৯টি বোর্ডে গড় পাসের হার ৮৮%। জিপিএ-৫ বেড়েছে প্রায় ৭০ হাজার। এগিয়ে ছাত্রীরা।
রুমাইসা এম রহমান নবম শ্রেণিতে উঠেছিল ২০২০ সালে। সে বছর মাত্র আড়াই মাস ক্লাস হওয়ার পরই করোনার সংক্রমণ শুরু হয়। বন্ধ হয়ে যায় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৮ মাস পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সীমিত আকারে ক্লাস শুরু হয়। পরে তা আবার বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
সব মিলিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সশরীর ক্লাস কম হয়েছে, অনলাইনে বেশি। এসএসসি পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসার পর সিলেটসহ কয়েকটি জেলায় শুরু হয় বন্যা। এতে পরীক্ষা আবার পিছিয়ে যায়।
এত সব অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ও অনিশ্চয়তার মধ্যেও রুমাইসা এবার রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা শাখা থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। সে প্রথম আলোকে বলেছে, পরীক্ষার ফলাফলে সে দারুণ খুশি।
শুধু রুমাইসা নয়, করোনার কারণে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান থেকে বঞ্চিত হয়েছে লাখো শিক্ষার্থী। বন্যার কারণে পরীক্ষাও পিছিয়েছে তাদের। কিন্তু সার্বিকভাবে এবারের এসএসসি পরীক্ষার ফলাফল ভালো হয়েছে। এসএসসি (মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট) পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, দেশের ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এই পরীক্ষায় ২ লাখ ৩৩ হাজার ৭৬৩ জন শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে, যা গতবারের চেয়ে ৭০ হাজার বেশি। তবে এসএসসিতে পাসের হার কিছুটা কমেছে। হারটি দাঁড়িয়েছে ৮৮ দশমিক ১ শতাংশ। গতবার এই হার ছিল ৯৪ শতাংশ। গতকাল সোমবার এই ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, করোনার সংক্রমণের কারণে গত বছর মাত্র তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ে সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচিতে কম নম্বরে ও সময়ে পরীক্ষা হয়েছিল। বাকি বিষয়গুলোর মূল্যায়ন হয়েছিল জেএসসি ও জেডিসির বিভিন্ন বিষয়ের নম্বরের ভিত্তিতে। ফলে পাসের হার বেশি ছিল। কিন্তু এবার তিনটি বাদে বাকি সব বিষয়েই পরীক্ষা হয়েছে। ফলে গতবারের চেয়ে পাসের হার কিছুটা কমেছে। কিন্তু এটিকে তাঁরা খারাপ ফল বলছেন না। বরং ভালো বলছেন।
ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত বছরের বিশেষ পরিস্থিতি বাদ দিলে স্বাভাবিক সময়ের (২০১৭ থেকে ২০২০ সাল) মধ্যে এবারের পাসের হারই বেশি।
অতীতে এসএসসিতে পাসের হার বেশ কম ছিল। যেমন ১৯৯০ সালে এসএসসিতে পাসের হার ছিল প্রায় ৩২ শতাংশ। এখন পাসের হার ব্যাপকভাবে বাড়লেও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার মান বেড়েছে কি না, সেই প্রশ্ন রয়েছে।
এবার ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১৫ লাখ ৮৮ হাজার ৬৫৭ জন। এর মধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছে ১৩ লাখ ৯৯ হাজার ৫৭১ জন। এই ৯ সাধারণ শিক্ষা বোর্ড এবং মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড মিলিয়ে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা দিয়েছিল ১৯ লাখ ৯৪ হাজার ১৩৭ জন। এর মধ্যে গড় পাসের হার ৮৭ শতাংশের কিছু বেশি। সব বোর্ড মিলিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েছে ২ লাখ ৬৯ হাজার ৬০২ জন, যা গতবার ছিল ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৪০ জন।
এখন মুঠোফোনে খুদে বার্তা (এসএমএস) অথবা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে সহজে ফল জানা যায়। ফলে আগের মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সশরীর উপস্থিত হয়ে আনন্দ উচ্ছ্বাসের প্রবণতা কমেছে। তারপরও গতকাল রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে, হলিক্রস উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে ফল নিয়ে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের চিত্র দেখা গেছে।
নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান এবং অনলাইনে একযোগে ফল প্রকাশ করা হয় গতকাল দুপুর ১২টায়। তার আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বেলা ১১টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ফলাফল হস্তান্তর করেন শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ও শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। বেলা একটায় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে সংবাদ সম্মেলন করে ফলাফলের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন শিক্ষামন্ত্রী।
