পারিবারিক নির্যাতনের বিষয়ে আইনি ব্যবস্থা চেয়ে মধ্যস্থতা হয় বেশি।
স্বামীর নির্যাতনের শিকার এক নারীর ভাই মাঝেমধ্যেই এই প্রতিবেদককে ফোন দিয়ে বোনের কষ্টের কথা জানান। কথা হতো ওই নারীর (৩৭) সঙ্গেও। ২০২০ সালে বিয়ের পর থেকেই ওই নারীর সংসারে অশান্তি। কখনো টাকার দাবিতে, কখনো খুঁটিনাটি বিষয়ে নির্যাতন চলত। ২০২১ সালে ৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা থাকা অবস্থায় স্বামীর মারধরের কারণে গর্ভেই তাঁর সন্তানের মৃত্যু হয়। তবে সংসার ভেঙে যাওয়ার ভয়ে মামলা করতে আগ্রহী ছিলেন না তিনি।
সবশেষ গত ২৫ জুলাই রাজধানীর কচুক্ষেতের বাসায় চরম নির্যাতনের মুখে ওই নারীর ফোনে পুলিশ বাসায় আসে এবং ২৮ জুলাই কাফরুল থানায় তিনি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন।
সাড়ে তিন বছর নির্যাতন সহ্য করে ওই নারী মামলা করলেও আরেক নারী এখনো অশান্তি মিটমাট হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন। গত ২৭ জুন মধ্যরাতে ওই নারীকে মারধর করে বাসা থেকে বের করে দেন ওই নারীর স্বামী গোয়েন্দা শাখার সাবেক এক পুলিশ সদস্য ও দুই সৎছেলে।
পরিবার ও সমাজে নারীর প্রতি সংবেদনশীল পরিবেশ তৈরি, বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা দূর করে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করতে হবে। তা না হলে অপরাধীরা উৎসাহিত হবে।অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক, অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
আশুলিয়া থানা-পুলিশ রাস্তা থেকে ওই নারীকে উদ্ধার করে বাসায় পৌঁছে দিলেও কয়েক ঘণ্টা পর স্বামী ও সৎছেলেরা আবার বের করে দেন। ওই নারী গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি স্বজনদের বাসায় আশ্রয় নিয়েছেন। গ্রাম্য সালিসে স্বামীকে ডাকা হলেও তিনি আসেননি। কথা বলার সময় ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন ওই নারী।
অপরাধবিজ্ঞানী ও পুলিশের মতে, নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে নীরব থাকা হয় পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনায়। সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল নারীরা সংসার টিকিয়ে রাখার চেষ্টায় নির্যাতনের ঘটনার প্রতিকার চেয়ে আইনি আশ্রয় নেন না। এতে নির্যাতনের ভয়াবহতা আরও বাড়তে থাকে। ঘরের ভেতর নারীর এই অসম্মানজনক অবস্থার প্রভাবে ধর্ষণ, যৌন হয়রানির ঘটনাও বাড়ে।
নারীর প্রতি সব ধরনের নির্যাতন বন্ধের দাবিতে প্রতিবছরের মতো আজ ২৪ আগস্ট ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ পালন করা হচ্ছে। কিশোরী ইয়াসমিন ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাকে ঘিরে নারী সংগঠনগুলো ২৮ বছর আগে দিবসটি পালন শুরু করে।
১৯৯৫ সালের এই দিনে ঢাকা থেকে বাসে করে ভোররাতে দিনাজপুরে যাওয়া ইয়াসমিনকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে কোতোয়ালি পুলিশের টহল পিকআপে তুলে নিয়ে ধর্ষণের পর হত্যা করেন তিন পুলিশ সদস্য। ২০০৪ সালে ওই তিন পুলিশ সদস্যের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।
স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করা নারীর মুখে এ কথারই যেন প্রতিফলন ঘটল। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে জানালেন, মামলায় তাঁর স্বামী গ্রেপ্তার হলেও মাত্র তিন দিনের মাথায় জামিন পেয়ে গেছেন। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘তাহলে কি ওর (স্বামী) কোনো শাস্তিই হবে না?’
