গবেষণায় সুপারিশ হিসেবে চালকলমালিকদের মিলগেটে চালের দাম কমানো উচিত বলে মত দেওয়া হয়েছে।
২০১৯ সালে একজন শ্রমিক দৈনিক মজুরি দিয়ে ১৩ কেজি চাল কিনতে পারতেন।
চলতি বছর তাঁরা সাড়ে আট কেজি চাল কিনতে পারছেন।
মাঝারি চালের ক্রেতারা ঝুঁকছেন মোটা চালে।
দেশে ধান–চালের বাজারে কৃষক থেকে ভোক্তাপর্যায়ে পৌঁছাতে পাঁচবার হাতবদল হয়। প্রতিবার হাতবদলের সময় যোগ হয় খরচ আর মুনাফা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ও অস্বাভাবিক মুনাফা করছেন চালকলমালিকেরা। তাঁরা প্রতি কেজি চাল ও এর উপজাত বিক্রি করে ৮ থেকে ১৩ টাকা ৬৬ পয়সা পর্যন্ত মুনাফা করছেন।
ধান থেকে চাল করার সময় যেসব উপজাত তৈরি হয়, চালকলমালিকেরা তা আলাদাভাবে বিক্রি করেন। এতে বাড়তি মুনাফা করলেও চালের দাম কমাচ্ছেন না তাঁরা। বরং খুচরা বাজারে চালের দাম বাড়লে ও হাটে ধানের দাম বাড়লে ওই সুযোগে তাঁরা মিলগেটে চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
‘বাংলাদেশে চালের দাম বৃদ্ধির একটি সমীক্ষা: কৃষক থেকে ভোক্তাপর্যায়ের অবস্থা’ শীর্ষক ওই গবেষণা বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের নেতৃত্বে হয়েছে।
খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে চালকলমালিকদের সঙ্গে আলোচনা এবং দরকার হলে চাপ দিয়ে দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, অর্থনীতিবিদ
গবেষণায় বলা হয়েছে, প্রতি কেজি ধান ভাঙিয়ে ৬০০ থেকে ৬৫০ গ্রাম চাল পাওয়া যায়। চালকলমালিকেরা ওই পরিমাণ চালের ওপরে এক থেকে দুই টাকা পর্যন্ত মুনাফা দেখান। কিন্তু ধান ভাঙিয়ে চাল করার ফলে উপজাত হিসেবে যে কুঁড়া, ভাঙা চাল ও চালের ওপরের ছেঁটে ফেলা অংশ তৈরি হয়, তা চালকলমালিকেরা প্রতি কেজি ছয় থেকে নয় টাকা দরে বিক্রি করেন। সেই হিসাবে চালকলমালিকেরা অস্বাভাবিক মুনাফা করছেন। গবেষণায় সুপারিশ হিসেবে চালকলমালিকদের মিলগেটে চালের দাম কমানো উচিত বলে মত দেওয়া হয়েছে।
ব্রির মহাপরিচালক শাহজাহান কবির প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে চালের মূল্যবৃদ্ধির কারণ বুঝতে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে আমরা গবেষণাটি করেছি। চালের বাজার নিয়ে অন্যান্য গবেষণা পর্যালোচনা করেও আমরা দেখেছি, মূলত চালকলমালিকদের কারণে দাম দ্রুত বাড়ছে। ফলে চালকলগুলোর উচিত তারা কত দামে ধান কিনে তা কীভাবে চালে পরিণত করছে এবং ধান ও উপজাত বাবদ মোট কী পরিমাণ মুনাফা করছে, তার হিসাব দেওয়া। আর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উচিত চালকলমালিকদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে চালের মিলগেট দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়া।’
গবেষণাটির জন্য সংস্থাটি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সংস্থা খাদ্য পরিধারণ ও মূল্যায়ন বিভাগ, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ইরি) তথ্য ও কারিগরি সহায়তা নিয়েছে। গবেষণাটিতে কারিগরি সহায়তা দিয়েছেন ইরি–বাংলাদেশের এদেশীয় প্রতিনিধি হোমনাথ ভান্ডারি ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম।
জানতে চাইলে দেশের চালকলমালিকদের কেন্দ্রীয় সংগঠন বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক প্রথম আলোকে বলেন, ‘গবেষণায় চালকলমালিকদের যে অস্বাভাবিক মুনাফা নেওয়ার তথ্য উঠে এসেছে, তা ঠিক নয়।
