সকাল সকাল বাজারে যাব, কাজের লোক (ছুটা বুয়া) এসে জানালেন, কাছেই এক বাসায় কেউ মারা গেছেন। রোদেলা সকালে এমন সংবাদের মতো অপ্রিয় আর কিছু হতে পারে না; চারদিকে যখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস।
বেরিয়ে দেখি, কাছেই একটা বাসায় কিছু লোক ভিড় করেছে গেটে। একটা অ্যাম্বুলেন্স গেটের ভেতর অর্ধেক ঢোকানো। পরিচিত দারোয়ানকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই তিনি জানালেন, এক মুরব্বি মারা গেছেন। অনেক বয়স। দীর্ঘদিন ধরে রোগে ভুগছিলেন। শেষে বললেন, ‘এইটা নরমাল মৃত্যু, স্যার। চিন্তার কিছু নাই।’
তাঁর কথায় শ্লেষের যে গুঁতো, এতে আমাদের মানসিকতার আকস্মিক পরিবর্তনের আভাস স্পষ্ট। এর মধ্যে নিশ্চয়ই আশপাশের অনেকে এই মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন করেছে। যার ফলে দারোয়ানের এ উত্তর।
করোনাভাইরাস নিয়ে আসলে পরিস্থিতি যা দাঁড়িয়েছে, এতে স্বাভাবিক মৃত্যু নিয়েও স্থানীয় লোকজনের সন্দেহ হচ্ছে। কারণ করোনাভাইরাস ধরা পড়ার পর বেশ কয়েকজন হাসপাতাল থেকে পালিয়েছেন। সামাজিকভাবে নিগৃহীত ও একঘরে হওয়ার ভয়ে অনেক পরিবার আক্রান্ত ব্যক্তির তথ্য গোপন করে ধরা পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক মৃত্যু নিয়েও সন্দেহ হচ্ছে, আসলে করোনা কেস নয় তো?
সুদূর চীনের প্রত্যন্ত এলাকা উহান থেকে আসা করোনাভাইরাস এখন মূর্তিমান অদৃশ্য ঘাতক। অচিন-অজানা কিছুর সর্বনেশে কাণ্ড জনমনে আতঙ্ক ছড়ায়। এই ভাইরাসে এবং এর মাধ্যমে সৃষ্ট কোভিড-১৯ রোগ সম্পর্কে বেশির ভাগ লোকের ধারণা অস্পষ্ট। রোগটি কেমন ভোগায়, কত কষ্ট দেয়, তা কেবল আঁচ করা যাচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শী কজন? শুধু জানা যাচ্ছে, ভয়ানক শ্বাসকষ্টে মাধ্যমে করুণ মৃত্যু ঘটে, যে মৃত্যুতে আপনজনেরা থাকে অনেক দূরে। বাস্তবতার প্রয়োজনেই দাফন বা শেষকৃত্য হয় অন্য রকম, যা কখনো কারও কাম্য নয়।
এসব কারণে দেশজুড়ে এটা আতঙ্ক ছড়িয়েছে। এখন কারও সাধারণ সর্দি-কাশি বা জ্বর হলেই ‘করোনা-আতঙ্কে’ হাত-পা অসাড় হয়ে আসে। অস্থির হয়ে পড়েন পরিবারের সদস্যরা।
আতঙ্কিত হওয়ার কারণও আছে ষোলো আনা। চীনের প্রাচীর টপকে করোনা যখন একে একে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়াতে থাকে, ঘটাতে থাকে মৃত্যু, তখন থেকেই একটা ভয় ছিল যে এটা এ দেশেও আসবে। কারণ, চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্যিক ঘনিষ্ঠতা যথেষ্ট। কিন্তু সেই আশঙ্কা অনুপাতে প্রস্তুতিতে ব্যাপক ঘাটতি ছিল, যার ধাক্কা সবে লাগতে শুরু করেছে।
তবে চীন থেকে সরাসরি না এলেও বিদেশফেরত প্রবাসী, বিশেষ করে ইতালি থেকে আসা লোকজনের মাধ্যমে এ ভাইরাস অন্যদের সংক্রমিত করেছে। এভাবে প্রতিরোধের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সবার অলক্ষ্যে দেশে ঢুকে পড়েছে করোনা। চলছে কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, রোগ শনাক্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া। এক মাদারীপুরের শিবচরেই ৭৮ হাজার মানুষ এখন কঠোর নজরদারিতে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ছাড়া ছাড়া কোয়ারেন্টিন আর আইসোলেশনের ঘটনা ক্রমেই বাড়ছে। সরকারি তথ্যে প্রতিদিনই দু-তিনজন করে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য বাড়ছে। মারা গেছে দুজন।
ঢাকার মিরপুরে করোনায় মৃত ব্যক্তির ছেলে ফেসবুকে যা লিখেছেন, তা তো ভয়াবহ। বাস্তবে চিকিৎসকেরাই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তির চিকিৎসাসেবা দিতে ভয় পাচ্ছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের পালাই পালাই ভাব। কারণও আছে। চিকিৎসক বা হাসপাতালে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে কে করবে চিকিৎসা?
