পুরান ঢাকার বেগম বাজারের মোড়ে তিন শ বছরের বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ‘করতলব খান মসজিদ’। আমজনতার কাছে এর নাম ‘বেগম বাজার মসজিদ’
পুরান ঢাকার বেগম বাজারের মোড়ে তিন শ বছরের বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ‘করতলব খান মসজিদ’। আমজনতার কাছে এর নাম ‘বেগম বাজার মসজিদ’

এমন মসজিদ দেশে আর একটিও নেই

বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান মুরশিদ কুলি খান ১৭০০ থেকে ১৭০৪ সালের মধ্যে পুরান ঢাকার বেগম বাজারে অনন্য এই মসজিদ নির্মাণ করেন। স্থাপত্য রীতির কারণেই বাংলাদেশের অন্য যে কোনো মসজিদ থেকে আলাদা এটি

এক ঝাঁক পায়রা বসেছিল গম্বুজগুলোর ওপর। কোনোটি ঘাড় বাঁকিয়ে আয়েশ করে পিঠ-পাখনার পালক খুঁটছিল চঞ্চু দিয়ে। কোনোটি উত্তেজিত ভঙ্গিতে ডানে–বাঁয়ে তাকিয়ে পরখ করে দেখছিল কী পরিস্থিতি। সামান্য দূরে পাশের বাড়ির বারান্দা থেকে তাদেরই ছবি তোলা হচ্ছে ভেবে খুব একটা ভালো চোখে দেখছিল না তারা বিষয়টি। একটি–দুটি করে উড়ে উঠল ঝাঁক ধরেই।

দৃশ্যটি পুরোনো ঢাকার ব্যস্ত বেগম বাজারের মোড়ের ওপর তিন শ বছরের বেশি সময় ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ‘করতলব খান মসজিদের’। তবে মসজিদটিকে এই নামে এখন ইতিহাস সচেতন মানুষ ছাড়া আর কেউ চেনেন না। আমজনতার কাছে এর নাম ‘বেগম বাজার মসজিদ’।

করতলব খান মসজিদটির আলাদা গুরুত্ব রয়েছে এর স্থাপত্যবৈশিষ্ট্যের জন্য। মোগল আমলের যেসব স্থাপত্য নিদর্শন, বিশেষ করে মসজিদ এখনো সারা দেশে টিকে আছে, করতলব খান মসজিদ তার অন্যতম এবং স্বতন্ত্র।

পুরোনো মসজিদের ভেতরে চার কাতার ও বারান্দায় চার কাতার, প্রতি কাতারে ৭০ জন করে আট কাতারে প্রায় ৫৬০ জন মুসল্লির নামাজের ব্যবস্থা আছে। তবে সম্প্রসারিত অংশ মিলিয়ে এখন এই মসজিদে একসঙ্গে প্রায় দেড় হাজারের বেশি মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন

বিখ্যাত ঐতিহাসিক আহমদ হাসান দানী তাঁর ‘কালের সাক্ষী: ঢাকা’ বইতে উল্লেখ করেছেন, ‘শায়েস্তাখানি আমলের পর যে স্থাপত্যশিল্পের অগ্রগতি ঘটে, তার ব্যাপক প্রকাশ ঘটে এই মসজিদের নির্মাণকৌশলে।’ তিনি এই মসজিদের তিনটি প্রধান বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন।

করতলব খান এই মসজিত নির্মাণ করেন। এই করতলব খানই বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান মুরশিদ কুলি খান

প্রথম হলো মোগল আমলের মসজিদগুলোতে তিনটি গম্বুজ থাকত। কিন্তু এই মসজিদে গম্বুজ পাঁচটি। দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য, মসজিদটির উত্তর পাশের দেয়ালে বাংলা দোচালা ঘরের মতো ছাউনি দেওয়া একটি ঘর সংযুক্ত করা হয়েছে। ফলে মোগল স্থাপত্যরীতির সঙ্গে বাংলার ঐতিহ্যবাহী গৃহশৈলীর সম্মিলন ঘটেছে এখানে। তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো মসজিদে নিচের পূর্ব পাশে একটি কুয়া তৈরি করা হয়েছিল, সেই কুয়া নামার জন্য সিঁড়ি ছিল। দানী বলেছেন, ‘এ ধরনের সিঁড়ি যুক্ত কুয়া বাংলায় আর নেই; কিন্তু মুসলিম আমলে উত্তর ভারতে এ ধরনের কুয়া যথেষ্ট ছিল।’ কুয়াটি এখন আর নেই, সংরক্ষণ করা হলে একটি অনন্য নিদর্শন হতে পারত। এই তিন বৈশিষ্ট্যের মসজিদ বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি নেই।

