টেকনিশিয়ান ও প্রয়োজনীয় জনবলের অভাবে চিকিৎসা সরঞ্জাম কোনো কাজে আসছে না। কারাবন্দীরা পাচ্ছেন না যথাযথ চিকিৎসাসেবা।
কারাগারের হাসপাতালে রোগনির্ণয়ের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম আছে। কিন্তু নেই চালানোর মতো টেকনিশিয়ান ও জনবল। এই যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য তৈরি করা হয়নি কোনো ল্যাব। এ কারণে বছরের পর বছর ধরে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে শতকোটি টাকার সরঞ্জাম। এটি সরকারি অর্থের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
দেশের অন্তত ১০টি কারাগারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশির ভাগ কারা হাসপাতালের অধিকাংশ যন্ত্রপাতি বাক্সবন্দী অবস্থায় পড়ে আছে। প্রয়োজনীয় লোকবল না থাকায় এগুলো খোলাও হচ্ছে না।
কারা হাসপাতালের চারজন চিকিৎসক প্রথম আলোকে বলেন, রেডিওগ্রাফার নেই, এক্স-রে মেশিন কেনা হয়েছে। সনোলজিস্ট নেই, আলট্রাসনোগ্রাম মেশিন কেনা হয়েছে। আবার সরঞ্জাম কেনা হয়েছে, যন্ত্রপাতি বসানোর ল্যাব বানানো হয়নি। আসলে কারাগারের মানুষকে সেবা দেওয়ার মানসিকতাই কারও নেই। প্রস্তুতি ছাড়া এসব যন্ত্রপাতি কেন নেওয়া হলো, সেটিও বড় এক প্রশ্ন। কিন্তু উত্তর দেওয়ার কেউ নেই।
তবে কারা কর্মকর্তারা বলছেন, চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনার পর থেকেই কারা কর্তৃপক্ষ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে জনবল চেয়ে আসছে। কিন্তু টেকনিশিয়ান বা জনবল প্রেষণে দিচ্ছেন না তারা। এখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ বিষয় নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলা উচিত। একইভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে চিকিৎসক চেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে ২০০ শয্যার হাসপাতাল রয়েছে। কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২–এর বিশেষায়িত হাসপাতালে সবচেয়ে বেশি চিকিৎসা সরঞ্জাম রয়েছে। হাসপাতালে ২০১১-২০১৩ সাল থেকে বাক্সবন্দী অবস্থায় পড়ে আছে এক্স-রে মেশিন, আলট্রাসাউন্ড মেশিন, সিআর সেট কম্পিউটারাইজড রেডিওগ্রাফিসহ নানা যন্ত্রপাতি। দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় এসব যন্ত্রপাতি আদৌ ভালো আছে কি না, তা বোঝার উপায় নেই।
কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২–এর জেল সুপার আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘জনবল নেই। কারারক্ষীদের ডিপ্লোমা করিয়ে আমরা এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহারের চেষ্টা করছি। তাঁদের এই প্রশিক্ষণ শেষ হলে সমস্যা কিছুটা দূর হবে।’
একই অবস্থা কেরানীগঞ্জে অবস্থিত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেরও। ১৭২ শয্যার কারা হাসপাতালে ২০১৯ সাল থেকে ৩০ লাখ টাকা দামে কেনা দুটি ডিজিটাল এক্স-রে মেশিন বাক্সবন্দী অবস্থায় পড়ে রয়েছে। সমস্যা একই—জনবল নেই।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঁচ বছর ধরে আছেন চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দিনের পর দিন ফেলে রাখায় এসব যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে গেছে। তবে এখানকার চেয়ে কাশিমপুরে বেশি যন্ত্রপাতি পড়ে আছে। এসব বসানোর বা চালানোর মতো জনবল নেই। যন্ত্রপাতি আনা হয়েছে, কিন্তু প্রয়োজনীয় জনবল নেই। তাহলে এই হাসপাতাল কীভাবে চলবে?
