এক শুনানিতে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেছেন, পত্রিকাগুলো কী নিউজ প্রকাশ করবে, কী করবে না, এমন আশঙ্কা থেকে কী নিষেধাজ্ঞা দেব? এস আলম গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ সাইফুল আলম ও তাঁর স্ত্রী ফারজানা পারভীনের বিদেশে সম্পদের বিষয়ে সংবাদ, বিবৃতি, মতামত ও অনলাইনে কোনো ভিডিও প্রকাশ বা সম্প্রচারের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে করা আবেদনের শুনানিতে বৃহস্পতিবার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম আবেদনকারীদের আইনজীবীর উদ্দেশে এ প্রশ্ন রাখেন।
শুনানিতে আবেদনকারীদের আইনজীবী আজমালুল হোসেন কেসি বলেন, তাইওয়ান পর্যন্ত চলে গেছে। সেখানকার একটি মিডিয়ায় প্রতিবেদন এসেছে। তখন আদালত বলেন, কেউ যদি নিউজ করে, তাহলে কীভাবে বিরত রাখবেন? আদালতের আদেশ লঙ্ঘন করে কোনো সংবাদ বা প্রতিবেদন করলে সেজন্য আলাদা কার্যধারা আছে। আর এখন পত্রিকাগুলো কী নিউজ প্রকাশ করবে, কী নিউজ প্রকাশ করবে না—এমন আশঙ্কা থেকে কী নিষেধাজ্ঞা দেব? এমনও দেখছি না যে আদালতের স্থিতাবস্থা বা ওই বিষয়বস্তু সম্পর্কে লিখেছে।
গত ৪ আগস্ট দ্য ডেইলি স্টারে ‘এস আলমস আলাদিনস ল্যাম্প’ (এস আলমের আলাদিনের চেরাগ) শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হয়। এটি আদালতের নজরে আনেন আইনজীবী সৈয়দ সায়েদুল হক। এরপর ৬ আগস্ট হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত রুল দিয়ে অনুমতি ছাড়া বিদেশে বিনিয়োগ বা অর্থ স্থানান্তর নিয়ে এস আলম গ্রুপের মালিক ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে ওই প্রতিবেদনে আসা অভিযোগ অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দিতে আদেশ দেন হাইকোর্ট। এই আদেশের বিরুদ্ধে এস আলম ও তাঁর স্ত্রী আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেন। গত ২৩ আগস্ট আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত বিষয়বস্তু সম্পর্কে সব পক্ষকে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দেন। একই সঙ্গে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে লিভ টু আপিলটি শুনানির জন্য আগামী ৮ জানুয়ারি দিন ধার্য করেন। এরপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে ১২ সেপ্টেম্বর আবেদনটি করেন এস আলম ও তার স্ত্রী। এদিন আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী রোকন উদ্দিন মাহমুদ, আজমালুল হোসেন কেসি ও মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ মামুন। দুদকের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।
সৈয়দ সায়েদুল হকের দেওয়া বক্তব্য তুলে ধরে শুনানিতে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আজমালুল হোসেন কেসি বলেন, এস আলম সম্পর্কে একটা অভিযোগ এসেছে, বিষয়টি বিচারাধীন। বিচারাধীন বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এ নিয়ে একটি মিডিয়া-ট্রায়াল হচ্ছে।
আদালত বলেন, আপনি যাদের (গণমাধ্যম) বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা চাইলেন, তারা কেউ স্বতঃপ্রণোদিত রুলের পক্ষ নয়। লিভ টু আপিলেও পক্ষ নয়। যারা পক্ষ নয়, তাদের ক্ষেত্রে বিরত রাখার আদেশ কীভাবে দেব?
