সে বাড়ির পুরুষেরা এক গ্লাস পানিও নিজ হাতে ঢেলে খায় না। বাড়ির নারীদের কাজ রান্না করে পুরুষদের পরিবেশন করা। প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে কোটাবাছা, রান্নাবান্না আর এঁটো বাসন ধোয়ার দৃশ্য দেখতে দেখতে সিনেমার দর্শকেরা যখন ক্লান্ত-বিরক্ত, তখনই ঘটল ব্যতিক্রম। রক্ষণশীল পরিবারটির এক নারী প্রতিবাদ করে বসলেন। ছেড়ে চলে গেলেন একঘেয়ে সংসার, যাকে পরিচালক ইঙ্গিত করেছেন ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’ নামে।
‘জিও বেবি’ পরিচালিত মালায়ালম ভাষায় ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’ সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল গত বছর করোনাকালে। লকডাউনের অভিজ্ঞতায় তত দিনে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় সব বাড়ির পুরুষেরা বুঝে গেছেন, ঘরের কাজ কতটা একঘেয়ে হতে পারে নারীদের জন্য। সিনেমাটি পেয়ে যায় জনপ্রিয়তা ও পুরস্কার। সোমবার ‘সমভাব আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব’-এর সর্বশেষ সিনেমা ছিল এটি। প্রদর্শনীর পর প্যানেল আলোচনা হয়।
গত রোববার সকাল থেকে রাজধানীর ছায়ানট ভবন মিলনায়তনে শুরু হয় দুই দিনের সমভাব আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। লিঙ্গ সংবেদনশীলতা ও সমন্বয় ছিল উৎসবের চলচ্চিত্র বাছাই ও আলোচনার বিষয়বস্তু। ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান কিচেন’ নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন নাট্যব্যক্তিত্ব সারা যাকের, চলচ্চিত্র পরিচালক অমিতাভ রেজা চৌধুরী, নারী অধিকার আন্দোলনের নেত্রী খুশী কবির ও উৎসবের পরিচালক হারিস সাদানি।
সিনেমাটি দেখার পর প্রশ্ন ও প্রতিক্রিয়া আহ্বান করা হয় দর্শকসারি থেকে। বেশ কয়েকজন দর্শক নিজেদের অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করেন। কেউ ছবির অভিনেত্রী নিমিসা সাজায়ানের জায়গায় নিজের মাকে, আবার কেউ নিজেকেই সেখানে খুঁজে পেয়েছেন।
গৃহিণীর কাজও একটি স্বতন্ত্র কাজ হতে পারে বোঝাতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের এক শিক্ষার্থী বলেন, নারী সংসারী হলে সেটা কেন সিনেমায় দেখানো হবে না। জবাবে অমিতাভ রেজা চৌধুরী বলেন, ‘পুরুষেরাও সংসারী হতে পারে।’
নিজের বাড়ির অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে এই পরিচালক বলেন, ‘আমার বাবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ তাঁর রাজনৈতিক সচেতনতা ও প্রচুর বইপুস্তক রেখে যাওয়ার কারণে। কিন্তু আমি ও আমার বোন তাঁকে ঘৃণা করতাম। কারণ, তিনি আমাদের মায়ের ওপর সংসার চাপিয়ে দিয়েছিলেন।’
সিনেমাটির সমালোচনা করে অমিতাভ রেজা চৌধুরী বলেন, ‘নির্মাতা হিসেবে আমার মনে হয়েছে, এই সিনেমায় অবাস্তব একটি ছবি তুলে ধরা হয়েছে। যে মেয়েটিকে আমরা পর্দায় দেখলাম, তার অতীত বা জীবনে কোনো পঙ্কিলতা দেখানো হয়নি। বাস্তবে একজন মানুষ এতটা নির্মল হতে পারে না।’
নারীকে দিয়ে বাড়ির সব কাজ করিয়ে নেওয়ার বাংলাদেশি সংস্কৃতির সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘বিদেশে গেলে সবাই মিলেমিশে বাড়ির কাজ করে। একত্রে রান্নাবান্না করে। সেই পুরুষেরাই দেশে ফিরলে আর স্ত্রীকে বাড়ির কাজে সহযোগিতা করে না।’
সারা যাকের বলেন, ‘চলচ্চিত্র একটি শক্তিশালী মাধ্যম। এখানে চাইলেই আমরা সবকিছু দেখাতে পারি না। সমলিঙ্গের প্রেম আমরা পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারব না, এই মর্মে আমাদের কাছে একবার চিঠিও এসেছিল।’
প্রয়াত নারীবাদী কমলা ভাসিনকে স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘কমলা যে রকম ভারত ও যে রকম পৃথিবী দেখতে চেয়েছিল, আমরা সে রকম মুক্ত পৃথিবী গড়ার জন্য কাজ করে যেতে পারি।’
উৎসবে ‘মাই মাদার্স গার্লফ্রেন্ড’ ছবিটির প্রদর্শনী শেষে প্যানেল আলোচনায় নৃবিজ্ঞানী নাসরিন সিরাজী বলেন, ‘আমাদের সমাজে নারীকে এখনো কেবল সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবেই দেখা হয়। তাঁর আকাঙ্ক্ষা বা আনন্দ থাকতে পারে, এ নিয়ে কখনো কথা বলা হয় না। এই ট্যাবু ধরে রাখা ও না রাখার চর্চার মধ্য দিয়ে ভালো মেয়ে-মন্দ মেয়ে চিহ্নিত করা হয়।’
সাম্প্রতিক আলোচিত ‘হাওয়া’ চলচ্চিত্রের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘এই সিনেমায় গুলতিকে দেখানো হয়েছে এমন এক প্রতিবাদী নারী হিসেবে, যে যৌন আবেদনময়ী এবং সে প্রতিশোধ নিতে পারে। এমনকি এতগুলো জেলে যুবকের সঙ্গে অবস্থান করেও তাঁরা স্পর্শও করেনি, এটাও অযৌক্তিক।’
উৎসবের বাংলাদেশি আয়োজকেরা জানালেন, একই বিষয়বস্তু নিয়ে তাঁরা এ রকম উৎসব করতে চান। এতে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা বাড়বে।