের করোনা পরীক্ষা হচ্ছে। পাঁচ লাখের বেশি রোগী শনাক্ত হওয়া ৩৫টি দেশের মধ্যে যা সর্বনিম্ন।

পরিসংখ্যান নিয়ে কাজ করা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারস শুরু থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলের করোনাবিষয়ক হালনাগাদ তথ্য দিয়ে আসছে। ওয়ার্ল্ডোমিটারসের পরিসংখ্যানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

৮ মার্চ দেশে করোনা সংক্রমণ শনাক্তের এক বছর হয়েছে। এক বছর পার হলেও ৩৬টি জেলায় নমুনা পরীক্ষাকেন্দ্র (ল্যাব) চালু করতে পারেনি সরকার। সরকারের পরামর্শক কমিটি নয় মাস আগে করোনার অ্যান্টিবডি টেস্ট চালুর সুপারিশ করলেও এখনো তা শুরু হয়নি। গত ডিসেম্বর থেকে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরু হলেও তা একেবারেই কম। দিনে গড়ে ১০০টির মতো অ্যান্টিজেন পরীক্ষা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

দেশে করোনার অ্যান্টিবডি পরীক্ষা এখনো চালু না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। উপসর্গ থাকার পরেও অনেকে পরীক্ষা করাচ্ছেন না বলে অ্যান্টিজেন পরীক্ষার সংখ্যা কম বলে তাঁদের ধারণা। দিনে ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন তাঁরা। কিন্তু এখনো এক দিনে সর্বোচ্চ ১৯ হাজার নমুনা পরীক্ষা হয়েছে।

করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা।

করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম বলেন, সরকারের করোনাবিষয়ক কার্যক্রমে স্থবিরতা ও ঢিলেঢালাভাব চলে এসেছে। অনেক আগেই অ্যান্টিবডি পরীক্ষা চালু করা দরকার ছিল। সব জেলায় আরটিপিসিআর ল্যাব করার ক্ষেত্রেও খুব বেশি অগ্রগতি হয়নি। সরকারি পর্যায়ে হলেও খুব দ্রুত অ্যান্টিবডি পরীক্ষা চালু করা দরকার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এখন দেশে ২১৯টি পরীক্ষাকেন্দ্রে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা হচ্ছে। এর মধ্যে ১১৮টি কেন্দ্রে আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে পরীক্ষা হচ্ছে। আর যক্ষ্মা শনাক্তে ব্যবহৃত কার্টিজ বেজড নিউক্লিক অ্যাসিড অ্যামপ্লিফিকেশন টেস্ট (সিবি ন্যাট) বা জিন এক্সপার্ট পদ্ধতিতে পরীক্ষা করা হচ্ছে ২৯টি কেন্দ্রে। ৭২টি স্থানে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করা হচ্ছে।

পরীক্ষার তলানিতেই বাংলাদেশ

ওয়ার্ল্ডোমিটারসের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে এখন প্রতি ১০ লাখে ২৫ হাজার ৫২১ জনের করোনা পরীক্ষা হচ্ছে। গত বছরের মে মাসে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে গড়ে ৮০ জনের পরীক্ষা হয়েছিল। বাংলাদেশসহ ৩৫টি দেশে পাঁচ লক্ষাধিক কোভিড-১৯ শনাক্ত রোগী রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে কম পরীক্ষা হচ্ছে বাংলাদেশে। দ্বিতীয় সর্বনিম্ন পরীক্ষা হচ্ছে ইন্দোনেশিয়াতে। দেশটিতে প্রতি ১০ লাখে ৪১ হাজার ৭৪৬ জনের করোনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে কম পরীক্ষা হচ্ছে শুধু আফগানিস্তানে।

আরটি-পিসিআর ল্যাব নেই ৩৬ জেলায়

দেশের ১১৮টি আরটি-পিসিআর পরীক্ষাকেন্দ্রের মধ্যে ঢাকায় ৭১টি। আর ঢাকার বাইরে ২৭টি জেলায় আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। আরটি-পিসিআর কেন্দ্রের ৫১টি সরকারি ব্যবস্থাপনায় আর ৬৭টি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়।

ঢাকা বিভাগের ১৩টি জেলার মধ্যে পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে ৮টি জেলায়। খুলনা বিভাগের ১০ জেলার মধ্যে ৩টিতে পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। সিলেট বিভাগের ৩টি পরীক্ষাকেন্দ্রই সিলেট জেলায় অবস্থিত। রংপুর বিভাগের ৮ জেলার মধ্যে রংপুর ও দিনাজপুরে পরীক্ষাকেন্দ্র আছে। বরিশাল বিভাগের ৬ জেলার মধ্যে বরিশাল ও ভোলায় পরীক্ষাকেন্দ্র রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

করোনাভাইরাস

গত বছরের ১৮ জুন করোনাবিষয়ক নিয়মিত বুলেটিনে জানানো হয়েছিল, যত দ্রুত সম্ভব সরকারি ব্যবস্থাপনায় জেলা পর্যায়ে আরটি-পিসিআর পরীক্ষা শুরু হবে। সেদিন দেশের ৪৩ জেলায় করোনা পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল না। এরপর সাড়ে আট মাস পার হলেও নতুন করে মাত্র সাত জেলায় পরীক্ষাকেন্দ্র চালু হয়েছে।