আতঙ্ক ছড়িয়েছে সারা বিশ্বে। এক ইতালিতেই মৃত্যুপরোয়ানা নিয়ে উন্মাদের মতো ছুটছে করোনা। উৎপত্তিস্থল চীনকে ছাড়িয়ে এখন সেখানে মৃত মানুষের সংখ্যা পাঁচ হাজার ছুঁই ছুঁই। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত লমবারদিতে এক শনিবারেই ৮০০ লোক মারা গেছে। গতকাল রোববারও অনেক মারা গেছে। সেখানে মৃত মানুষের সংখ্যা তিন হাজার ছাড়িয়েছে। সারা ইতালিতে আক্রান্ত ৫০ হাজারের বেশি মানুষ। অবশ্য ছয় হাজার লোক কোভিড-১৯ রোগ থেকে সেরে উঠেছে।
করোনাভাইরাসে সারা বিশ্বে এ পর্যন্ত ১৭৩ দেশের ৩ লাখ ৩৬ হাজারের বেশির লোক আক্রান্ত হয়েছে। মারা গেছে সাড়ে ১৪ হাজারের বেশি লোক। এ ভাইরাসের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি প্রাকৃতিক এবং একেবারেই নতুন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানবদেহে ঢুকলে জীবাণুরোধী ব্যবস্থা এটার মতিগতি বুঝতে পারে না। তাই অ্যান্টিবডি থাকে নিষ্ক্রিয়। এই সুযোগে সর্বনাশের যা করার করে দেয় ভাইরাসটির রোগ কোভিড-১৯।
এ জন্য করোনা মানেই ‘কোরো না’। এটা কোরো না, সেটা কোরো না। সবকিছুতে ‘না’ লেবেল এঁটেছে। কাউকে ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, থাকতে হবে কমপক্ষে ফুট তিনেক দূরে। বাইরে যেতে মানা, ভিড়ে যেতে মানা, স্কুলে যেতে মানা, মার্কেটে যেতে মানা, হোটেল-রেস্তোরাঁয় খেতে মানা। খোলা মুখে হাঁচি দিতে মানা, অতিথিকে দেখা দিতে মানা, আগন্তুককে বাড়িতে ঢুকতে দিতে মানা। হাত ভালো করে না ধুয়ে, স্যানিটাইজার না মেখে দৈনন্দিন কাজ করতে মানা। এভাবে না-না-না...কানের কাছে যেন বিপৎসংকেতের অদৃশ্য একটা সাইরেন বাজিয়েই চলেছে।
এ সাইরেনে বদলে গেছে চিরচেনা দুনিয়া। ইতালি তো বটেই, জার্মানি, স্পেন, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকার মতো উন্নত দেশগুলোয় কেবলই শোনা যাচ্ছে ‘শাটডাউন’ আর ‘লকডাউনের’ কথা। খাবারের দোকানগুলোয় পড়ে গেছে কিউ। আমেরিকায় আবার অস্ত্র কেনার জন্য লাইন ধরেছে লোকজন। সে রকম অরাজক পরিস্থিতি হলে আত্মরক্ষায় কাজ দেবে আগ্নেয়াস্ত্র। করোনা-আতঙ্কে ভুগে অনেকের স্বাভাবিক জ্ঞান লোপ পেয়েছে। মৃত্যুই যখন পরিণতি, অর্থকড়ি দিয়ে আর কী হবে? চীনে ছুড়ে ফেলছে টাকাপয়সা। অনেকে অস্থাবর সম্পদ নগদে দিয়ে যাচ্ছেন আপনজনকে। বলে দিচ্ছেন এটিএমের নম্বর।
ভারতে হয়ে গেল ১৪ ঘণ্টার করোনা কারফিউ, যা জীবনে কোনো দিন শোনা যায়নি। রাস্তাঘাট সেখানে ধু ধু মরুভূমি। এর আগে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে শাটার নেমেছে। হাতের স্পর্শ এড়াতে সেখানে কিছু বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে কিছুদিন আগে থেকেই দেওয়া-থোয়ার বিষয়ে রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে। বিনোদন ও অবকাশকেন্দ্রে যেন মাছিও নেই। আগ্রার তাজমহল বা অন্য কোনো প্রসিদ্ধ স্থানে জনসমাগম নিষিদ্ধ।
বিশ্বের প্রসিদ্ধ স্থানগুলোর মধ্যে প্যারিস আইফেল টাওয়ার এখন একেবারেই জনশূন্য। মায়ামি বিচে খালি পড়ে আছে বিচ চেয়ার। ভেনিসের খালগুলোয় নানা নৌযানের বিচরণ বন্ধ বলে সেখানকার পানি এখন কাচের মতো স্বচ্ছ। দেখা যাচ্ছে মাছের বিচরণ। সবখানেই কেবল প্রাণ বাঁচানোর তাড়া।