ইয়াসমিনের মা শরীফা বেগম দিনাজপুরে দুটি বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। স্বামী ও দুই ছেলে রয়েছে। ইয়াসমিন ছিলেন তাঁর প্রথম সন্তান। শরীফা বেগম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, এখন আর কোনো সংগঠন দিবসটি পালন নিয়ে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে না। তিনি আজ বাড়িতে মিলাদ ও এতিমদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছেন। তিনি বললেন, নারী নির্যাতনের ঘটনায় বছরের পর বছর বিচার ঝুলে থাকে। এ কারণে নারী নির্যাতনকারীরা নির্যাতন করতে ভয় পায় না।
এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এ নারী ও শিশু নির্যাতন বিষয়ে কল এসেছে ১৫ হাজার ৯৫২টি। এর মধ্যে ১৩ হাজার ৩৭০টি পারিবারিক নির্যাতনের। এ ছাড়া যৌন হয়রানির ৭১৪টি, ধর্ষণের ৬৮৬টি, হত্যার ঘটনায় ৫৭৮টি, ধর্ষণচেষ্টার ৩৩৩টি, যৌতুকের কারণে নির্যাতনের ২৬৩টি, অ্যাসিড সহিংসতার ৮টি।
জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এর মুখপাত্র আনোয়ার সাত্তার প্রথম আলোকে বলেন, এই পরিমাণ কল, অর্থাৎ এতসংখ্যক ব্যক্তিকে জরুরি সেবা দেওয়া হয়েছে। পারিবারিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায়, নারীরা কল করে বাড়িতে পুলিশ ডেকে আনেন। কিন্তু সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে পরে আর মামলা করতে চান না। আবার অনেক পরিবারে ঘন ঘন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে, সেসব ক্ষেত্রে পুলিশ বারবার যেতে আগ্রহী হয় না।
আমার জন্য কিছু একটা করা যায়! এটা আমার দ্বিতীয় বিয়ে। এটাও ভেঙে গেলে খুব লজ্জায় পড়ে যাব।নারীর কণ্ঠে আকুতি
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক ‘পারিবারিক নির্যাতন’ বিষয়ে পিএইচডি করেছেন। তিনি জানান, পারিবারিক নির্যাতনের যত ঘটনা ঘটে, তার মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশের ক্ষেত্রে মামলা হয়। বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ও সালিসের মাধ্যমে ২ দশমিক ৬ শতাংশ ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা হয়। বেশির ভাগই নিজেরাই সমঝোতা করেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) হুমায়রা পারভীন প্রথম আলোকে বলেন, মামলা হলেই পুলিশ তদন্ত করে ও ব্যবস্থা নেয়। অনেক ভুক্তভোগী আইনি ব্যবস্থা নিতে সচেতন নন। আবার অনেকে মামলা করলেও তা অব্যাহত রাখতে চান না। এ ছাড়া পারিবারিক নির্যাতনের বিষয়ে আইনি ব্যবস্থার চেয়ে মধ্যস্থতাও হয় বেশি।
অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, পরিবার ও সমাজে নারীর প্রতি সম্মানবোধ না থাকা ও ন্যায়বিচার পাওয়ার ন্যায্যতা না থাকায় নারীরা মামলা করতে চান না।
নারীর প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ ও যৌন উদ্দীপনা থেকে একশ্রেণির পুরুষ নারীর প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে এবং নির্যাতন করে। তাই পরিবার ও সমাজে নারীর প্রতি সংবেদনশীল পরিবেশ তৈরি, বিচারপ্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা দূর করে নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করতে হবে। তা না হলে অপরাধীরা উৎসাহিত হবে।
স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা করা নারীর মুখে এ কথারই যেন প্রতিফলন ঘটল। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে জানালেন, মামলায় তাঁর স্বামী গ্রেপ্তার হলেও মাত্র তিন দিনের মাথায় জামিন পেয়ে গেছেন। তিনি প্রশ্ন করেন, ‘তাহলে কি ওর (স্বামী) কোনো শাস্তিই হবে না?’
স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া অন্য নারীর কণ্ঠে আকুতি, ‘আমার জন্য কিছু একটা করা যায়! এটা আমার দ্বিতীয় বিয়ে। এটাও ভেঙে গেলে খুব লজ্জায় পড়ে যাব।’