‘করতলব খান’কে ইতিহাস চেনে ‘মুরশিদ কুলি খান’ নামে—অবশ্য এই দুটির কোনোটিই তাঁর প্রকৃত নাম নয়, সম্রাট আওরঙ্গজেবের দেওয়া উপাধি। তাঁর জন্ম ও প্রকৃত নাম নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে। তবে মনে করা হয় ‘মীর্জা হাদি’ বা ‘মোহাম্মদ হাদি’ ছিল তাঁর নাম। সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৭০০ সালে তাঁকে ‘করতলব খান’ উপাধি দিয়ে বাংলার দেওয়ান হিসেবে নিযুক্ত করেন। পরে তিনি ‘মুরশিদ কুলি খান’ উপাধি পেয়ে সুবাদারে উন্নীত হন। আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর তিনি অনেকটা স্বাধীনভাবে বাংলা শাসন করেছেন বলে তাঁকে প্রথম স্বাধীন সুলতানও বলেছেন ইতিহাসবিদেরা। সে যা হোক, করতলব খান ১৭০০ থেকে ১৭০৪ সালের মধ্যে বেগম বাজারে এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন।

বেগম বাজার মসজিদটি সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত প্রত্নসম্পদ। কিন্তু তারা এর কোনো দেখভাল করে না। এমনকি তাদের কোনো সাইনবোর্ডও নেই। এরই মধ্যে বহুবার এই মসজিদের সংস্কার করা হয়েছে
রাজীব উদ্দিন, মোতোয়ালি, বেগম বাজার মসজিদ

পরিচিত নাম ‘বেগম বাজার মসজিদে’ যেতে হলে সহজ পথ হলো চান খাঁর পুল পার হয়ে নাজিমউদ্দিন রোড দিয়ে পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগার পার হয়ে খানিকটা এগোলে পথ দুই ভাগ হয়ে ডান দিকে অর্থাৎ পশ্চিমে চলে গেছে চকবাজারের দিকে আর বাঁয়ের পথ তো পূর্ব দিকেই হবে, সেটি গেছে বেগম বাজারে। মোড়ের ওপরেই ‘করতলব খান’ মসজিদ।

বিখ্যাত ঐতিহাসিক আহমদ হাসান দানী তাঁর ‘কালের সাক্ষী: ঢাকা’ বইতে এই মসজিদের তিনটি ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছন, যা বাংলাদেশের অন্যান্য মসজিদ থেকে একে আলাদা করেছে

নাজিমউদ্দিন রোড ধরে এগোলেই এখন পুরোনো মসজিদটি সহজে চোখে পড়ে। অবশ্য আরমানিটোলা দিয়ে বেচারাম দেউড়ি হয়েও আসা যায়। সে ক্ষেত্রে মসজিদের সম্প্রসারিত নতুন ভবনটিই দেখা যাবে, মূল মসজিদটি দেখতে হলে সড়কের মোড় ঘুরে যেতে হবে।

ঐতিহাসিক এই মসজিদটি এখন পরিচালিত হচ্ছে ওয়াক্ফ স্টেটের মাধ্যমে। ১৮ বছর ধরে এর মোতোয়ালির দায়িত্ব পালন করছেন ব্যারিস্টার রাজীব উদ্দিন। আগে তাঁর বাবা শফিউদ্দিন বহু বছর মোতোয়ালি ছিলেন। গতকাল রোববার তিনি প্রথম আলোকে জানালেন, বেগম বাজার মসজিদটি সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত প্রত্নসম্পদ। কিন্তু তারা এর কোনো দেখভাল করে না। এমনকি তাদের কোনো সাইনবোর্ডও নেই। বহুবার এই মসজিদের সংস্কার করা হয়েছে।

মূল মসজিদ ভবন দৈর্ঘ্যে ২৮.৫৬ মিটার এবং প্রস্থে ৮.২৩ মিটার। ছাদের মাঝখানে একটি বড় এবং দুই পাশে একটু ছোট একই আকারের দুটি করে মোট পাঁচটি গম্বুজ রয়েছে। গম্বুজগুলোর শীর্ষ পদ্ম ও কলস অলংকার শোভিত। চার কোনায় রয়েছে অষ্টকোণাকৃতির বুরুজ

মুনতাসীর মামুন তাঁর ‘ঢাকা: স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ বইতে উল্লেখ করেছেন, এই মসজিদটির প্রথম সংস্কার করেছিলেন ঢাকার জমিদার মীর্জা গোলাম পীর। এর পরের সংস্কারের সময় নিচের তলার কুয়াটি ভরাট করা হয়েছে। রাজীব উদ্দিন জানালেন, পুরোনো মসজিদে মুসল্লিদের স্থান সংকুলান হচ্ছিল না। তাঁর বাবা পুরোনো মসজিদটি অক্ষুণ্ন রেখে ২০০৫ সালে সামনের অংশে পরিবর্ধনের কাজ শুরু করেন। শুরু হয়েছিল ১০ তলা ভিত দিয়ে। তাঁর বাবা ইন্তেকালের আগে তিনি একতলা পর্যন্ত করে গেছেন। সংস্কার পরিবর্ধনের কাজ চলছে মহল্লাবাসী ও ব্যবসায়ীদের দানে। পরে আরও তিনতলা করে এখন চারতলা পর্যন্ত করা হয়েছে। একটি বড় মিনার করার পরিকল্পনা আছে। কিন্তু অর্থাভাবে কাজ বন্ধ হয়ে আছে।