একইভাবে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে ২০১৬ সাল থেকে পড়ে আছে সেন্ট্রিফিউজ মেশিন; ২০১৭ সাল থেকে পড়ে আছে অ্যানালাইজার মেশিন, অটোক্লেভ মেশিন; ২০২০ সাল থেকে পড়ে আছে সাকার মেশিন। সর্বশেষ গত ২৫ জুলাই সেখানে আরও দুটি অটোক্লেভ মেশিন আনা হয়।
কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের চিকিৎসক সারোয়ার রেজা প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে পড়ে থেকে মূল্যবান এসব যন্ত্রপাতি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। টেকনিশিয়ানের অভাবে এগুলো খোলা হচ্ছে না। এখন এগুলো ভালো আছে কি না, বোঝার উপায় নেই। ল্যাব ও যন্ত্রপাতির অভাবে বন্দীদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই দেওয়া যায় না, যা অত্যন্ত অমানবিক।
একই অবস্থা চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতালের। চিকিৎসা সরঞ্জাম থেকেও না থাকার মতো অবস্থা। এতে অসুস্থ কারাবন্দীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ২০১০ সালে ১০০ শয্যার চট্টগ্রাম কারা হাসপাতাল করা হয়। এরপর প্রায় কোটি টাকার চিকিৎসা সরঞ্জাম পাঠানো হয়। অন্যান্য কারা হাসপাতালের মতো এখানেও পড়ে আছে অ্যানালাইজার মেশিন, অটোক্লেভ মেশিনসহ নানা যন্ত্রপাতি।
চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের চিকিৎসক শামীম রেজা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই হাসপাতালে ২০১১ সালে থেকে এসব যন্ত্রপাতি অলস পড়ে রয়েছে। আমি বাইরে থেকে প্রকৌশলী এনেছিলাম। দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় এসব মেশিন নষ্ট হয়ে গেছে বলে তাঁরা জানিয়েছেন। এগুলোর যন্ত্রাংশও এখন আর পাওয়া যায় না। এখন আবার নতুন যন্ত্রপাতি কিনতে হবে। এখন ব্যবহারের মতো শুধু ইসিজি মেশিন ছাড়া আর কিছুই নেই। রুটিন চেকআপের কোনো যন্ত্রপাতি নেই।
ঢাকার কেরানীগঞ্জ, গাজীপুরের কাশিমপুর, চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা কারাগার ছাড়া দেশের অন্যান্য কারা হাসপাতালে কোনো চিকিৎসক নেই। সংযুক্ত চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট, নার্স দিয়েই এসব কারাগারের বন্দীদের কোনোমতে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
কারা কর্মকর্তা ও জেল সুপাররা বলেন, কারাগারে আসার পর বন্দীদের অখণ্ড অবসর। এ সময় তাঁরা কিছুটা স্বাস্থ্যসচেতন হন। নানা সমস্যা নিয়ে নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে আসেন। কিন্তু চিকিৎসক ও যন্ত্রপাতি থাকায় বন্দীরা তেমন কোনো সেবা পান না।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিকিৎসকসহ জনবলের বিষয়ে আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে বেশ কয়েকবার অনুরোধ করেছি। তারা জনবল না দিলে কী করার আছে। তবে, আমরা বিকল্প কী করা যায়, সে ব্যাপারে চিন্তা করছি।’
দেশে ১৩টি কেন্দ্রীয়, ৫৫টি জেলা কারাগারসহ মোট ৬৮টি কারাগার রয়েছে। সারা দেশের কারাগারে মোট বন্দীর ধারণক্ষমতা ৪২ হাজার
৬২৬ জন। তবে এখন বন্দী দ্বিগুণের বেশি প্রায় ৮২ হাজার ৭৬৬ জন। কারাবন্দী রোগীদের প্রায় অর্ধেক যক্ষ্মা, টাইফয়েড, কিডনি, লিভার, ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে ভুগছেন। তাঁদের ধারাবাহিক চিকিৎসা লাগে।