পরীক্ষাকেন্দ্র নেই—এমন তিনটি জেলার সিভিল সার্জনের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। নাম না প্রকাশের শর্তে তাঁরা বলেন, জেলার নমুনা পরীক্ষা করতে আশপাশের জেলায় বা ঢাকায় নমুনা পাঠানো হচ্ছে। এতে পরীক্ষার ফলাফল পেতে সময় বেশি লাগছে। জেলায় আরটি-পিসিআর পরীক্ষাকেন্দ্র চালুর বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে কয়েকবার আলোচনা হলেও তাতে কোনো অগ্রগতি হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনাবিষয়ক মুখপাত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক ও করোনাবিষয়ক মুখপাত্র অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলামের মুঠোফোনে কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তবে তাঁকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

চালু হয়নি অ্যান্টিবডি পরীক্ষা

গত বছরের ৩ জুন করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি করোনার অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন পরীক্ষা চালুর সুপারিশ করে। একই সুপারিশ করে নমুনা পরীক্ষা সম্প্রসারণ নীতিমালার ওপর মতামত দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়–গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটি। তারা বলেছিল, দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি বুঝতে অ্যান্টিজেন ও অ্যান্টিবডি পরীক্ষা একসঙ্গে শুরু করা জরুরি।

কারও শরীরে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি রয়েছে কি না, সেটি অ্যান্টিজেন পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়। আর করোনা থেকে যাঁরা সুস্থ হয়েছেন, তাঁদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে কি না, তা অ্যান্টিবডি পরীক্ষার মাধ্যমে জানা যায়। গত বছরের ৫ ডিসেম্বর দেশে করোনার অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এখনো অ্যান্টিবডি পরীক্ষা শুরু হয়নি।

অ্যান্টিজেন পরীক্ষার সংখ্যা কম

গত ৫ ডিসেম্বর দেশের ১০ জেলায় করোনার অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরু হয়। এরপর কয়েক ধাপে আরও জেলা ও উপজেলায় অ্যান্টিজেন পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এখন দেশের ৭২টি স্থানে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা চালু আছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, গতকাল শনিবার পর্যন্ত দেশে মোট ১১ হাজার ২৫৯টি অ্যান্টিজেন পরীক্ষা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সব কেন্দ্র মিলিয়ে দেশে দৈনিক গড়ে ১০০টির মতো অ্যান্টিজেন পরীক্ষা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, যেসব রোগীর জ্বর, সর্দি, কাশি ও গলাব্যথার মতো উপসর্গ রয়েছে, শুধু তাঁদেরই অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করা হয়। ফলে, অ্যান্টিজেন পরীক্ষার সংখ্যা খুব বেশি বাড়ছে না। লোকজনের করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা নিয়ে উদাসীনতাও রয়েছে।

২০ হাজার পরীক্ষা হয়নি এক দিনও

জনস্বাস্থ্যবিদেরা শুরু থেকেই বলছিলেন, দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি বুঝতে হলে দৈনিক অন্তত ২০ হাজার পরীক্ষা করা দরকার। পরীক্ষা যত বেশি হবে, আক্রান্ত ব্যক্তিও তত বেশি শনাক্ত হবে। রোগী শনাক্ত হলে এবং এরপরের ধাপগুলো ট্রেসিং (আক্রান্তের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা), কোয়ারেন্টিন (সঙ্গনিরোধ) ও আইসোলেশন (বিচ্ছিন্ন থাকা) যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব।

দেশে এখন পর্যন্ত এক দিনে সর্বোচ্চ ১৯ হাজার ৫৪টি পরীক্ষা হয়েছে গত ১৫ ডিসেম্বর। গত বছরের জুন মাসে দৈনিক ১৫ থেকে ১৮ হাজার পরীক্ষা হয়েছে। আর জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে পরীক্ষার সংখ্যা কমে আসে। এখন দৈনিক ১২ থেকে ১৫ হাজারের মধ্যে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে।

১৬ শতাংশের বেশি নমুনাই বিদেশগামীদের

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা যায়, দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের মোট পরীক্ষার ১৬ দশমিক ১১ শতাংশই হয়েছে বিদেশগামী যাত্রীদের। বর্তমানে দৈনিক যে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে, তার বড় অংশই বিদেশগামীদের। গতকাল শনিবার পর্যন্ত দেশে নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৪২ লাখ ৪৮ হাজার ৩৪৫টি। এর মধ্যে ৬ লাখ ৮৪ হাজার ৫৮৫টি নমুনাই বিদেশগামীদের। বিদেশগামী যাত্রীরা মূলত সংক্রমিত নন, সেটি জানতেই পরীক্ষা করান। তাঁদের মধ্যে সংক্রমণের হার একেবারেই কম। তাঁদের হিসাব এবং সন্দেহভাজন রোগীদের হিসাব একত্রে দেখানো হয়।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, সংক্রমণের প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝতে শুরু থেকেই পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে তাগাদা দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু যতটুকু পরীক্ষা বাড়ানো দরকার ছিল, ততটা করা যায়নি। স্বাস্থ্য বিভাগের কার্যক্রমে শৈথিল্য ভাব দেখা যাচ্ছে। আরও আগেই সব জেলায় আরটি-পিসিআর পরীক্ষার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন ছিল।