প্রথমার আয়োজনে ‘বিজয় বইমেলা’ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। বাংলা একাডেমি, ১৬ ডিসেম্বর
প্রথমার আয়োজনে ‘বিজয় বইমেলা’ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। বাংলা একাডেমি, ১৬ ডিসেম্বর

অমিত সাহস বাঙালিকে অনন্য করেছে: অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, স্বাধীনতা হালকাভাবে নেওয়ার বিষয় নয়। এই দিনে দেশ স্বাধীন হয়েছে। এটা গৌরবের দিন, এটা পুণ্যের দিন।

আজ সোমবার মুক্তিযুদ্ধের মহান বিজয় দিবসে প্রথমা প্রকাশন আয়োজিত বিজয় বইমেলার অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এ কথা বলেন।

বাংলাদেশিদের দেশপ্রেমের উদাহরণ টেনে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, ‘পাকিস্তানিরা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে পারেনি। কারণ, আমাদের ভেতরে ছিল দেশপ্রেম। আমাদের ভেতরে ছিল গণতন্ত্রের চেতনা ও আকাঙ্ক্ষা। পাকিস্তানিরা ছিল সামন্তবাদী। বাঙালি ২০০ বছর ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন করেছে। তারা রেনেসাঁর সময় অতিক্রম করেছে। এতে বাঙালির ভেতরে তৈরি হয়েছিল গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধ। সেই চেতনা ও দেশপ্রেম নিয়ে যুদ্ধ করেছে ভয়ংকর অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত পাকিস্তানের হানাদার সেনাদের বিরুদ্ধে। পাল, সেন, মোগল, পাঠান, তুর্কি, ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বাঙালি তার চিরকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এই অর্জনকে কেউ সহজভাবে নেবে না। বহু জীবনের বিনিময়ে, বহু সংগ্রামে অর্জিত আমাদের এই স্বাধীনতা মোটেই হালকাভাবে নেওয়ার বিষয় নয়।’

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ইতিহাস থেকে ঐতিহ্য, সাহিত্য থেকে সংস্কৃতি, ভূতত্ত্ব থেকে ভূগোল, ধর্ম থেকে দর্শন, রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, সংগ্রাম থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বিশাল বিচিত্র ভুবন ছুঁয়ে গিয়েছিলেন তাঁর প্রসিদ্ধ অসাধারণ বাগ্মিতায়। মুগ্ধ হয়ে শুনেছেন শ্রোতারা। আসন ভরে গিয়েছিল, অনেকেই মাঠে দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তব্য শুনেছেন।

বক্তব্য দিচ্ছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

এই শিক্ষাবিদ বলেন, পাকিস্তানের জন্ম, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯–এর গণ–অভ্যুত্থান, ১৯৯০–এর গণ–অভ্যুত্থান ও সর্বশেষ ২০২৪–এর গণ–অভ্যুত্থান দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর জীবনে। তবে সাম্প্রতিক জুলাইয়ের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে পুরো জাতি যেন পাগল হয়ে উঠেছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার চরণ উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, ‘একবার মরে ভুলে গেছে আজ মৃত্যুর ভয় তারা’। বাস্তবেই এমন করে মৃত্যুর ভয়কে ভুলে গিয়েছিল তরুণ প্রজন্ম। পুলিশ বলেছে, ‘একটি গুলি করলে একজনই মারা যায়, অন্যরা জায়গা থেকে সরে না।’ এই যে অমিত সাহস, এটাই বাঙালিকে অনন্য করেছে। এই সাহসিকতার জন্যই এ উপমহাদেশে কেবল বাঙালিরাই একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গঠন করতে পেরেছে। এবার তারা তাদের সাহসী আত্মদানের ভেতর দিয়ে একটি নতুন পরিপ্রেক্ষিত সৃষ্টি করেছে। ব্রিটিশ আইনের সংস্কার করে নিজেদের জন্য একটি নতুন আইন, বিধিবিধান তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। এটা বাঙালি ছাড়া আর কেউ করতে পারেনি।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী রফিকুল আলম দুটি গান গেয়ে শোনান

অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এই প্রসঙ্গে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে মেধাবী জাতিগঠনের জন্য পঠনপাঠনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, মানুষ এখন অনেকটাই বই বিমুখ হয়েছে। সেলফোনের দিকেই তারা বেশি সময় তাকিয়ে থাকে। এমনকি পাশের মানুষের দিকে তাকানোর সময়ও নেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বইয়ের চেয়ে উপকারী আর কিছু নেই। তিনি বিজয়ের মাসে প্রথমা প্রকাশনের এই বইমেলা আয়োজনের ভেতর দিয়ে মানুষের মধ্যে পাঠাভ্যাসে অনুপ্রেরণা দেওয়ার উদ্যোগের প্রশংসা করেন।

বিজয় দিবসের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে। এরপর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী রফিকুল আলম ‘এই যে স্বাধীন দেশে আমি’ এবং ‘ যায় যদি যাক প্রাণ’ গান দুটি গেয়ে শোনান।

এরপর ছিল আলোচনা পর্ব। আলোচনায় আরও অংশ নেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রব্বানী। তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতা আমাদের সংহত করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। এই জনযুদ্ধকে জনগণের কাছে নিয়ে যেতে হবে। সমাজে যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তার সঙ্গে মিলিয়ে এখন আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই করার সময় এসেছে।’

পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে অবমূল্যায়ন করার চেষ্টা করা হচ্ছে, অভিযোগ করে গোলাম রব্বানী বলেন, তাদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে হবে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে এই দেশের বীর সন্তানেরাই শত্রুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লড়াই করেছেন। যৌথ বাহিনী গঠিত হয়েছিল যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে নভেম্বর মাসে এবং যৌথ বাহিনী অভিযান শুরু করেছিল ডিসেম্বরের ৩ তারিখে। এত দিন এ দেশের শাসকেরা একটি দাসত্বের রীতি তৈরি করেছিলেন। জুলাই অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে তার অবসান হয়েছে। বিষয়টি সবার মনে রাখা উচিত।

কবি শামসুর রাহমানের ‘কখনো আমার মাকে’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন অভিনেতা আফজাল হোসেন

সমাপনী বক্তব্যে প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক ও কবি সাজ্জাদ শরিফ সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব ঘটনা। এর মধ্য দিয়ে ইতিহাসকে আমরা নতুন করে দেখতে পারছি। স্বাধীনতাসংগ্রাম নিয়ে যে এককেন্দ্রিক বয়ান তৈরি করা হয়েছিল, সেখান থেকে সরে এসে বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রামকে এখন সুবৃহৎ পটভূমিতে দেখার সুযোগ হয়েছে।’

আলোচনার পরে কবি শামসুর রাহমানের ‘কখনো আমার মাকে’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন অভিনেতা আফজাল হোসেন, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’ আবৃত্তি করেন তাহসিন রেজা ও কবি মোহাম্মদ রফিকের ‘যদি সত্যি হয়’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন হুর এ জান্নাত। সঞ্চালনা করেন প্রথমার প্রধান সমন্বয়ক মশিউল আলম।

এইচএসবিসি ব্যাংকের পৃষ্ঠপোষকতায় গত বৃহস্পতিবার বাংলা একাডেমি চত্বরে শুরু হয়েছে ১০ দিনের বিজয় বইমেলা। মেলা প্রতিদিন বেলা ১১টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত চলবে। ২১ ডিসেম্বর মেলা শেষ হবে।

বিজয় বইমেলায় প্রথমা প্রকাশনে বই সর্বনিম্ন ৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ, অন্য প্রকাশনীর বই ২৫ শতাংশ এবং বিদেশি বই সর্বনিম্ন ৫ থেকে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ছাড়ে কেনা যাবে।

অনুষ্ঠানসূচি:

মেলার মঞ্চে আগামীকাল মঙ্গলবার কোনো অনুষ্ঠান থাকবে না। পরদিন বুধবার বিকেল চারটায় থাকবে গণ-অভ্যুত্থানের কবিতা পাঠ, আলোচনা ও গান। আলোচনা করবেন আলতাফ শাহনেওয়াজ, গান গাইবেন আহমেদ হাসান সানি ও জাহীদ অন্তু।