এক পর্যায়ে আজমালুল হোসেন কেসি বলেন, প্রধানত দরকার ডেইলি স্টারের বিষয়ে। আদালত বলেন, ডেইলি স্টার, ডেইলি স্টারের কথা ছাপিয়েছে। আপনি আপনার কথা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ছাপিয়েছেন। নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মতো প্রাইমাফেসি (প্রাথমিক উপাদান) কিছু দেখছি না যে এদের (গণমাধ্যম) বিরত রাখতে হবে। স্থিতাবস্থার আদেশের পর তারা কোনো নিউজ করেছে কি না? মিডিয়া ট্রায়াল হয় বলছেন বা বিচার বিঘ্নিত হতে পারে—এমন কোনো উপাদান দেখছি না।
একাধিক মামলার প্রসঙ্গ টেনে আজমালুল হোসেন কেসি বলেন, বিরত রাখার নির্দেশনা চাওয়া হচ্ছে, এই কারণে যে নিউজ করে জনগণকে ধারণা দিতে। হাইকোর্টে যেতে পারছি না। কারণ, স্থিতাবস্থার আদেশ আছে। মিডিয়া ট্রায়াল রোধে চাচ্ছি।
শুনানির এই পর্যায়ে আদালত বলেন, ‘সবাই আমরা ট্রায়ালের শিকার। এখন বিচারকেরা আদেশ দিলেও যার পক্ষে যায়, তিনি বলেন রায়–আদেশ ঐতিহাসিক। যার বিপক্ষে যায়, উনি বলেন ফরমায়েশি। প্রতিক্রিয়া যে যার যার মতো করে বলে। ফেসবুকেও দিচ্ছে। এসব বিষয়ে আমরা অসহায় অবস্থায় আছি। আপনারা বারের (আইনজীবী সমিতির) জ্যেষ্ঠ সদস্য, আপনাদের দায়িত্ব আছে, সকলেরই দায়িত্ব আছে, আদালতের মর্যাদা ও আদালতে আদেশ সমুন্নত রাখা।’
আইনজীবীর উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘ফলোআপ যদি কিছু থাকত, যদি দেখতাম এটির ওপর এখনো বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে। স্থিতাবস্থার আদেশের পরে নানা কথাবার্তা হচ্ছে—তাহলে এক রকম কথা ছিল।’
শুনানিতে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, এখানে ডেইলি স্টারের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত আদেশ দেন। প্রথম আলো ও নিউ এজের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্বতঃপ্রণোদিত রুল হয়নি। যাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রুল ইস্যু হয়নি, তাদের এখানে নিয়ে আসার মানে কী? মানেটা হলো, আমার ব্যাপারে কেউ কিছু বলতে পারবে না। সোজা কথা—মুখ বন্ধ থাকতে হবে। দুদকের তথ্য–উপাত্ত পাওয়ার একটি উৎস হলো মিডিয়া। মিডিয়ার প্রতিবেদনের তথ্যসূত্রে দুদকের ১৫ শতাংশের বেশি অনুসন্ধান ও তদন্ত হয়। গণমাধ্যমের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে দুদকের তথ্য–উপাত্ত পাওয়ায়ও প্রতিবন্ধকতা দেখা দেবে।
একপর্যায়ে আদালত বলেন, ‘মিডিয়ার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা আদি সভ্যতার শুরু থেকেই। প্রতিবেদন ভুল হলে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মানহানিকর হলে—সে বিষয়ে আইনকানুন আছে। সবার নীতিমালা মেনে চলা উচিত। আইনজীবী আজমালুল হোসেন কেসি বলেন, অভিযোগের পর পদক্ষেপ নেবে, না নিলে উনারা ছাপাবে। আগেই ছাপিয়ে দিচ্ছে।’
আদালত বলেন, দুর্নীতির তথ্য–উপাত্ত পেলে পত্রিকা প্রতিবেদন ছাপাবে। প্রকাশিত প্রতিবেদন সত্য না মিথ্যা বা কারও সুনামহানি করার জন্য বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কি না—তা দেখার বিভিন্ন রকম সুযোগ আছে।
শুনানি নিয়ে আদালত বলেন, আবেদনটি নথিভুক্ত করা হলো। আবেদনকারী ইচ্ছাপোষণ করলে লিভ টু আপিল শুনানিকালে আবেদনটি উপস্থাপন করতে পারবেন। উল্লেখ্য, আপিল বিভাগে লিভ টু আপিলটি শুনানির জন্য আগামী বছরের ৮ জানুয়ারি দিন ধার্য রয়েছে।