এ কয় দিন করোনার কারণে বদলে গেছে আমাদের জীবনও। ঢাকা এখন যানজট কমে যাওয়া আদর্শ শহর। লোকজনের ভিড়ভাট্টা একেবারেই নেই। বাসে ওঠা নিয়ে হুড়োহুড়ি নেই। স্টিয়ারিং হাতে চালকের ‘রাস্তার রাজা’ সাজার ঠাট কমেছে। চালকের সহকারীর হেঁড়ে গলা খাদে নেমেছে। অপ্রীতিকর ঘটনাও কমেছে। পোশাক, প্রসাধন, খাবারের দোকানে ভিড় কমে গেছে।
রিকশাচালকের সেই তেজ নেই। একজনকে ডাকলে তিনজন আসে। আগে যেখানে ছিল ৬০ টাকার ভাড়া, সেখানে এখন খেপ হারানোর ভয়ে ভাড়া ৪০ টাকায় নেমেছে। স্কুটারচালকদের বসে মাছি তাড়ানোর অবস্থা। অভিজাত বেশ কিছু হোটেল ফাঁকা। কক্সবাজার, কুয়াকাটা, সেন্ট মার্টিনসহ পর্যটনের স্থানগুলো জনশূন্য। বিনোদনকেন্দ্রের ব্যবসা লাটে উঠেছে।
বাজারটা অবশ্য টালমাটাল। পাছে টানা কিছুদিনের জন্য ঢাকা লকডাউনের খপ্পরে পড়ে যায়—এই আশঙ্কায় কয়েক দিন ধরে চলছে নিত্যপণ্যের কেনাকাটার ধুম। ফায়দা লুটতে কিছু ব্যবসায়ী জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়েছেন। আবার সাম্প্রতিক র্যাবের অভিযানে কিছু ব্যবসায়ী খেয়ে গেছেন ধরা।
সাধারণ মানুষের আয়েশ-বিলাস-বিনোদন শিকেয় উঠেছে। নগরের শিক্ষার্থীরা কাটাচ্ছে অবরুদ্ধ জীবন। ছোটরা বার্গার বা চিপসের চেয়ে এখন ছোট একটা স্যানিটাইজারের শিশি পেলে অনেক খুশি, যা পাওয়া খুবই দুর্লভ। অতিথিরা এখন অভাজন। দর্শনার্থীদের জন্য দুয়ার বন্ধ। অচিন করোনা নিয়ে এসেছে অন্য রকম এক অচেনা জীবন। কিন্তু এভাবে আর কত দিন?
ইংল্যান্ড-আমেরিকাসহ উন্নত বিশ্বের শীর্ষ সারির দেশগুলো পর্যন্ত করোনার ক্রান্তিকাল কাটাতে হিমশিম খাচ্ছে। লকডাউন ও সেনা মোতায়েন করেও কিনারা করতে পারছে না। সেখানে আমাদের দেশে করোনা কেবল ঢুকেছে। এখানে আমাদের ভবিষ্যৎ কী?
সেটা আঁচ করতে ভয় হয়। তবে বিবিসিতে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন আশা প্রকাশ করেছেন যে পরবর্তী ১২ সপ্তাহের মধ্যে তাঁরা করোনার জোয়ার আটকাতে পারবেন। সেও তো তিন মাস। তবে এর শেষ দেখতে আরও অনেক দিন অপেক্ষা করতে হবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
তবে এটাও ঠিক যে কেবল আশঙ্কা আর অনুমান দিয়ে ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করা যায় না। করোনা এশিয়ায় যেভাবে ছড়াবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল, বাস্তবে তা হয়নি।
দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশ দ্রুতই পরিস্থিতি সামলে নিয়েছে। চীনের প্রতিবেশী তাইওয়ানে যেভাবে করোনা হানা দেবে বলে ভাবা হয়েছিল, সেটাও হয়নি। ব্যাপক সচেতনতা আর কার্যকর পদক্ষেপের মাধ্যমে তারা করোনার লাগাম টানতে সক্ষম হয়েছে তারা। আক্রান্ত হয়েছে মাত্র ৪৯ জন। মারা গেছে একজন।
কাজেই আমাদের ভয় পেলে চলবে না। অতীতে এ দেশের অসীম সাহস আর সম্মিলিত প্রচেষ্টা অনেক মহামারি ও যুদ্ধ জয় করেছে। কিছুদিন আগে ডেঙ্গু নিয়ে আমরা কী ধকলটাই না পোহালাম! সবাই মিলেই ডেঙ্গুকে তাড়াতে পেরেছি। হ্যাঁ, অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু আমাদের অনেক স্বজনকে কেড়ে নিয়েছে বটে, তবে অন্তত এক মৌসুমের জন্য হলেও ডেঙ্গুকে হারাতে পেরেছি। করোনার বিরুদ্ধে একই কায়দায় লড়ে আমরা যথাসময়ে জয়ী হব। সরকার, প্রশাসন, জনতা যদি এক হয়ে করোনার বিরুদ্ধে নামি, জয়ী আমরা হবই।
লেখক: প্রথম আলোর সহকারী বার্তা সম্পাদক ও সাহিত্যিক
shariful.bhuiyan@prothomalo.com