ভেতরে বাইরে সুদৃশ্য অলংকরণ রয়েছে এই মসজিদে

মসজিদের উত্তর পাশের বাংলা ঘরের আকারের কক্ষটি এখন মসজিদ পরিচালনা কমিটির দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সেখানে কথা হলো কমিটির কোষাধ্যক্ষ ও মসজিদের তরফে পরিচালিত মাদ্রাসার শিক্ষক হাফেজ মো. কফিল উদ্দিনের সঙ্গে।

৩৪ বছর ধরে তিনি এই দায়িত্ব পালন করছেন। প্রথম আলোকে জানালেন, পুরোনো মসজিদের ভেতরে চার কাতার ও বারান্দায় চার কাতার, প্রতি কাতারে ৭০ জন করে আট কাতারে প্রায় ৫৬০ জন মুসল্লির নামাজের ব্যবস্থা আছে। তবে সম্প্রসারিত অংশ মিলিয়ে এখন এই মসজিদে একসঙ্গে প্রায় দেড় হাজারের বেশি মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। আগে মসজিদটির নিচের তলায় ইটের মোটা মোটা থাম ছিল, উন্নয়নের সময় তার পরিবর্তে আরসিসি ঢালাইয়ের থাম বসানো হয়েছে। ফলে মসজিদটি এখন অনেক মজবুত হয়েছে।

পুরোনো মসজিদটি প্রায় একতলা সমান উঁচু বেদির ওপর নির্মিত। নিচের অংশে আগে ঘোড়া থাকত। এখন কয়েক সারি দোকান করে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। ওপরে মূল মসজিদ ভবন। দৈর্ঘ্যে ২৮.৫৬ মিটার এবং প্রস্থে ৮.২৩ মিটার। ছাদের মাঝখানে একটি বড় এবং দুই পাশে একটু ছোট একই আকারের দুটি করে মোট পাঁচটি গম্বুজ রয়েছে।

করতলব খান মসজিদে মোট পাঁচটি গম্বুজ রয়েছে। এর মধ্যে ছাদের মাঝখানে একটি বড় এবং দুই পাশে একটু ছোট একই আকারের দুটি করে গম্বুজ দেখা যায়

গম্বুজগুলোর শীর্ষ পদ্ম ও কলস অলংকার শোভিত। চার কোনায় রয়েছে অষ্টকোণাকৃতির বুরুজ। কার্নিশ এবং ভেতরে মিনার খিলান আকৃতির নকশাখচিত। মূল মসজিদের ভেতরে প্রবেশের জন্য পূর্বে পাঁচটি অর্ধগম্বুজ আকারের খিলান পথ। গম্বুজে পদ্মফুলের নকশা। ভেতরে উত্তর ও দক্ষিণে একটি করে দরজা ছিল। দক্ষিণেরটি এখন বন্ধ। উত্তরের দরজাটি দিয়ে সংলগ্ন বাংলা ঘরে যাতায়াত করা যায়। পশ্চিমের দেয়ালে খিলান আকৃতির প্রধান মিম্বরের পাশে রয়েছে অপেক্ষাকৃত ছোট দুটি করে খিলান। এ ছাড়া পশ্চিম ও পূর্ব দেয়ালের ভেতরের অংশে রয়েছে খিলান আকারের ছোট ছোট ১০টি করে ২০টি কুলুঙ্গি। ভেতরে বাইরে সুদৃশ্য অলংকরণ রয়েছে এই মসজিদে।

বরাবরের মতোই এবারেও রোজার শুরু থেকেই তারাবির জামাত হচ্ছে করতলব খান বা বেগম বাজার মসজিদে। সন্ধ্যায় থাকে ইফতারির আয়োজন। মুসল্লিরা আসেন আবার ফিরেও যান যাঁর যাঁর ঘরে। তবে এখানে কিছু স্থায়ী বাসিন্দাও আছে। শুধু স্থাপত্যরীতিই নয়, তাদের উপস্থিতিও স্বাতন্ত্র্য যোগ করেছে করতলব খান মসজিদে। ওরা থাকে ভবনের কোনায়, ফাঁকফোকরে। বাক বাকুম ডাকে। আড্ডা জমায় গম্বুজে গম্বুজে। উড়ে যায়, ফিরে আসে পায়রার ঝাঁক।