কারণ, চালকলমালিকেরা একটি মিল চালাতে ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া থেকে শুরু করে নানা খাতে অর্থ বিনিয়োগ করে। আমরা যদি এত মুনাফা করতাম, তাহলে ৯০ শতাংশ চালকলমালিক ব্যাংকের কাছে খেলাপি হতো না। দেশের বেশির ভাগ চালকল বন্ধ থাকত না। তাই গবেষকদের উচিত আরও ভালোমতো যাচাই-বাছাই করে গবেষণা করা।’
মাঠ জরিপে মাথাপিছু চালের ভোগ বা প্রতিটি মানুষ গড়ে দিনে কী পরিমাণে চালের ভাত খায়, সেই হিসাব নেওয়া হয়েছে। এতে দেখা গেছে, করোনার আগে ২০১৯ সালে গড়পড়তায় একজন মানুষ দিনে ৩৮৪ গ্রাম করে চালের ভাত খেত। করোনা শুরু হওয়ার পর তা বেড়ে ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সালে ৪০৫, ৪১১ ও ৪০৯ গ্রাম হয়েছে। এর মধ্যে গ্রামের মানুষের ভাত খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে ৬ দশমিক ১৩ শতাংশ আর শহরে তা বেড়েছে ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ।
মোটা চালের ভাত খাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বিপদে আছে। ২০১৯ সালে একজন শ্রমিক তাঁর দৈনিক মজুরি দিয়ে ১৩ কেজি চাল কিনতে পারতেন। ২০২২ সালে তা কমে সাড়ে ৮ কেজি হয়েছে। দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে মাঝারি মানের চালের ১০ শতাংশ ক্রেতা সবচেয়ে মোটা বা নিম্নমানের চাল কেনার দিকে ঝুকঁছেন। এর ফলে বাজারে মোটা চালের দামও নিয়মিতভাবে বাড়ছে।
খাদ্য পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে গবেষণাটিতে বলা হয়েছে, দেশে খাদ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে বা প্রয়োজন অনুযায়ী আমদানি করে সরবরাহ বাড়ালেই সবার জন্য খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না। এটা করতে হলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে অথবা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে খাদ্যপণ্য মানুষের কাছে সহজলভ্য করতে হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক, অর্থনীতিবিদ এম আসাদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, সরকার চালকলমালিকদের ওপরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার কী উদ্যোগ নিয়েছে, তা পরিষ্কার করুক। খাদ্য মন্ত্রণালয়েরও উচিত মূল্যবৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধান করা। আটা, তেল, ডালসহ অন্যান্য পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষ ভাত বেশি খাচ্ছে। যে কারণেও চালের দাম বাড়তে পারে। ফলে সামগ্রিকভাবে খাদ্যপণ্যের দামের প্রভাব গরিব মানুষের ওপরে কীভাবে পড়ছে, দাম কোথায় কী পরিমাণে বাড়ছে, তার একটি মূল্যায়ন হওয়া উচিত। তারপর সরকারের এ ব্যাপাারে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন মানুষের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা এবং বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন সর্বোচ্চ ৩৫০ গ্রাম চালের ভাত খাওয়া দরকার। এর চেয়ে বেশি হলে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর, যা মানুষের কর্মশক্তি কমিয়ে দেয়, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ নানা ধরনের রোগবালাইয়ের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে ২ হাজার ২৮ জনের ওপরে সংস্থাটি জরিপ করে। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিলেন কৃষক ও ভোক্তা। দলীয় আলোচনা, সাক্ষাৎকার এবং অন্যান্য সরকারি–বেসরকারি গবেষণার তথ্য–উপাত্ত মূল্যায়ন করে গবেষণাটি করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে চাল উৎপাদিত হয়েছিল ১ কোটি ৫ লাখ ৯০ হাজার টন। চলতি বছর তা ৩ কোটি ৬০ লাখ টন হবে। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির চেয়ে চালের উৎপাদন বেশি হারে বাড়ছে উল্লেখ করে বলা হয়েছে, দেশে প্রয়োজন অনুযায়ী যথেষ্ট পরিমাণে চাল আছে।