সাধারণত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত হয় এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। কিন্তু গত দুই বছরে তা সম্ভব হয়নি। চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল গত ১৯ জুন। কিন্তু বন্যার কারণে পরীক্ষা শুরুর দুই দিন আগে তা স্থগিত করা হয়েছিল। এরপর আগস্টে এই পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত পরীক্ষা শুরু হয় গত ১৫ সেপ্টেম্বর।
গতবার বাংলা, ইংরেজি, গণিতসহ বাধ্যতামূলক বিষয়গুলোর পরীক্ষাই হয়নি। শুধু নিজ নিজ বিভাগের তিনটি নৈর্বাচনিক বিষয়ের পরীক্ষা হয়েছিল। অর্থাৎ বিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থীকে কেবল বিজ্ঞান বিভাগের তিনটি বিষয়েই পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। একইভাবে মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের শিক্ষার্থীরা তাদের বিভাগের তিনটি বিষয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল। কিন্তু এবার বাংলা, ইংরেজি, গণিতসহ বাধ্যতামূলক বিষয়গুলোরও পরীক্ষা হয়েছে। শুধু বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বা সাধারণ বিজ্ঞান, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিষয়ের পরীক্ষা হয়নি; এগুলোর মূল্যায়ন হয়েছে জেএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, এবার তুলনামূলক কঠিন বিষয় হিসেবে বিবেচিত ইংরেজি ও গণিতে শিক্ষার্থীরা ভালো ফল করেছে। যেমন ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের একটি সূত্র জানিয়েছে, এবার বোর্ডটিতে ইংরেজি বিষয়ে ৯৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে। আর গণিতে পাস করেছে প্রায় ৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী। ফলে সার্বিক পাসের হারেও এর প্রভাব পড়েছে।
কয়েক বছর ধরেই পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে ভালো করছে মেয়েরা। গতবারের মতো এ বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায়ও পাসের হার ও জিপিএ-৫ পাওয়ার দিক দিয়ে ছাত্রদের পেছনে ফেলেছে ছাত্রীরা। ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে ছাত্রীদের পাসের হার ৮৮ দশমিক ৪২ শতাংশ। ছাত্রদের পাসের হার ৮৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এসএসসিতে মোট জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রী ১ লাখ ৩১ হাজার ৩০৪ জন এবং ছাত্র ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৯ জন।
৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এসএসসি পরীক্ষায় এবার পাসের হারের দিক দিয়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছে যশোর শিক্ষা বোর্ড (৯৫ শতাংশ)। সবচেয়ে পিছিয়ে সিলেট, সেখানে পাসের হার প্রায় ৭৯ শতাংশ। সিলেটে ভয়াবহ বন্যার কারণে শিক্ষার্থীদের ফলাফল ভালো হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে প্রায় ৯০, রাজশাহীতে ৮৬, কুমিল্লায় ৯১, চট্টগ্রামে ৮৮, বরিশালে ৯০, ময়মনসিংহে ৮৯ ও দিনাজপুরে ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থী পাস করেছে।
আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির প্রধান ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান তপন কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মনে করছেন, সার্বিক বিবেচনায় এবার এসএসসি পরীক্ষার ফল ভালো হয়েছে।
এবার একজনও পাস করেনি, এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা গতবারের চেয়ে ৩২টি বেড়ে ৫০টি হয়েছে। শতভাগ পাসের হার অর্জন করেছে ২ হাজার ৯৭৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গত বছর এমন প্রতিষ্ঠান ছিল ৫ হাজার ৪৯৪টি। অর্থাৎ এই দুটি দিকে অবনতি ঘটেছে।
যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাস করেনি, তাদের বিষয়ে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি জানান, তাঁরা শাস্তি দিতে চান না। বরং কীভাবে এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠা যায়, সে ক্ষেত্রে সহায়তা দিতে চান।
এদিকে মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান মনে করেন, করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতিতে এমনিতেই সেশনজট তৈরি হয়েছে। এখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি পরামর্শ থাকবে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির কাজটি শেষ করে সময়সীমা দিয়ে ক্লাস ও পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থা করা।
৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন এসএসসিতে অংশ নিয়েছিল ১৫,৮৮,৬৫৭ জন, উত্তীর্ণ হয় ১৩,৯৯,৫৭১ জন
জিপিএ-৫ পেয়েছে ২,৩৩,৭৬৩ জন। এর মধ্যে ছাত্রী ১,৩১, ৩০৪ এবং ছাত্র ১,০২,৪৫৯ জন।
পাসের হারের শীর্ষে যশোর শিক্ষা বোর্ড (৯৫.১৭ শতাংশ), পিছিয়ে সিলেট (৭৮.৯০ শতাংশ)