উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর পর কারও করোনা শনাক্ত হলে তা সরকারি হিসাবে দেখানো হয় কি না, সেটি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।
জ্বর ও শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দেওয়ায় ষাটোর্ধ্ব জবেদ আলী মোড়লকে ৮ জুলাই রাতে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান স্বজনেরা। সেখানেই ১২ জুলাই তাঁর মৃত্যু হয়। হাসপাতালে মোট চার দিন ছিলেন তিনি। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে তাঁর করোনার পরীক্ষা করা হয়নি।
জবেদ আলীর মৃত্যুর দুদিন পর করোনার উপসর্গ নিয়ে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার মৌতলা গ্রামের মহিউদ্দিন (৬৫)। তিনি মারা যান ১৫ জুলাই সন্ধ্যায়। তাঁর ছেলে মনিরুল ইসলাম বলেন, বাবার করোনা পরীক্ষা হয়নি।
করোনার উপসর্গ নিয়ে জবেদ আলী ও মহিউদ্দিনের মতো সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গত সাত দিনে মারা গেছেন ৪৫ জন। এই হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ মানস মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, অনেক ক্ষেত্রে রোগীর বুকের সিটি স্ক্যান করে দেখা যায়, ৩০ শতাংশ ফুসফুস আক্রান্ত। ফুসফুস আক্রান্ত হলে অনেক সময় করোনা পরীক্ষা করা হয় না।
উপসর্গ আছে, কিন্তু পরীক্ষা হয়নি—এমন কোনো রোগী মারা যাওয়ার পর করোনায় মৃতদের সরকারি তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত হয় কি না, জানতে চাইলে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ মানস মণ্ডল বলেন, যাঁদের উপসর্গ রয়েছে, তাঁদের করোনা চিকিৎসা দেওয়া হয়ে থাকে। চিকিৎসা পাওয়াই মূল কথা।
করোনাভাইরাসের (কোভিড–১৯) সংক্রমণ শনাক্ত হওয়া রোগীদের পাশাপাশি দেশে দুই সপ্তাহ ধরে উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু বাড়ছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, করোনা সন্দেহভাজন ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার ফলাফল আসার আগেই মৃত্যু হচ্ছে।
আবার উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসার পর মৃত্যু হলেও কিছু ক্ষেত্রে ওই রোগীর নমুনা সংগ্রহ না করার অভিযোগও পাওয়া গেছে। বিশেষ করে যেসব রোগী হাসপাতালে আসার ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মারা যাচ্ছেন, তাঁদের নমুনা নেওয়া হয় না বলে স্বজনেরা অভিযোগ করেছেন। উপসর্গ নিয়ে মৃত্যুর পর কারও করোনা শনাক্ত হলে তা সরকারি হিসাবে দেখানো হয় কি না, সেটি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।
* দেশে গত বছরের মার্চে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর এ পর্যন্ত উপসর্গে মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ৯৩৯ জনের। * গত ২৩ জুন থেকে ৬ জুলাই পর্যন্ত দেশে করোনার উপসর্গে ৪৮৬ জনের মৃত্যু। এর মধ্যে খুলনা বিভাগেই মারা গেছেন ২১৬ জন।
ফরিদপুরে করোনা চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০ থেকে ১৬ জুলাই (গতকাল) পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হয়ে মারা গেছেন ৩৪ জন। এ সময় করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ৪০ জন। এই হাসপাতালে করোনা উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়ার পর মারা যান মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার টেকেরহাট এলাকার দুলাল সাহা (৬০)। তাঁর মেয়ে মিতা সাহা জানান, বাবার জ্বর হয়েছিল। হাসপাতাল থেকে বাবার নমুনা পরীক্ষার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
রোগীর স্বজনদের অভিযোগের বিষয়ে ফরিদপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মো. সাইফুর রহমান বলেন, করোনা সন্দেহে কেউ ভর্তি হলেই তাঁর নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করার জন্য সংশ্লিষ্টদের বলে রাখা হয়েছে। তবে এটি কতটা পালন করা হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা হয়নি।
জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনডিপির আর্থিক সহায়তায় করোনার উপসর্গে মৃত্যু নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরি (বিপিও)। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের (সিজিএস) একটি প্রকল্প। বিপিও বলছে, গত ২৩ জুন থেকে ৬ জুলাই পর্যন্ত দুই সপ্তাহে সারা দেশে করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ৪৮৬ জন। এর মধ্যে খুলনা বিভাগেই এমন মৃত্যুর ঘটনা ২১৬টি। খুলনা বিভাগের মধ্যে শুধু সাতক্ষীরা জেলাতেই গত দুই সপ্তাহে করোনার উপসর্গে ৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বিপিওর তথ্য অনুযায়ী, ৩০ জুন থেকে ৬ জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ৩১৮ জন। এক সপ্তাহে উপসর্গ নিয়ে সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঘটনা এটি। এর আগে এক সপ্তাহে উপসর্গ নিয়ে সর্বোচ্চ মৃত্যু হয়েছিল গত বছরের ২১ জুন থেকে ২৭ জুনের মধ্যে। তখন ২২২ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আর দেশে গত বছরের মার্চে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত উপসর্গে মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ৯৩৯ জনের।
খুলনার বটিয়াঘাটার শুক্লা গোলদার ১১ জুলাই খুলনা করোনা ডেডিকেটেড (নির্ধারিত) হাসপাতালে ভর্তি হন। পরের দিন অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাঁকে আইসিইউতে (নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) নেওয়া হয়। আইসিইউতে থাকা অবস্থায় তাঁর নমুনা নেওয়া হয়। ১৩ জুলাই দুপুরে মারা যান শুক্লা। তখনো তাঁর পরীক্ষার ফল আসেনি।
শুক্লার আত্মীয় কৌশিক সরকার বলেন, পরে হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন তিনি (মারা যাওয়া ব্যক্তি) পজিটিভ ছিলেন।
রংপুর শহরের জুম্মাপাড়ার বাসিন্দা আরিফা আমান (৪৩) করোনার উপসর্গ নিয়ে ১১ জুলাই রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। পরদিন তিনি মারা যান। পরিবারের অভিযোগ, করোনার উপসর্গ থাকার পরও তাঁর নমুনা পরীক্ষা করা হয়নি।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, যাদের শরীরে করোনা উপসর্গ থাকে তাদের সবার করোনার নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু তাঁর (আরিফা) হয়তো উপসর্গ ছিল না।
চট্টগ্রামে করোনা চিকিৎসার প্রধান দুটি হাসপাতাল হচ্ছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতাল। এর মধ্যে জেনারেল হাসপাতালে মূলত করোনা পজিটিভ রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। চট্টগ্রাম মেডিকেলে পজিটিভ এবং উপসর্গ দুই ধরনের রোগীদের সেবা দেওয়া হয়।
গত চার দিনে চট্টগ্রাম মেডিকেলে করোনায় মারা গেছেন ২৬ জন। একই সময়ে করোনা উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হয়েছে ২২ জনের। এর মধ্যে গতকাল শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত করোনায় ৭ জন ও উপসর্গ নিয়ে ২ জন মারা যান।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী বলেন, কারও বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, জ্বর, কাশি থাকলে হাসপাতালের করোনা ইয়েলো জোনে ভর্তি করা হয়। সেখানে করোনা পরীক্ষা করে পজিটিভ এলে তাদের রেড জোনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অনেকে রিপোর্ট আসার আগেই মারা যাচ্ছেন।
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার শাহজাহান মোল্লা (৭০) করোনার উপসর্গ নিয়ে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি হন ১০ জুলাই। পরদিন রাতে তিনি মারা যান। স্বজনেরা তাঁর লাশ বাড়ি নিয়ে দাফন করেন। কিন্তু স্বজনেরা নিশ্চিত ছিলেন না তিনি করোনা পজিটিভ না নেগেটিভ। ১৩ জুলাই তাঁরা জানতে পারেন শাহজাহান করোনা পজিটিভ ছিলেন।
গত এক সপ্তাহে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপসর্গ নিয়ে ৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল পর্যন্ত এঁদের ১৫ জনের নমুনা পরীক্ষার ফলাফল অপেক্ষমাণ ছিল। মৃতদের স্বজনেরা বলছেন, উপসর্গে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ফলাফল পেতে দেরি হওয়ায় স্বজনেরা অন্যদের সংস্পর্শে আসছেন। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, উপসর্গে মৃত্যু বেশি হচ্ছে, কারণ লোকজন করোনা পরীক্ষা করাতে আসছেন না। জ্বর, সর্দি, কাশির মতো উপসর্গ থাকলেই করোনা পরীক্ষা করাতে উৎসাহিত করতে হবে। তিনি বলেন, করোনা পরীক্ষার ফল আসার আগেই যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের সরকারি হিসাবে দেখানো হচ্ছে কি না বিষয়টি স্পষ্ট নয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে এটি পরিষ্কার করতে হবে।