গবেষণাটিতে দেখা গেছে, দেশে সারা বছরে উৎপাদিত মোট ৩ কোটি ৬০ লাখ টন চালের মধ্যে প্রায় ৬২ শতাংশ চাল বাজারে বিক্রি হয়। এর মধ্যে বোরো মৌসুমের সর্বোচ্চ ৬৬ দশমিক ২ শতাংশ চাল বাজারে বিক্রি হয়। এর মধ্যে ২০১৯–২০২০ সালে করোনার প্রভাবের পর বাজারে চালের সংকট দেখা দেয়। দাম ও মজুত নিয়ে শঙ্কা বা গুজব তৈরি হয়। এতে বড় চাষিরা ধান ও ব্যবসায়ীরা চাল বাজারে ছাড়েন ধীরে। ফলে বাজারে চালের সংকট দেখা দেয়, দাম যায় বেড়ে। সরকারের সংগ্রহ অভিযান ব্যর্থ হয়।
গবেষণায় দেখা গেছে, বাজারে ধান–চালের ব্যবসায় মূলত পাঁচটি পক্ষ জড়িত। প্রথমত কৃষক নিজে, দ্বিতীয়ত ফড়িয়ারা, তৃতীয়ত আড়তদার, চতুর্থত চালকলমালিকেরা ও পঞ্চমত চালের খুচরা বিক্রেতারা। এর মধ্যে সবচেয়ে কম লাভ করেন ফড়িয়ারা। তাঁরা প্রতি কেজি ধানে গড়পড়তায় ৫০ থেকে ৬৫ পয়সা করে মুনাফা করেন। আড়তের মালিকেরা প্রতি কেজিতে ১ টাকা ৭৫ পয়সা পর্যন্ত মুনাফা করে থাকেন। তাঁদের খরচ বলতে দোকান ও গুদামের ভাড়া, বিদ্যুৎ বিল ও শ্রমিক-কর্মচারীদের মজুরি।
গবেষণাটিতে ধান–চালের বাজারে সবচেয়ে প্রভাবশালী পক্ষ হিসেবে চালকলমালিকদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁরা বিপুল অঙ্কের টাকা এ ব্যবসায় বিনিয়োগ করে থাকেন। তাঁরা ধান থেকে চাল বানানোর যন্ত্রপাতি কেনা, ধান কেনা, গুদামে রাখা, বিদ্যুৎ বিল, শ্রমিক–কর্মচারীদের মজুরি, বাজারজাতকরণের খরচসহ অন্যান্য খরচ করে থাকেন। উপজাত মিলিয়ে তাঁরা প্রতি কেজি চালে ৮ টাকা থেকে ১৩ টাকা ৬৬ পয়সা পর্যন্ত মুনাফা করে থাকেন।
খুচরা বিক্রেতারা পাইকারদের কাছ থেকে চাল কিনে দোকানে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করেন। তাঁরা মোটা চাল বিক্রিতে সবচেয়ে কম মুনাফা করেন। বেশি মুনাফা করেন সরু ও উন্নত মানের চালে। মোটা চালে আমন মৌসুমে ২ টাকা থেকে ৭ টাকার ওপরে এবং বোরোতে ৩ টাকা থেকে ৪ টাকা ৬১ পয়সা পর্যন্ত মুনাফা করে থাকেন। এ ধরনের ব্যবসায়ীদের মূল খরচ হচ্ছে দোকানভাড়া, কর্মচারীর বেতন ও অন্যান্য উপকরণ বাবদ খরচ।
গবেষণায় বলা হয়, কৃষকেরা প্রতি কেজি ধানে ২ থেকে সাড়ে ৪ টাকা লাভ করেন। তবে এই হিসাবে জমির ভাড়া এবং কৃষকের নিজের শ্রম বাদ দেওয়া হয়েছে। এ দুটি খাতের হিসাব যোগ করলে কৃষকের লাভ প্রতি কেজিতে ১ থেকে ২ টাকা।
গবেষণার তথ্য সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে পল্লী কর্ম–সহায়ক ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, চালকলমালিকেরা আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন।
তাঁরা আর্থিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাবান হওয়ায় বেশি বিনিয়োগ করে চালের বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে চালকলমালিকদের সঙ্গে আলোচনা এবং দরকার হলে চাপ দিয়ে দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত।